হেলেনা
হেলেনা - ছবি : সংগৃহীত
মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। এ কথাটি বাংলাদেশে খুব পরিচিত। ছোটবেলায় বৃষ্টিকে নির্দয়ভাবে ঝরতে দেখেছি। স্কুলে পরীক্ষার খাতায় কতোবার অনুবাদ লিখেছি, 'মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছে- it is raining cats and dogs.' টিনের ঘরের উপর যখন এই মুষলধারে বৃষ্টি ঝরত, ঘরের মধ্যে থেকে তখন মনে হতো, টিনের উপর যেন সত্যি সত্যি কুকুর-বিড়ালের মারামারি চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত-নেপাল থেকে চীন পর্যন্ত এই বৃষ্টির দাপট ছিল তখন।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলতো, মুষলধারে বৃষ্টি আরো দুই দিন হতে পারে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকতো। বাংলাদেশ ছেড়েছি বহুকাল আগে। যাওয়া হয় না বললেই চলে। জানি না এখন কী অবস্থা!
সুইডেনে আজ সকাল থেকে তুমুল আকারে তুষার পড়তে শুরু করেছে। ঠিক যেন মুষলধারে। সুইডেনে মাত্র কয়েকবার মুষলধারে বৃষ্টি হতে দেখেছি, আমার চল্লিশ বছরের প্রবাসজীবনে। তবে মুষলধারে তুষার পড়তে দেখেছি বহুবার। 'মুষলধারে তুষার পড়িতেছে'- এর অনুবাদ করলে দাঁড়াবে 'It is snowing in a bucket'. কেন যে 'It is snowing cats and dogs' হলো না তা বোধগম্য নয়। তবে হতে পারে এমনটি যে তুষারপাত যখন হয় তখন তুষার শিমুল তুলার মতো পড়ে কোনোরকম শব্দ ছাড়া। এ কারণে 'cats and dogs' না হয়ে 'bucket' ব্যবহৃত হয়েছে।
কী আর করা। বিদেশি ভাষা তাদের মতো করেই আমাদেরকে শিখতে হবে। তুষারের সাথে এলোপাতাড়িভাবে পুরোদস্তুর ঝড় বইছে যার ফলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তুষার যখন পড়ে তখন তাপমাত্রা জিরো ডিগ্রি। আর যখন তুষারের সাথে ঝড়ো বাতাস বয় তখন অবস্থা সত্যি শোচনীয়।
আজ ঠিক তাই হয়েছে। ঠাণ্ডার প্রকোপে তাহলে সবকিছু কি বন্ধ? না, মোটেই না। দিব্যি চলছে সাধারণ জীবনযাপন। তবে ঘরের বাইরের পরিস্থিতি একদম অসহনীয়, একদম বিশ্রী। এরকম অসহনীয় পরিস্থিতিতে আজকের প্রায় গোটা দিনটাই কেটেছে আমার।
সবে ঘরে ঢুকেছি, একটু গরম বোধ করছি। একইসাথে জানালা দিয়ে বাইরে যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে আকাশ-পাতাল মিশে একাকার। পুরো সুইডেন কুয়াশাচ্ছন্ন। জানি না কতোক্ষণ চলবে এইভাবে। বাংলাদেশে মুষলধারে বৃষ্টি হলে যে জিনিসটা প্রথমেই ঘটত তা হলো বিদ্যুৎ চলে যাওয়া। এবং অন্ধকারে আচ্ছন্ন হতো পুরো দেশ। অবশ্য আমার গ্রামে ১৯৮০ সালের পূর্বে বিদ্যুৎ ছিল না। তখনকার অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। সুইডেনে কখনো বিদ্যুৎ যেতে দেখিনি। তবে বাইরে খুবই অন্ধকার। বাসায় কেউ নেই। সবাই যার যার কাজে। মনের মধ্যে যেন কেমন কেমন করছে। 'এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ না, এ তো মুষলধারে বৃষ্টির গান নয়, অলস বৃষ্টির গান। মন সায় দিল না এ গানে। তাহলে কোন গানটি উপযুক্ত আমার জন্য? 'হেলেন ভেঙেছে ট্রয় নগরী, কেউ ভেঙেছে সিংহাসন। ভেঙেছে কতজন, ভেঙেছে কত মন, সবই তো নারীরই কারণ।' আসলে কি তাই? মন ভাঙার পেছনে কি শুধু নারীই দায়ী? গড়ার পিছনে নারীর কৃতিত্ব নেই? সম্রাট শাহজাহান তাজমহল গড়েছিলেন তো তার প্রিয়তমা মমতাজেরই কারণে। আমরা পুরুষ মানুষ কী স্বার্থপর! অতএব এই গানও বাদ। বরং স্মৃতি রোমন্থন করা যাক।
সে এক নতুন দেশ। বহু বছর আগে গিয়েছিলাম বেড়াতে। দেশ বলতে স্পেনের অধীনে আটলান্টিক সাগরের মধ্যে কয়েকটি আইল্যান্ড, যা স্পেনে ক্যানেরি আইল্যান্ড বলে পরিচিত। আফ্রিকান কন্টিনেন্টের মধ্যে পড়া সত্ত্বেও আইল্যান্ডগুলো স্পেনের অধীনে। অতীতে ব্রিটিশদের মতো ফ্রান্স এবং স্পেনও বিশ্বের অনেক দেশ দখল করে। গড়ে তোলে তাদের কলোনি। সেইভাবে আইল্যান্ডগুলোর মালিক এখনো স্পেন। মূলত মোট সাতটি বড় আইল্যান্ডের সমন্বয়ে এই ক্যানেরি আইল্যান্ড গঠিত। অন্যান্য আইল্যান্ডের মধ্যে রয়েছে গ্রান ক্যানেরি, লানসারটে, লা পালমা, লা গোমেরা, ফিউরেতেভেন্টুরা ও এল হিয়েরো। এছাড়াও আরও ছোট ছোট ছয়টি আইল্যান্ড রয়েছে এখানে।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে গিয়েছিলাম বেড়াতে টেনেরিফ আইল্যান্ডে। ল্যান্ড করেছি অনেক রাত তখন। প্লেন থেকে নেমেই সরাসরি টাক্সি নিয়ে সমুদ্রের তীরে হোটেলে। রাত বেশি। দ্রুত ঘুম চেপে বসে দুই চোখে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দ্বীপের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ, বিমোহিত। আহ্ কী অপরূপ সৌন্দর্য!
আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত স্পেনের দক্ষিণ টেনেরিফ। স্রষ্টার সৃষ্টি কতো বৈচিত্র্যময় তা সরাসরি না দেখলে বোঝা যাবে না। সাগরের নীল পানি। তার কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে জনবসতি, নানা ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। টেনেরাইফের দক্ষিণে উপকূলরেখার বেশিরভাগ অংশ বালুকাময়। দ্বীপের সৈকতগুলি কে কতটা সুন্দর, তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সুন্দর মনোরম আবহাওয়া, সারাবছর রোদ জলের উষ্ণতা। ছুটি কাটানোর এটি এক চমৎকার জায়গা। যারা জলকেলি খেলতে পছন্দ করে তারা তো একেবারে মেতে ওঠে।
টেনেরাইফের দক্ষিণে ল্যান্ডস্কেপগুলো পর্যটকদের বাড়তি আনন্দ জোগায়। বেড়াতে যাওয়া, সমুদ্রের ধারে রেস্তোরাঁয় খাওয়া, রাতে নানা ধরণের বিনোদন আরো কত কী! সময় কাটানোর জন্য এর থেকে সুন্দর জায়গা আর কী হতে পারে!
দেখার মতো একটি শপিং মল লাস ভেগাস সাফারি। অন্যদিকে নৌকা ভ্রমণে দেখা যায় তিমি ও ডলফিনের খেলা। সবকিছু মিলে দ্বীপটির সৌন্দর্য অপূর্ব। সমুদ্র সৈকতটি রোদের জন্য উপযুক্ত একটি স্থান, রয়েছে কিছু ঐতিহ্যবাহী টেনেরিফ রেসিপির স্বাদ। বছরের যেকোনো সময় সাগরে সাঁতার কাটা যায় এখানে। পারিবারিক পরিবেশে ঘেরা টেনেরিফ দ্বীপ। অন্যান্য বিশাল জনপ্রিয় সৈকতের মধ্যে রয়েছে প্লেয়া দে লস ক্রিশ্চিয়ানোস ও লস তারাজলেস। লস ক্রিশ্চিয়ানোস বন্দরটি সমুদ্র সৈকতের ঠিক পাশে অবস্থিত। প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হলে টেনেরিফ দক্ষিণ দ্বীপের সৌন্দর্য একবার হলেও দেখা উচিত। অর্থ, প্রাচুর্য সবই তো মানবজাতির ভোগ-বিলাসের জন্য।
ভোগ-বিলাসের মধ্যেই পার হয়ে গেছে দুদিন। তৃতীয় দিন শহরে আড্ডা দিতে দিতে বেশ রাত হয়েছে, হোটেলে ফিরতে হবে। ট্যাক্সি মিলেছ না, কী করি! হঠাৎ আকাশে মেঘ। সেখানকার লোকজন বলাবলি করছে, তারা এমনটি কখনো কেউ দেখেনি। দ্বীপটির পাহাড়ের উপর তুষারের দেখা মেলে এ সময়, যদিও ঠাণ্ডা টের পাওয়া যায় না এখানে। আমার হোটেল শহর থেকে বেশ দূরে, হবে দুই থেকে তিন কিলোমিটার। ভাবলাম সাগরের পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে চলে যাবো। হাঁটা শুরু করেছি, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়। রাস্তার বাতিও নিভে গেল। বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। কোথাও কেউ নাই, গাঢ় অন্ধকার। মুহূর্তেই এক ভীতিকর অবস্থা। গা খানিকটা ছমছম করছে। দ্রুতগতিতে একটি কুকুর আমাকে অতিক্রম করে পাশ দিয়ে চলে গেল। দিনে রাস্তায় কুকুর দেখিনি কিন্তু অন্ধকারে কুকুর পাশ দিয়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরই চোখে পড়ল, সাদা কাপড়ে কেউ হেলেদুলে চলছে, মাত্র ১৫/২০ মিটার দূরে। যাক একজনকে পাওয়া গেল এই দুঃসময়ে। ভয়ের জায়গায় সাহস সঞ্চার হলো। বেশ জোরে হাঁটতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু এ কী, দূরত্ব বেড়েই চলেছে! এদিকে দেখি লোকটি রাস্তা ছেড়ে সাগরের দিকে রওনা দিল। তাহলে কি লোকটি মানুষ নয়? মানুষ না হলে কী? সাহস যেটুকু পেয়েছিলাম সেটুকু উধাও। চল্লিশ বছর আগে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে পড়েছিলাম। গভীর রাতে শ্রীকান্ত শ্মশানের পাশ দিয়ে যাবার সময় যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল আমি কি তাহলে সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি?
আমাকে জানতে হবে ওটা কি মানুষ না অন্য কিছু? চিৎকার করে ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম, হ্যালো ক্যান ইউ প্লিজ ওয়েট ফর মি? উত্তর নেই। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছমছম করছে। আরো চিৎকার করে একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। এবার উত্তর পেলাম। এবং সেইসাথে স্বস্তি। উত্তরে বললো, ওকে। গলার স্বরে মনে হলো সে মানুষ, এবং মেয়েমানুষ।
এদিকে বৃষ্টি থেমেছে, ঘোলা আকাশ খোলা হতে শুরু করেছে। মেয়েটি কাছে এগিয়ে এলো। ওমা এ কী? মেয়েটির গায়ে কোনো কাপড় নেই, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, উলঙ্গ! ঝড় কমেছে। বৃষ্টি থেমেছে। বাতাস বইছে। তবে বাতাস খুব ঠাণ্ডা নয়, বরং চমৎকার, তাই শরীরে কাপড় না থাকায় কোনো সমস্যা নেই। তবে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র একটি মেয়ে, অপরূপা সুন্দরী, এই জোছনা রাতে টগবগে এক যুবকের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তাহলে কি মেয়েটি মানুষরূপী অন্য কিছু?
আমি সুইডেনে থাকি। উলঙ্গ মেয়ে সামারে দেখেছি অনেক। তারপর সাগরের পাড়ে একটি উলঙ্গ মেয়ে দেখা নতুন কিছু না। তবুও অবাক! প্রথম দেখলাম একটি কুকুর, পরে সাদা কাপড়ে কাউকে, এখন আবার হঠাৎ বিবস্ত্র নারী! বললাম, সরি তোমাকে বিরক্ত করার জন্য। আমার হোটেল আরেকটু সামনের দিকে। হঠাৎ লাইট চলে যাওয়ায় একটু ভয় করছে। এত রাতে একা একা তাই... কথা শেষ না করতেই মেয়েটি বেশ সুন্দর ইংরেজিতে উত্তর দিতে শুরু করলো, বলল, ঠিক আছে সমস্যা নেই। ভোর রাতে সাগরে গোসল করেছ? আমতা আমতা করে বললাম, না, মানে... কেন বলো তো? সে বলল, চলো গোসল করি, পরে তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দেব। নিজেকে সবসময়ই বেশ সাহসী মনে করি। কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি।
আমি ভীত নই, এমন মুড নিয়ে স্মার্টলি বললাম, তুমি কিভাবে আমার হোটেল চিনবে? বলল, আমিও ওই একই হোটেলে থাকি। উত্তরে বললাম, তা আমি যে ওই হোটেলে থাকি, কী করে জানলে? বলল, এখন জানলাম। বললাম, কিভাবে? উত্তরে বললো, তোমাকে দেখে এখন চিনতে পেরেছি। আমি তোমাকে প্রতিদিন সকালে হোটেলে ব্রেকফাস্টে দেখি। হোটেলে ব্রাউন রঙয়ের তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাই চিনতে সমস্যা হয়নি।
যাক বাবা! মনে মনে বললাম, কখনো ভয় আমি পাইনি, ভয় পাওয়ার লোকও আমি নই। মানুষ সম্ভবত এমনই। বিপদে সৃষ্টিকর্তার শরণাপন্ন হয়। বিপদ কেটে গেলে আবার যা তাই।
পুরো স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তা তোমার কাপড় কই? কিছুক্ষণ আগে সাদা কাপড়ে তোমাকে না হেঁটে যেতে দেখলাম? উত্তরে বললো, হাঁটতে পথে কাপড় খুলে ফেলেছি। এক হাতে ধরে থাকা কাপড় দেখিয়ে বললো, ভাবলাম হোটেলে যাবার আগে একটু গোসল করে যাই। তা তুমি কি আমার সঙ্গে গোসল করবে? বললাম এই রাতে? সে বলল, রাত কোথায়, এখন ভোর চারটা বাজে একটু পরে সূর্য উঠবে, চলো গোসল করবে।
পুব আকাশ ফর্সা হয়ে উঠছে। তার প্রতি সব আশঙ্কা কাটতে শুরু করেছে, এবার পুরোপুরি কেটে গেছে। হঠাৎ চেনা এই সুন্দরী ইউরোপিয়ান মেয়ের সাথে নগ্ন শরীরে গোসল করলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা যুবকটির স্মৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে, এটি একটি সুযোগ, হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না।
বললাম, চলো যাই। কী আছে জীবনে, যেই ভাবনা সেই কাজ। তার মতো শতভাগ নগ্ন না হলেও প্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হলো তার পছন্দ হলো না এটা। আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হওয়ার আমন্ত্রণ জানাল। আমি ইশারায় সঙ্কোচবোধ করলাম। সে আর জোরাজুরি করল না। পরস্পরের প্রতি রেস্পেক্টের অভাব নেই। এখানেও তার প্রতিফলন ঘটতে দেখলাম।
পানির দিকে হেঁটে চলেছি। যেতে যেতে পথে বাকি পরিচয়ও শেষ হলো। মেয়েটির নাম হেলেনা, দেশের বাড়ি সুইজারল্যান্ড, সমবয়সী হবে। সেও এসেছে ছুটিতে বেড়াতে। সোনালি রঙয়ের চুল, নীল রঙয়ের চোখ, তারপর সূর্যের রশ্মি গায়ে এমনভাবে লেগেছে, সানবাথের কারণে, দেখে মনে হচ্ছে কাঁচা সোনার রঙে তৈরি বিধাতার আপন হাতে গড়া এক অপরূপা রমণী।
পানিতে নেমে ছিলাম একসাথে, গোসল শেষে উঠলাম একসাথে, হোটেলের দিকে হাঁটতেও শুরু করলাম একসাথে। অন্তত আধা ঘন্টা হাঁটার পর হোটেলে পৌঁছলামও একসাথে। তারপর যার যার রুমে। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুম।
ঘুম থেকে যখন উঠেছি, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তাড়াহুড়ো করে কাপড় পরে লবিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হেলেনা কি তার রুমে আছে? রিসিপসোনিস্ট চেক করে বললো, না, তবে একটি নোট রেখেছে তোমার জন্য। 'ডিনার করবা রাতে একসঙ্গে? আমি ঠিক ৮টার সময় লবিতেই থাকবো।' ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা সাতটা বাজে।
এসেছি ছুটিতে। হেলেনা একা, আমিও একা। গতকাল পরিচয় হয়েছে আকস্মিকভাবে, রাজি হয়ে গেলাম। রুমে গিয়ে নিজেকে গুছিয়ে ঠিক ৮টার সময় এসে দেখি, হেলেনা বসে আছে পথ চেয়ে আমার অপেক্ষায়। হঠাৎ দেখে চমকে নির্বাক হয়ে গেছি থমকে, মনে হলো সে যেন অনেক দিনের চেনা।
হোটেলের লবি থেকে বের হতেই হেলেনা আমার হাত ধরে দিব্যি হাঁটতে শুরু করলো। আমার পুরো শরীরটা কেমন অবশ মনে হলো। একদিকে জড়তা অন্যদিকে আবেগ। হৃদয়ে দোলা লেগেছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই দুজনে আটলান্টিক সাগরের পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম টেনরিফ শহরে।
হেলেনা বললো, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে চলো, তোমার সঙ্গে ইন্ডিয়ান খাবার খেতে চাই। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই বুঝতে পারলাম বাংলাদেশী, তবে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসেবেই পরিচিত। এ শুধু এখানে নয়, সারা ইউরোপে একই অবস্থা। আমার লাল সবুজের বাংলাদেশীরা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসেবেই পরিচিত। বাংলাদেশে যেমন ছোট গ্রামের লোকেরা দূরে কোথাও গিয়ে যেমন পার্শ্ববর্তী বড় গ্রামের পরিচয়ে নিজেকে তুলে ধরে, ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশীরাও বাধ্য হয়ে নিজেদেরকে ইন্ডিয়ান বলে পরিচয় দেয়।
যাইহোক ওয়েটার টেবিলে এসে জিজ্ঞেস করল কী খেতে চায়, উত্তরে বললাম, বাংলাদেশী কিছু তৈরি করতে পারবেন। বাংলা কথা শুনে ভদ্রলোক বললেন আপনি বাঙালি? বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, ঠিক আছে ভাই আমিই রেস্টুরেন্টের মালিক ডিনারের ব্যবস্থা করছি তবে মেডাম কি ঝাল খেতে পারবেন? হেলেনাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন ঝাল হবে জিজ্ঞেস করছে। হেলেনা বলল, তুমি যেভাবে পছন্দ করো সেভাবে দিতে বলো।
হোটেল মালিক বাংলাদেশী। ইতিমধ্যে তার পরিচয় পেয়েছি। নাম চেঞ্জ করে তিনি নিজের নাম ডেভিড রেখেছেন। ডেভিড ভাই কিছুক্ষণ পরে দেখি বেগুন ভাজি, মুরগির ঝোল ও ডালের ব্যবস্থা করেছেন।
চমৎকার, আমি নিজেও বহু দিন এমনটি বাংলা খাবার খাইনি, তো মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম।
হেলেনা কাটা চামচ রেখে দিব্যি হাত দিয়ে খাবার খেতে শুরু করেছে। আমি তো অবাক! কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছি না! গতকাল থেকেই সন্দেহ ঢুকেছে মাথায়, কার সঙ্গে ঘুরাঘুরি করছি? সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, বাংলা খাবার হাত দিয়ে এর আগে কি খেয়েছ? উত্তরে বলল, না, তবে টিভিতে তোমাদের দেশে খেতে দেখিছি। অনেক দিনের শখ হাত দিয়ে খাওয়ার কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি এর আগে কখনো হয়নি। আজ যখন সুযোগ হয়েছে তোমার সঙ্গে বাংলা খাবার খাওয়ার, তাই হাত দিয়ে না খেলে এ সুযোগ জীবনে হয়তো আর না-ও আসতে পারে।
হেলেনার সব কিছু যে আমার ভালো লেগেছে তা নয়। তারপরও এই স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাকে ঘিরে যা যা ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে তাতে ভালো না লেগে কি উপায় আছে? ডিনার শেষে বাংলা চা পান করে রেস্টুরেন্ট থেকে বিদায় নেবো। এমন সময় ডেভিড ভাই হেলেনাকে ছোট্ট একটি বাংলা গিফট দিয়ে বললেন, 'আমরা আপনার বাঙালি স্টাইলে খাবার খেতে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আপনি বাংলাদেশে গেলে মানিয়ে নিতে পারবেন নিশ্চিত।' ডেভিড ভাই ধরে নিয়েছে হেলেনা আমার একান্ত আপনজন।
বিদায় পর্ব শেষ করে গেলাম ডিস্কোথেক। বয়স আমার বেশি না তখন, আলোর চেয়ে বেশি গতিতে হেলেনার সাথে আমার সময় ছুটতে শুরু করেছে। গতকাল অন্ধকারে একাকী হাঁটার সময়টুকু ছিল এক যুগ, আজ সন্ধ্যার সময়টুকু সেকেন্ডের মধ্যে শেষ হতে চলেছে। ছোট বেলায় গরমে এক মিনিট আগুনের সামনে যখন বসতাম মনে হতো এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি, আর আজ হেলেনার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করার পরও মনে হচ্ছে মাত্র কিছুক্ষণ হলো তার সাথে আছি। কারো সাথে সময় কাটাতে বিরক্ত লাগে আবার কারো সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে, এটাই সত্য।
যাহোক হলো কিছুক্ষণ বিনোদন, হলো নাচ গান। হঠাৎ ১৯৯০ সালের নির্মিত ভীষণ সাবলীল সুন্দর এক প্রেমের ছবি 'প্রিটি ওম্যান' ছবির গান বাজতে লাগল। প্রিটি ওম্যান ছবিটির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিচার্ড গিয়ার এবং জুলিয়া রবার্ট। গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুজনে দুজনাকে জড়িয়ে ধরে নাচার সময় কানের পাশে হেলেনা গুণ গুণ করে গেতে লাগল- It must have been love, But it's over now, It was all that I wanted, Now, I'm living without...
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন rahman.mridha@gmail.com