বাইডেন কি পারবেন?
বাইডেন ও ট্রাম্প - ছবি সংগৃহীত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির গণতান্ত্রিক দেশ। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের দেশও বটে। একে বলা হয় দুনিয়ার সভ্য মানুষের দেশ। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকনের মতো মহান রাষ্ট্রনেতারা এদেশকে গণতান্ত্রিক ও মানবিক দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ পর্যন্ত ছোটখাটো বিচ্যুতি ছাড়া দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ দেশে পরিচ্ছন্ন গণতান্ত্রিক ও মানবিক ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছে। ট্রাম্পের আমলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চেতনা ব্যাহত হওয়ায় বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বিপুলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচনে সন্দেহাতীতভাবে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাইডেন বিজয়লাভ করা সত্ত্বেও তা মেনে নিতে অস্বীকার করে ট্রাম্প যে হীনম্মন্যতা দেখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তার দ্বিতীয় কোন নজির নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, সিনেটে বাইডেনের বিজয়ের প্রত্যায়নে বাধা সৃষ্টি করতে ক্যাপিটল হিলে হামলা করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ইতিহাসে কলঙ্কিত ও ধিকৃত হয়ে থাকবেন সে কি তিনি জানতেন না? এই অপকর্মে তার নিজ দলের ১২ জন সিনেটর জড়ানোর আভাস আগে থেকেই দিয়ে রেখেছিলেন এবং পরবর্তীতে তা বাস্তবে প্রমাণ করে নিজেদের নগ্ন চেহারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে গেলেন কোন নেপথ্য কল্যাণে?
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আলী রিয়াজ তার বিশ্লেষণে লিখেছেন, ‘ভায়োলেন্সটি ঘটানোর উদ্দেশ্য এমন থাকতে পারে যে, আমেরিকা ও তার বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক রাজনীতির নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরা। গণতন্ত্র এবং দায়িত্বশীল সরকারব্যবস্থার জন্য অত্যাবশ্যক ভিত্তি ও মতবাদগুলোকে বিরামহীনভাবে বিতর্কিত করে তুলতে ট্রাম্প ও তার আদর্শিক মিত্ররা ট্রাম্পের চলমান বাগ্নিতায় এই দুর্নামের ভাগীদার হয়েছিলেন। আলী রিয়াজ লিখেছেন, “২০১৫ সালে ট্রাম্প রাজনীতির মঞ্চে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে তার সমর্থকদের চাতুর্যপূর্ণ ও কুশলী বক্তব্য দ্বারা জানান দেয়া হচ্ছে ও সৃষ্টি করা হচ্ছে একটা আগ্রাসী মনোস্তত্ব¡ যা তাদের অসহিষ্ণু ও উত্তেজিত করে তুলেছে এমনভাবে যে, তাদের দেশকে ছিনিয়ে নিতে একটি কুটিল ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছে। পরে এই প্রতিক্রিয়াকে তিনি বুঝিয়েছেন ‘চক্র’ হিসাবে যা কিনা তাদের এক পর্যায়ে তথাকথিত মুভমেন্টে ক্যাপিটল হিলের দিকে যাত্রা করতে স্বতঃস্ফূর্ততা দান করেছে। গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি এখানে তার বিক্ষুব্ধ মানসিকতা প্রদর্শিত হয়েছে, সেই সাথে তিনি পদদলিত করেছেন সহিষ্ণুতার সংস্কৃতিকে এবং জাতিগত বিভক্তি জাগিয়ে তুলেছেন। গণতন্ত্রহীনতার বীজ তিনি বপন করেছেন; যে আক্রমণটা ছিল অঙ্কুরিত এই বিষবৃক্ষের ফলস্বরূপ।”
এই বিষবৃক্ষ অঙ্কুরিত হওয়ার পূর্ব ইতিহাসও যুক্তরাষ্ট্রেরই বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রবন্ধ নিবন্ধে প্রকাশিত হয়েছ। সেই সাথে আমাদের দেখা অভিজ্ঞতাও এখানে তুলে ধরা বোধ করি একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৯০ সালে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় কুয়েত ও সৌদি আরবের প্রতি মার্কিন মিত্রতা এবং পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত কুয়েত সৌদি আরব এবং ইরাকের তেল সম্পদের প্রতি সেই সময়কার মার্কিন প্রশাসনের লোলুপতা, তাদের নিজস্ব রাজনীতিতে ভিন্ন মাত্রা ও কৌশল গ্রহণে প্রলুব্ধ করে। কুয়েত সৌদি আরবের পক্ষ অবলম্বন করে ১৯৯০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ কর্তৃক পরিচালিত Operation in the Desert Storm নামক উপসাগরীয় যুদ্ধে। আমেরিকার জনগণের সায় না থাকায় সিনিয়র বুশ প্রেসিডেন্ট পদে এক মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। পরে ডেমোক্র্যাট দলীয় ক্লিনটন দুই টার্ম এবং রিপাবলিকান দলীয় জুনিয়র বুশের আরো আট বছর দায়িত্ব পালনের সময় সেখানকার থিংকট্যাংক ও পলিসি মেকাররা সরলপ্রাণ মার্কিনিদের মগজ ধোলাইয়ের নানাবিধ বুদ্ধিবৃত্তিক কূটকৌশল গ্রহণ করে।
জুনিয়র বুশের আমলে ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রান্ত হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, সেপ্টেম্বর ১১ তে টুইন টাওয়ারে হামলা করেছেন উসামা বিন লাদেন, আর সেই লাদেনই কি-না লুকিয়ে আছেন আফগানিস্তানে। তালেবানরা লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায়; ফলশ্রুতিতে আমেরিকার আফগানিস্তান আক্রমণ। তারও পাঁচ বছর আগে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। সে বছর এক তালেবান প্রতিনিধি দলকে হোয়াইট হাউজে ডেকে নিয়ে জানানো হয় যে, ‘কাসপিয়ান সাগরের তেল ও গ্যাস আমরা পাইপলাইন টেনে আফগানিস্তানের নিচ দিয়ে নিয়ে যেতে চাই। হয় তোমরা এই সোনার গালিচা প্রস্তাব গ্রহণ করো, নয়তো তোমাদের দেশ আমরা বোমার কার্পেটে ডুবিয়ে দেবো।’ [২২.১১.২০৬ নয়া দিগন্ত ‘শান্তির বিরুদ্ধে ছায়া লড়াই’ আলমগীর মহিউদ্দীন]। তালেবানরা তখন সরাসরি এই প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এভাবেই জুনিয়র বুশের আমলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছায়া লড়াইয়ের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয়। মার্কিনীদের কল্পিত জুজুর ভয় দেখানো হয়,
রিপাবলিকানরা জয়ী না হলে সন্ত্রাসীরা আমেরিকার উপকূলে উঠে আসবে এবং তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বই হুমকিগ্রস্ত হয়ে উঠবে। অভিন্ন এই কৌশলটিকে পুঁজি করেই বুশ-ট্রাম্পের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক চরম কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা।
অপ্রত্যাশিতভাবে ট্রাম্পের ক্ষমতার উন্মাদনা মার্কিনিদের ফেলে দেয় বিপাকে। সেই সাথে তার অতি আগ্রাসী চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড মার্কিন থিংকট্যাংক ও পলিসি মেকারদের সব কলাকৌশলকেই হুমকিতে ফেলে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবো, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৪ সালে SPARTA নগরবাসী এথেন্স দখল করে নেয়। বিজয়ী বাহিনী এথেন্স শাসনের জন্য ত্রিশ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করে। এথেন্সের শাসন ক্ষমতার উপর নিরঙ্কুশ অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে এই কমিশন খুব শীঘ্রই মূর্তিমান উৎপীড়ন ও স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই কমিশন কুখ্যাত হয়ে আছে Thirty Tyrant নামে। চোখের সামনে এই কমিশনের হাতে মানুষকে অত্যাচারিত হতে দেখেও প্লেটো মুখ খোলেননি। সুখের কথা, প্লেটোর Thirty Tyrant-এর মত যে বারোজন মার্কিন সিনেটর ক্যাপিটাল হিলের সহিংসতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মার্কিন সমাজে তাদের অবস্থান আজ অধঃপতিত ও ধিকৃত। এখানেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক শক্তির সৌম্য ও হিম্মত।
শাসন, বিচার ও মিডিয়ার স্বাধীনতা কিংবা জনগণের কথা বলার স্বাধীনতা ট্রাম্প খর্ব করতে না পারলেও আমেরিকার জনগণের ঐক্যচেতনায় এক ধরনের চিড় ধরাতে পেরেছেন। ট্রাম্প তার চার বছরের শাসনকালে যে অবস্থা সৃষ্টি করেছেন একে মি: আলী রিয়াজ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, How to address this schism will
also be a challenge for the media and civil society. Unfortunately, some mediaÕs roles in the past four years have been deeply disturbing. এখানে Schism হচ্ছে ‘ভিন্নমত কিংবা ভিন্ন ধারা ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়া, ভিন্নমত ও বিশ্বাস দ্বারা।’ ট্রাম্প মার্কিন সমাজে বিভাজন ও বর্ণবাদ নতুন করে উস্কে দিয়েছেন।
বাইডেন সরকার ও তার প্রশাসনের কাছে ট্রাম্প সৃষ্ট সমস্যা ও জঞ্জাল অপসারণই হবে এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ।