ভারতের আফগানিস্তান গেম, টার্গেট পাকিস্তান!
ইমরান খান ও নরেন্দ্র মোদি - ছবি সংগৃহীত
অনেক আগে থেকেই ‘ডবল গেম’ চালু ছিল। তবে ২০১৯ সালে এক গ্রেট ডবল গেম শুরু হয়। এই গ্রেট ডবল গেমের ফলাফল ২০২০ সালের শুরুতে সামনে আসার কথা ছিল, কিন্তু করোনাভাইরাস গ্রেট ডবল গেম থামিয়ে দিয়েছিল। ২০২১ সাল শুরু হতেই গ্রেট ডবল গেম আবার শুরু হয়েছে। ৩ জানুয়ারি, ২০২১ বেলুচিস্তানের মাচ এলাকায় ১১ হাজার শ্রমিককে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের টার্গেট বানানো হয়। আইএস ওই সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করেছে, এই অঞ্চলে ২০১৫ সালে যাদের জন্ম হয়েছে। আইএস এমনই এক সন্ত্রাসী হামলা ২০২০ সালের ২৫ মার্চ কাবুলে শিখদের একটি গুরুদুয়ারায় করেছিল; যেখানে ২৪ জনের বেশি নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছিল। ওই শিখরাও নিরস্ত্র ছিল এবং মাচে নিহত দরিদ্র সহস্রাধিক শ্রমিকও নিরস্ত্র। কাবুলের হামলায় একজন ভারতীয় নাগরিক মুহাম্মদ আনিস জড়িত ছিল, যার দলীয় নাম ছিল ‘আবু খালেদ হিন্দি’। কিন্তু মাচ হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের নাম এখনো প্রকাশ পায়নি। মাচ হামলার উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে, পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়া। সরকারের অযোগ্যতার কারণে সহস্রাধিক নিহতের লাশ কয়েকদিন পর্যন্ত দাফন করা যায়নি। এই সময় সরকার বলছিল, নিহত শ্রমিকদের মাঝে কিছু আফগান নাগরিক রয়েছে। আর আফগান সরকার তাদের লাশ চাচ্ছে। তবে পরবর্তীতে সবাইকেই পাকিস্তানে দাফন করা হয়। সহস্রাধিক শ্রমিক হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক আগুন উসকে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কা রয়েছে যে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এ ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে।
যদি এই ষড়যন্ত্রগুলো ব্যর্থ করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে গ্রেট ডবল গেম সফল হয়ে যাবে। তার মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। এই গ্রেট ডবল গেমের মাস্টার মাইন্ডকে খুঁজে বের করা মোটেও কঠিন নয়। শুধু এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে যে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতায় কার ফায়দা এবং কার ক্ষতি হবে? যদি জবাব পাওয়া না যায়, তাহলে লন্ডনের কিংস কলেজের ডিফেন্স স্টাডিজের শিক্ষক অবিনাশ পলওয়েলের My Enemy's Enemy গ্রন্থ পড়ুন, যার প্রচ্ছদে একটি ছবিতে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একে অপরের সাথে করমর্দন করছেন। অন্য অর্থে, নরেন্দ্র মোদি তার শত্রুর শত্রুর সাথে হাত মেলাচ্ছেন। আর তার শত্রু হচ্ছে পাকিস্তান এবং সেই ‘শত্রুর শত্রু’ আশরাফ গনি।
অবিনাশ পলওয়েল ভারতের নাগরিক। এ গ্রন্থে তিনি আফগানিস্তানে মোদির গ্রেট ডবল গেমকে বেশ স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন। মোদি একদিকে বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের ভুল থেকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টায় আছেন এবং অপরদিকে পাকিস্তানের পাখতুনদের মাঝে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত রয়েছেন। এই লক্ষ্যের জন্য তিনি আফগানিস্তানের পথ ধরে পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করছেন। এ গ্রন্থটি ২০১৭ সালে প্রকাশ করা হয়। গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে জানা যায়, মোদি সরকার আফগান তালেবানকে নিজেদের ফাঁদে আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। অবশ্য আশরাফ গনির সহায়তায় নামসর্বস্ব তেহরিকে তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) কয়েকজন সন্ত্রাসীকে ফাঁদে আটকে ফেলে, যাদের বেশির ভাগ আইএসের সদস্য হয়ে যায়। ২০১৯ সালে আমেরিকা ও আফগান তালেবানের মাঝে শান্তি চুক্তির সম্ভাবনা স্পষ্ট হলে মোদি ও আশরাফ গনি একটি গ্রেট ডবল গেম শুরু করেন। এই দুইজন বাহ্যিকভাবে শান্তি আলোচনায় সহায়তা করছিলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আলোচনাকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করছিলেন।
মোদি ওই আলোচনার সফলতায় এ জন্য ভীত ছিলেন যে, তালেবানের সাথে আলোচনার পর মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে গেলে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরেও সশস্ত্র সংগঠনের সাহস বেড়ে যাবে। আর এ কারণেই যখন আফগান শান্তি আলোচনা একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছল, তখন মোদি ৫ আগস্ট, ২০১৯ সালে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিল করেন এবং একটি বিবাদপূর্ণ এলাকা জোরপূর্বক দখল করে নেন। সেপ্টেম্বর, ২০১৯ মার্কিন সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আফগান তালেবানের সাথে আলোচনা বাতিল করার ঘোষণা দেন। কেননা, আফগান তালেবান ক্যাম্প ডেভিডে আশরাফ গনির সাথে বসে চুক্তিতে দস্তখতের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মোদি ও আশরাফ গনির ডবল গেম সত্ত্বেও ২৯ ফেব্র“য়ারি, ২০২০ সালে কাতারে আমেরিকা ও তালেবানের মাঝে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা পরবর্তী ১৪ মাসে নিজেদের সেনা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেবে এবং কাবুল সরকার তালেবানের পাঁচ হাজার বন্দীকে মুক্তি দেবে। এই চুক্তির পর আন্তঃআফগান আলোচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল।
শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর হওয়ার পর আফগানিস্তানে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রতিটি দিক পর্যালোচনা করা উচিত। দূর থেকে দেখলে দেখা যাবে, শান্তি চুক্তির পর আফগানিস্তানে রক্তপাত বেড়ে গেছে। কিন্তু যখন কাছ থেকে বাস্তবতাকে দেখা হবে, তখন জানা যাবে, এক দিকে কাবুল সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে, অপর দিকে, তালেবানের বিরুদ্ধে বিমান হামলা এবং আইএসের স্থল হামলা মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দাবি সঠিক নয় যে, আফগান তালেবানের মাঝে শান্তি চুক্তি নিয়ে মতভেদ আছে। তালেবান কাতারের দোহা চুক্তির খসড়া আফগানিস্তানে তাদের শূরা প্রধানের কাছে পাঠিয়েছিল। তিনি সব ফিল্ড কমান্ডারের সাথে পরামর্শ করেন। যখন সবাই একমত হন, তখন মোল্লা হায়বাতুল্লাহ আখুন্দ একটি কমিটিকে বলেন, শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এই চুক্তির পর্যালোচনা করা হোক। কমিটি পূর্ণাঙ্গরূপে পর্যালোচনা করার পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০২০ সালে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় তালেবান অস্ত্রবিরতি পালন করে এবং দেশজুড়ে এটি পালিত হয়। অস্ত্রবিরতিকালীন হামলা হলে সেটা আইএসের পক্ষ থেকে হয়েছে, তালেবানের পক্ষ থেকে নয়। এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, কাবুলের উত্তরে শাকারদারা অঞ্চলে আইএসকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ব্যবস্থা কে করে দিয়েছে। শুরুতে আমেরিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল এ মর্মে, তারা গোপনে আইএসকে সহযোগিতা করছে।
কিন্তু আমেরিকা আইএসের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডারকে লক্ষ্য বানিয়ে এই অভিযোগ খণ্ডন করার চেষ্টা করেছে। তালেবান যখন নানগারহার ও কুনার প্রদেশে আইএসকে পরাজিত করল, তখন আইএসের দাঙ্গাবাজদের আফগান বাহিনী আশ্রয় দেয়। শান্তি চুক্তিকে সফল করার জন্য তালেবান যতটুকু নমনীয়তা প্রদর্শন করেছে, তা কল্পনাতীত। মোল্লা আবদুল গনি বারাদার থেকে নিয়ে আনাস হাক্কানি পর্যন্ত তালেবানের আলোচক দলের বেশির ভাগ সদস্য অনেক বছর কারাবন্দী ছিলেন। তারা আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজেদের প্রিয়জনদের কোরবান করেছেন। আনাস হাক্কানির চার ভাই ও ফুফু আমেরিকানদের হাতে শহীদ হন। তা সত্ত্বেও আনাস হাক্কানি শান্তি চুক্তির অংশীদার হন এবং তালেবান তাদের অন্যতম সাবেক অস্ট্রেলীয় বন্দী টিমোথি উইকসকেও দোহা চুক্তিতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। হাক্কানি নিজে এয়ারপোর্ট গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানান। তালেবান দোহা চুক্তিকে সফল করার জন্য যা করার ছিল, তাই করেছে। ষড়যন্ত্র যা হয়েছে, তা মোদি ও আশরাফ গনির পক্ষ থেকে হয়েছে। আশা করা যায়, বাইডেনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শান্তি আলোচনা আরো এগিয়ে যাবে। কেননা, এ আলোচনা ট্রাম্প শুরু করেননি, এটা ওবামার সময় শুরু হয়েছিল। যারা আফগান শান্তি চুক্তির ফলাফল দৃশ্যমান না হওয়ার জন্য তালেবানের ওপর দায় চাপাচ্ছেন, তারা বলুন, আইএসকে তালেবানের বিরুদ্ধে কে দাঁড় করিয়েছে? শত্র“র শত্র“র গ্রেট ডবল গেমের উদ্দেশ্য হলো- এই চুক্তিকে ব্যর্থ করা।
দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)