সাহাবায়ে কেরামের ১০ গুণ

আমিরুল ইসলাম লুকমান | Mar 25, 2021 04:58 pm
সাহাবায়ে কেরামের ১০ গুণ

সাহাবায়ে কেরামের ১০ গুণ - ছবি সংগৃহীত

 

নবী করিম সা:-এর পরে এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম হলেন সাহাবায়ে কেরামের প্রজন্ম। কুরআন ও সুন্নাহর পর তাদের কথা ও কর্ম উম্মতের জন্য দলিল। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র মানুষের জন্য তারা সত্যের মাপকাঠি, হেদায়েতের আলোকবর্তিকা। নবুয়াতের দাওয়াত গ্রহণ ও প্রচারের জন্য নবী করিম সা:-এর সাথী হিসেবে আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামের জামাতকেই নির্বাচন করেছেন। তাদের প্রতি নিজের রাজি-খুশির কথা স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য সব রকমের গুণাবলি তাদের ভেতর বিদ্যমান ছিল পূর্ণমাত্রায়। সর্বপ্রকার ভালো গুণের বাস্তবায়নের কারণেই কাফেররা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-

দৃঢ় ইমান ও বিশ্বাস : সাহাবাদের ইমান সম্পর্কে কুরআনে অসংখ্য আয়াত বর্ণিত হয়েছে। নবী সা: জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহাবায়ে কেরাম রা: ইমানের শক্তি প্রদর্শন করেছেন। বদর যুদ্ধসহ অন্যান্য যুদ্ধে তাদের তেজোদ্দীপ্ত ইমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শুধু সূরা আনফালেই প্রায় ২০ স্থানে সাহাবিদের ইমানের কথা গর্বের সাথে আলোচিত হয়েছে। অন্যান্য বহু স্থানে সাহাবিদের ইমানের বিভিন্ন অবস্থা আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন। পবিত্র কুরআনই সাহাবিদের দৃঢ় ইমানের প্রতিষ্ঠিত দলিল। পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য যেসব মর্ম ও আদেশ, আকিদা ও আদর্শ নিয়ে এসেছিল, সাহাবায়ে কেরাম রা: সেসবের ওপর পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সেসবের ওপর পূর্ণমাত্রায় আমল করেছেন। ঘোষিত হয়েছে- ‘ইমানদারদের ভেতর এমন লোক আছে, যারা কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটায়নি।’ (সূরা আহজাব-২৩)

ইবাদত ও ইখলাস : আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির আশায় সাহাবায়ে কেরাম রা: বেশির ভাগ সময় নানা প্রকার ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তারা একমাত্র আল্লাহর জন্যই এসব ইবাদত করতেন। ঘুণাক্ষরেও অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। জান্নাত লাভ, আল্লাহর প্রিয় হওয়াই ছিল তাদের অভিপ্রায়। নিজেদের সব কাজে নিয়তকে সঠিক করে ফেলেছিলেন। ফলে তাদের পুরো জিন্দেগিই ইবাদতে পরিণত হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি তাদেরকে দেখবে কখনো রুকুতে, কখনো সিজদায়, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি সন্ধানে রত। তাদের আলামত তাদের চেহারায় পরিস্ফুট, সিজদার ফলে।’ (সূরা ফাতহ-২৯)

ইখলাসের সাথে ইবাদত সম্পাদনার প্রতি তারা সীমাহীন আগ্রহী ছিলেন। তারা জানতেন, ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত ইখলাস। ইখলাসের মাধ্যমে মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক গভীর হয়। আল্লাহর প্রিয় হওয়ার বাসনাই তারা নিজেদের সব কাজ ও কথা সংরক্ষণ করেছিলেন। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তারা উদাহরণ হিসেবে বরিত হয়ে আছেন। ইখলাসকে সীমাহীন গুরুত্ব দেয়ার কারণেই জাফর ইবনে আবু তালেব রা:-এর কথা শুনে নাজ্জাশির হৃদয় বিগলিত হয়ে গিয়েছিল। নিজ থেকেই সাহাবিদের হাবশায় অবস্থানের আবেদন করেছিলেন আর কুরাইশদের আবেদন করেছিলেন প্রত্যাখ্যান। মুসআব ইবনে উমায়ের রা:-এর ইখলাসের বরকতেই আউস ও খাজরাজের হাজার হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

নবী করিম সা:-এর সান্নিধ্য অর্জনের প্রতিযোগিতা : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথমে ইমান এনেছে এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের সবার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে।’ (সূরা তওবা-১০০) সব মুহাজির ও আনসার সাহাবি প্রতিযোগিতায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা সর্বদায় নবী করিম সা:-এর সাহচর্য লাভে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতেন।

আল্লাহর রাস্তায় হিজরত : ইমান গ্রহণ ও ইমান প্রচারের কারণে সাহাবায়ে কেরাম কুরাইশ কাফেরদের পক্ষ থেকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সুদীর্ঘ ১৩ বছর। এরপর আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের আদেশ আসে। আদেশ পালনার্থে তারা মদিনা ও হাবশায় হিজরত করেন। কুরাইশদের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণের আশায় নিজেদের জন্মভূমি, প্রিয় পরিবার, অর্জিত সম্পদ ও বাড়িঘর পেছনে ফেলে তারা অনিশ্চিত পথে যাত্রা করেন। হিজরতের কারণেও আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামের প্রশংসা করেছেন।

সৎ কাজের আদেশ ও খারাপ কাজে বাধা প্রদান : ঘোষিত হয়েছে, ‘(হে মুসলিমগণ) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা পুণ্যের আদেশ করে থাকো ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাকো এবং আল্লাহর প্রতি ইমান রাখো।’ (সূরা আলে ইমরান-১১০) এই আয়াতটি সাহাবায়ে কেরামসহ সমগ্র মুসলিম উম্মতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। বিভিন্ন নীতিমালার আলোকে সাহাবিরা জীবনভর এই আদেশের ওপর আমল করেছেন পূর্ণাঙ্গরূপে। যখন জবানের প্রয়োজন হয়েছে, জবান দিয়ে আর যখন জীবন ও সম্পদের প্রয়োজন হয়েছে, তখন জীবন ও সম্পদ দিয়ে জিহাদের মাধ্যমে। শুধু এতটুকু নয়, তারা পরবর্তী প্রজন্ম তাবেয়িদেরও এসব গুণাবলি শিক্ষা দিয়েছেন।

শত্রুদের সাথে জিহাদ : আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘রাসূল এবং যে সব লোক তার সাথে ইমান এনেছে তারা নিজেদের জান-মাল দিয়ে জিহাদ করেছে। তাদেরই জন্য সর্বপ্রকার কল্যাণ এবং তারাই কৃতকার্য।’ (সূরা তওবা-৮৮) সাহাবায়ে কেরাম তাদের জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছেন। আবুবকর, উমর, উসমান, আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা: প্রমুখ সাহাবি জীবনের সাথে সাথে সম্পদ দিয়েও জিহাদের ময়দানে অবদান রেখেছেন।

সত্যবাদিতা : আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথে থাকো।’ (সূরা তওবা-১১৯) সাহাবিরা আল্লাহর আদেশ পালনে এবং শত্রুদের সাথে জিহাদে পূর্ণ সত্যবাদী ছিলেন। সত্যবাদীদের উত্তম উদাহরণ আবুবকর রা:। মেরাজের রাতের ঘটনার বিষয়ে নবী করিম সা:কে সত্য বলায় তাকে নবী সা: মহাসত্যবাদী উপাধি দেন।

কাফেরদের সাথে কঠোরতা এবং মুসলমানদের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাঁর সাথে যারা আছে, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপসের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র।’ (সূরা ফাতহ-২৯) সাহাবিদের সমস্ত চেষ্টা ও কঠোরতার সবটুকু ব্যয় করতেন আল্লাহ ও ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে। এর বেশির ভাগ বাস্তবায়ন ঘটত যুদ্ধের ময়দানে ও লড়াইয়ের সময়। আর পরস্পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সময় থাকতেন উদার ও হৃদয়বান।

অপরকে প্রাধান্য দেয়া : সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার চেয়ে অপরের প্রয়োজন পূর্ণ করার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতেন। এটি তাদের স্বভাবগত অভ্যাস ছিল। অপরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল। ঘোষিত হয়েছে, ‘মুহাজিরদেরকে তারা নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে।’ (সূরা হাশর-৯)

মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী : সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের সব কাজ ও কথায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন। শরিয়তের আদেশ-নিষেধের বাইরে কখনোই বাড়াবাড়ি ও শিথিলতা প্রদর্শন করতেন না। বর্ণিত হয়েছে, ‘এভাবেই আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি।’ (সূরা বাকারা-১৪৩)

জ্ঞানার্জন : সাহাবায়ে কেরাম রা: নবী সা: থেকে শরিয়তের সর্ব বিষয়ের জ্ঞানার্জন করেছেন। ওহির জ্ঞানের আলোয় নিজেদেরকে আলোকিত করেছেন পরিপূর্ণভাবে। নিজেদেরকে অলংকৃত করেছেন নবীর শিক্ষার দরস থেকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তারা ভালো করেই বোঝে তোমার প্রতি তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা নাজিল করা হয়েছে তা সত্য।’ (সূরা সাবা-৬)

লেখক : খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us