দুই ভূখণ্ডের দু’টি মজার রান্না

কাজী জহিরুল ইসলাম | Mar 22, 2021 01:35 pm
দুই ভূখণ্ডের দু’টি মজার রান্না

দুই ভূখণ্ডের দু’টি মজার রান্না - ছবি সংগৃহীত

 

কুরুতব

হঠাৎ হাতের গ্লাস অনেক উঁচুতে তুলে নূরগুল বলে ওঠে, নাজদারোবিয়া। অরহুসের এই অনিন্দ্য সুন্দর সন্ধ্যায় যখন মুক্তি এবং আমি ডুবসাঁতার কাটছি তখনই কাকতালীয়ভাবেই একটি ফোন আসে ডেনমার্ক থেকে। কোপেনহেগেন থেকে কল করেছেন শিল্পী রুহুল আমিন কাজল। এই রকম কাকতালীয় ঘটনা আমাকে বেশ আনন্দ দেয়। কাজল ভাইয়ের সাথে এর আগে আমার কথা হয়নি, দুয়েকবার ম্যাসেঞ্জার-চ্যাট হয়েছে। শিল্পী কাজী রকিব এই অদ্ভুত এবং দার্শনিক মানুষটির কথা আমাকে বলেন। কেন তাকে অদ্ভুত বলছি তা আরেক দিন লিখব। আজ শুধু এইটুকু বলি, তিনি আশির দশকে ‘ডেমোক্রেজি’, কিলিজিয়ন’ এবং ‘ইভিলাইজেশন’ এই শব্দত্রয় উদ্ভাবন করেন। তিনি শুধু শব্দ তিনটি তৈরিই করেননি, ক্রেজি গণতন্ত্র, ধর্মের নামে কিলিং এবং সভ্যতার নামে ভণ্ডামি তুলে ধরেছেন তার অঙ্কিত চিত্রকর্মগুলোয়। সেইসব চিত্রকর্মের একাধিক প্রদর্শনীও করেন ঢাকা এবং অন্যান্য জেলায়।

১৯৯৯ সালের সামারে এক মাস আমরা ডেনমার্কের অরহুস এবং কোপেনহেগেনে কাটিয়েছি। মুক্তি আরো আগেই গিয়েছিল, পড়ছিল অরহুস স্কুল অব আর্কিটেকচারে, তাজিকিস্তানের নূরগুল ছিল ওর সহপাঠী। ’৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে, স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিকগুলোর মধ্যে সবশেষে, সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে, পাহাড় ঘেরা ছোট্ট এই দেশটি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। সেই থেকে গৃহযুদ্ধ, ক্ষমতাসীনদের ধরপাকড় চলছে। দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়ানোর গ্লানির কথাও আমাদের জানায় নূরগুল।

আমাদের ছেলে অগ্নি এবং আইরিশ পুত্রবধূ ব্রিজিত ফ্লোরিডা থেকে এক মাসের জন্য বেড়াতে এসেছে। ব্রিজিতের পরিবার থাকে নিউ জার্সিতে, ও কিছুদিন আমাদের বাসায়, কিছুদিন নিউ জার্সিতে থাকছে। আজ ব্রিজিত নিউ জার্সি ফিরে যাচ্ছে। তাই গতকাল সন্ধ্যায় আমরা একসাথে ডিনার টেবিলে বসি। মুক্তি বেশ হুলুস্থুল খাবারের আয়োজন করে ফেলে, অধিকাংশই ছিল কাবাব। ডায়নিং টেবিলে আমাদের রাজ্যের গল্প। আট বছরের পুরনো স্পেনিশ রেড ওয়াইনের বোতল খুলে যখন আমরা চিয়ার্স করার জন্য গ্লাস উঁচুতে তুলেছি তখনই মুক্তি বলে, নাজদারোবিয়া। আর সাথে সাথেই যেন মাটির ব্যাংক ভেঙে একগাদা খুচরো পয়সার মতো অরহুসের সব স্মৃতি হুড়মুড় করে নেমে আসতে শুরু করে।

আলোচনাটি যখন আমাদের মার্চ-এপ্রিলের রান্নার রুটিনে ফিরে যায় তখন আমি ক্রিয়েটিভ হয়ে উঠি। আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়, আমরা প্রতিদিন পৃথিবীর কোনো-না-কোনো একটি দেশের ডিশ রান্না করে খাবো। এভাবে ১৯৭টি দেশের একটি করে ডিশ রান্না করতে করতে পুরো পৃথিবীর খাদ্য সংস্কৃতির সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে যাবে। সবার আগে সায় দেয় ব্রিজিত। ইটস অ্যা গ্রেট আইডিয়া। অগ্নি কিছুটা ভয় পেয়ে যায়, হ্যাং অন, আর ইউ গোয়িং ব্যাক টু কুকিং স্কেডিউল? আমি কিন্তু রান্না করতে পারব না। এরপর ছেলের মা আমার দিকে অন্য একদৃষ্টিতে তাকায়। এই দৃষ্টিটি আমার খুব চেনা। আইডিয়াটা ভালো কিন্তু রান্নাটাও তোমাকেই করতে হবে।
আমি নিজেই ঘোষণা করি, তোমাদের কিছু করতে হবে না, আমিই রোজ রান্না করব। এবার বলো, কাল কোন দেশের খাবার চাও? টেবিলে যখন নূরগুল, কোন দেশ আবার, তাজিকিস্তান। ব্যাস, সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, প্রথম ডিশ হবে তাজিকিস্তানের।

শুরু হয়ে গেল অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি। তাজিকিস্তানের দুটো জাতীয় খাবার হলো প্লভ এবং কুরুতব। প্লভ অধিক জনপ্রিয় প্রতিবেশী দেশ উজবেকিস্তানে, কুরুতবই তাজিকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয়, ট্রেডিশনাল এবং জাতীয় ডিশ।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই কাজে লেগে যাই। গোল গোল লাল টমেটোগুলো কাটতে কাটতে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উঁচু, নাদুশ নুদুশ নূরগুলের গোলগাল মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। যেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে নূরগুল হাস্যোজ্জ্বল মুখে একের পর এক বলে দিচ্ছে কিভাবে তৈরি করব কুরুতব।

কুরুতবের মূল উপকরণ হচ্ছে ফাতির এবং কুরুত। কুরুত থেকেই কুরুতব। ফাতির হচ্ছে তাজিকিস্তানের বিশেষ রুটি, যেটি আমাদের নানরুটির প্রায় কাছাকাছি। কুরুত হচ্ছে বিশেষভাবে তৈরি দইয়ের শুকনো গোল্লা। গোল্লাগুলো রসগোল্লার সমান হয় সাধারণত। এই গোল্লা পানিতে গুলিয়ে তাতে টোস্ট করা ফাতির ছোটো ছোটো করে ভেঙে ছেড়ে দিতে হয়। এর ওপরে পিঁয়াজ, টমেটো, শসা, পিঁয়াজপাতা, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ কুচি কুচি করে কেটে ছড়িয়ে দিতে হয়। কুরুত যেহেতু পাবো না, ন্যাচারাল দই দিয়েই কাজ চালাতে হবে। মূল কুরুতবের কিছুটা ইম্প্রোভাইজড কুরুতবই আমাকে বানাতে হচ্ছে।

কুরুতব তৈরির এবং পরিবেশনের জন্য দরকার একটি মাটির পাত্র। আমার কাছে মাটির শানকি আছে কিন্তু ছয়জনের খাবার তৈরির জন্য বড়সড় একটি পাত্র চাই। মধ্যএশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারুকার্যখচিত একটি সিরামিকের বড় পাত্র আছে আমাদের। সেটিই নিয়ে নিলাম।

দইয়ের ঘন তরলের ওপর কুড়মুড়ে রুটির টুকরো ছেড়ে দিয়ে নানা রঙের সবজিকুচি ছড়িয়ে দিলাম। এর ওপরে বাদাম, কালোজিরা, পনিরের গুঁড়ো দিলাম। চারটি সেদ্ধ ডিম কিউব করে কেটে ছড়িয়ে দিলাম। একটি পাত্রে জলপাইয়ের তেল ঢেলে তাতে এলাচি, লবঙ্গ, নুন দিলাম। তেল ফুটিয়ে কুরুতবের পাত্রে ঢেলে দিলাম।
পুরো রন্ধন প্রক্রিয়াটির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি যেন হাঁটছিলাম দুশানবের পাহাড়ে পাহাড়ে। আয়তনের দিক থেকে তাজিকিস্তান বাংলাদেশের সমান, ৫৫ হাজার ২৫১ বর্গমাইল, কিন্তু দেশটির ৯৩ শতাংশই পাহাড়-পর্বতে ভরা। পৃথিবীর দরিদ্রতম এই দেশে মাত্র ৯১ লাখ লোকের বাস। স্বাধীনতা-উত্তর লাগাতার গৃহযুদ্ধে গৃহহারা হয়েছে প্রায় ১২ লাখ মানুষ।

তাজিকিস্তানের জাতীয় খাবার কুরুতব বানাতে গিয়ে হয়তো তা পুরোপুরি তৈরি করতে পারিনি কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৯১ লাখ মানুষের দেশটিকে কিছুটা হলেও চেনার সুযোগ পেয়েছি।
জানি না, আজ একুশ বছর পরে আমাদের বন্ধু নূরগুল এখন কেমন আছে, ও কি এখনো দেশ থেকে দেশে, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমার তৈরি করা কুরুতব আজ নূরগুলকেই উৎসর্গ করলাম, নাজদারোবিয়া।

হলিসউড, নিউইয়র্ক, ৫ ডিসেম্বর ২০২০।
দরোওয়েত

তাজিকিস্তানের নিরামিষ ডিশ কুরুতব আমার মেয়ে জল একদমই পছন্দ করেনি। ওর পছন্দের খাবারের তালিকায় প্রথম হচ্ছে আমিষ-গোশত অথবা ডিম। বাড়ির স্বাস্থ্যসচেতন অন্য সদস্যরা অবশ্য কুরুতবের প্রশংসা করেছে। আমাদের এই রান্না রান্না খেলার দ্বিতীয় দেশ হচ্ছে ইথিওপিয়া, দেশ নির্বাচন করেছেন আমার স্ত্রী মুক্তি। ইথিওপিয়ার খুব জনপ্রিয় এবং জাতীয় খাবার দরোওয়েত। দরোওয়েত মুরগির কারি, রান্না করতে হয় প্রথাগত আবিসিনীয় প্রক্রিয়ায়।

আবিসিনিয়া কখনোই পরাধীন জাতি ছিল না, কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইথিওপিয়াকে উপনিবেশ বানাতে পারেনি, এই গর্ব ওদের চোখে মুখে টগবগ করে ফোটে। শুধু কি তাই, আমেরিকার বিখ্যাত কফিশপ স্টারবাক্স ইথিওপিয়াকে কফির রয়েলিটি দেয় কারণ ইথিওপিয়া হচ্ছে সভ্যতার সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় কফির জন্মস্থান।
আমরা ছেলেবেলায় টেলিভিশনে খরাক্রান্ত ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষের ছবি দেখেছি, হাড় জিরজিরে শিশুদের সেইসব ছবি চোখের সামনে বহুদিন অব্দি ছিল। ২০০৯ সালে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় গিয়ে অবশ্য আমার সেই ধারণা বদলে গেছে। দারিদ্র্য আছে বটে তবে মানুষের মধ্যে সততা এবং কঠোর পরিশ্রম করার মাসিকতা গড়ে উঠেছে, যা ইথিওপিয়াকে দরিদ্রতম দেশের অপবাদ থেকে রেহাই দিয়েছে অনেক আগেই। আদ্দিসের জাদুঘরে গিয়ে যখন লুসির সাথে দেখা হলো তখন এই দেশটি সম্পর্কে আমার সব নেতিবাচক ধারণাই প্রায় দূর হয়ে গেছে। এখানে শুধু সভ্যতার প্রধান পানীয় কফিই জন্মায়নি, আজ থেকে ৩০ লাখ বছর আগে এই ভূখণ্ডেই মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছিল পৃথিবীর প্রথম মানুষ, আমাদের আদি মাতা লুসি।

আজ আমি সেই দেশের প্রথাগত খাবার দরোওয়েত রান্না করব। প্রধান উপকরণ মুরগির গোশত ছাড়াও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বের্বেরে, নিতের কিবেশ এবং লাল পিঁয়াজ লাগবে। পিঁয়াজ তো ঘরেই আছে। বের্বেরে এবং কিবেশ কোথায় পাই? বের্বেরে হচ্ছে ইথিওপীয় মিশ্র-মশলা। এতে আছে পাপরিকা, ঝালমরিচ, আদা, রসুন, তুলসী পাতা, ইথিওপীয় এলাচি, গোলমরিচ, মেথির পাতা, রু এবং বিটার শ্রাব। এসবের পরিমাণ মত মিশ্রণই হলো বের্বেরে। নিতের কিবেশ বিশেষভাবে তৈরি করা ইথিওপীয় মাখন। আজওয়ান, কালিজিরা, এলাচি এবং অরেগানো দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা মাখনই নিতের কিবেশ। এই দুটি উপকরণ সংগ্রহের জন্য গত চার-পাঁচদিন নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন দোকানে দোকানে ঘুরেছি, অনলাইনে খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি। অগত্যা নিজেই বের্বেরে এবং কিবেশ ঘরে বানিয়ে নিলাম। জানি পুরোপুরি হয়তো হয়নি কিন্তু আমি যে দমে যাইনি নিজের এই উদ্যমকে নিজেই বাহবা দিয়ে রান্নায় নেমে পড়ি।

মুরগির গোশতগুলো লেবুর রস এবং নুন মেখে এক ঘণ্টা মেরিনেট করে নিই। বড় বড় ছয়টা পিঁয়াজ কেটে ব্লেন্ড করে নিয়েছি। ব্লেন্ড করা পিঁয়াজ একটি পাত্রে কুড়ি মিনিট তাপিয়ে জল শুকিয়ে নিই। পিঁয়াজ শুকিয়ে এলে জলপাইয়ের তেল এবং পরিমাণ মত নুন দিই। মিনিট দশেক পরে ঘরে তৈরি দেড় কাপ বের্বেরে ঢেলে দিই এবং একটু পানি ঢালি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিশ্রণটা লাল টকটকে হয়ে ওঠে। তখন নিতের কিবেশ এক কাপ ঢেলে দিই।
নভো আমাকে সাহায্য করতে ছুটে আসে। দরোওয়েতের জন্য সেদ্ধ ডিম লাগবে। নভোকে বলি ছয়টা ডিম সেদ্ধ করতে। দরোওয়েতের মিশ্রণ কুড়ি মিনিট জাল করতে হবে। ডিম সেদ্ধ এবং মিশ্রণ জাল হতে থাকুক। ততক্ষণে ইথিওপিয়ার আরো কিছু গল্প করা যাক।

কসোভোর জাতিসঙ্ঘ মিশনের প্রধান হিসাবরক্ষক ছিলেন ইথিওপীয় নাগরিক ডেস আমানু। পঞ্চাশোর্ধ ছোটোখাটো গড়ন, ম্যালনারিশ শিশুর মতো চিকন চিকন হাত পা। অথচ এই ভদ্রলোকের গায়ে অসুরের শক্তি। তিনি ছিলেন আমার বস। হিসাব বিভাগে আমরা প্রায় ৫০ জন স্টাফ ছিলাম। তার কড়া হুকুম প্রতি শনিবারে তার সাথে ফুটবল খেলতে যেতে হবে। অফিসের কাজে ভদ্রলোক ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে ধীরগতির মানুষ। একটা চিঠি তার টেবিলে চার-পাঁচ দিন স্বাক্ষরের জন্য পড়ে থাকত। অফিসের সবাই তার ওপর এসব বিষয়ে ছিল মহাবিরক্ত অথচ এই লোক খেলার মাঠে নবীন বাছুরের মতো ছোটেন। দেড় দুই ঘণ্টা ছোটার পরেও তার কোনো ক্লান্তি নেই। আমরা চলে গেলে তিনি অন্য গ্রুপের সাথে টেনিস খেলতে দাঁড়িয়ে পড়েন। ছুটির দিনে খেলার জন্য তার এই দাবড়ানি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। ডেপুটি চিফ ক্যামেরুনের স্যামুয়েল কাসাম্বা, ব্রিটিশ নাগরিক মাইকেল ওয়ার্ড এবং আমি বিদ্রোহ করি এবং কয়েক মাসের ব্যবধানে আমরা তিনজনই চাকরি হারাই। পরবর্তীতে আমি আরো অনেক ইথিওপীয় সহকর্মী পেয়েছি সবাই দাফতরিক কাজে অতিশয় মন্থর।

দরোওয়েত রান্নার প্রক্রিয়াটিও মন্থর। পুরো রান্নাটি করতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। কুড়ি মিনিট পরে পিঁয়াজ এবং মসলা একে অন্যের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলিঙ্গনে যখন লিপ্ত হয়েছে তখন ওদের দেহ থেকে তৈলাক্ত নির্যাস বেরিয়ে উঠে এসেছে মিশ্রণের ওপর। মেরিনেট করা মুরগির গোশত লেবুর খোসা দিয়ে ঘষে ঘষে সাফ করে শুকিয়ে নিয়েছি। শুকনো গোশতগুলো এখন মসলার ওপর বিছিয়ে দিই। পাত্রটি ঢেকে চুলার আঁচ কমিয়ে রেখে দিতে হবে ৪০ মিনিট।
হাওয়াশ নদীর তীরে লুসির পায়ের চিহ্ন খুঁজতে খুঁজতে দেখছিলাম চার লাখ ৩৭ হাজার বর্গমাইলের সুবিশাল ঘন সবুজ এক দেশ। ২০০০ সালের জুলাই মাসে ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া দ্বন্দ্বের কারণে জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশন প্রতিষ্ঠা হয়। শুরুতে বিভিন্ন মিশন থেকে দ্রুত স্টাফ ডেপ্লয় করা হয়। তিন মাসের অ্যাডভান্স মিশন করে এসে ফ্রাঁসোয়া বলেন, কাজী স্বর্গ থেকে ঘুরে আসো। আমি বিস্তারিত জানতে চাইলে ও বলে, তোমরা মুসলমান পুরুষেরা তো মৃত্যুর পরে হুর পাওয়ার জন্য দিনরাত খোদার কাছে কান্নাকাটি করো। আদ্দিস আবাবায় যাও, রাস্তায় রাস্তায় হুরপরী ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাপমাত্রাও বেহেশতের। না গরম, না শীত। যদি একটু আমহারিক বলতে পারো তাহলে তো স্বর্গটা তোমারই।

নভো এসে ডিমের খোসা ছড়িয়ে দেয়। ৪০ মিনিট পর লাল টকটকে দরোওয়েতের গ্রেভির ওপর ডিমগুলো ছেড়ে দিই। মুক্তি এসে বার দুয়েক উঁকি দিয়ে দেখে যায়, সত্যি সত্যিই খাওয়ার মতো কিছু হচ্ছে কি না। অগ্নি বন্ধুর সাথে ডিনারে যাবে, কাজ থেকে উঠে চুলার কাছে এসে বলে, দারুণ ঘ্রাণ আসছে তো। আমি বলি, ডিনার কি বাতিল করবে নাকি? ‘নো ওয়ে’ বলেই সে ওপরে উঠে যায়। ১০ মিনিট পর ফিরে এসে বলে, আব্বু ডিনার তৈরি হতে আর কতক্ষণ লাগবে? ঠিক করেছি রেস্টুরেন্টে যাবো না। অগ্নির এই সিদ্ধান্তে আমি যতটা খুশি ওর মা তার চেয়ে শতগুণ। খুশি হয়ে মুক্তি টেবিল সাজাতে শুরু করে।

দরোওয়েত খেতে হয় ইথিওপিয়ার বিশেষ রুটি এঞ্জেরা দিয়ে। তেফ নামক বিশেষ এক শস্যের গুঁড়ো পানিতে গুলিয়ে কয়েক দিন রেখে দিয়ে ফার্মেন্টেশন করতে হয়। সেই ফার্মেন্টেড আটা দিয়ে বানানো রুটির নাম এঞ্জেরা। খেতে কিছুটা টক টক লাগে।

এঞ্জেরার ব্যবস্থা করা বেশ কঠিন কাজ। ইথিওপীয় সহকর্মী দেগেমু আন্দেতাকে ফোন করেও কোনো সুরাহা হয়নি। দেগেমু নিজেই খোদ আদ্দিস থেকে এঞ্জেরা আনিয়ে খায়। অগত্যা বাংলা রুটি ভাজতে শুরু করি।
ইথিওপিয়ার দরোওয়েতের সাথে বাংলাদেশি রুটির ডিনার। খাওয়ার পরে আজ জলের মুখি হাসি। তাম্বুলরসিক আমি যখন পানে চুন ঘষছিলাম আর সুগন্ধি জর্দা নেয়ার জন্য কপারের কৌটা খুলছিলাম জল তখন খাওয়া শেষ করে উঠে এসে আমাকে চুমু দিয়ে ওর সন্তুষ্টি জানিয়ে গেল।
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক, ৯ ডিসেম্বর ২০২০।

কাজী জহিরুল ইসলাম সাহিত্যকর্মে যেমন সুদক্ষ তেমনই রন্ধনশিল্পেও তার হাতযশ তর্কাতীত।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us