ইমরান খানের কাছে প্রশ্ন

হামিদ মীর | Mar 21, 2021 04:09 pm
ইমরান খান

ইমরান খান - ছবি সংগৃহীত

 

বিপরীত মতাদর্শের সাথে সমঝোতাকে ‘কপটচারিতা’ বলা হয়। যে ব্যক্তি তার জীবনকে সহজ করার জন্য বিপরীত মতাদর্শের সাথে সমঝোতা করে, সে সাময়িক সফলতা লাভ করলেও তাকে মুনাফিক বা কপটচারী বলা হয়। ওই ব্যক্তি যদি কোনো দফতর বা দলের প্রধান হয়ে যান, তাহলে সম্পূর্ণ দলটাই কপটচারী হয়ে যায়। একটু ভাবুন, যখন কোনো রাষ্ট্র বহু বিষয়ে বিপরীত মতাদর্শের সাথে সমঝোতা করে, তখন ওই রাষ্ট্রে বসবাসকারী পুরো জাতি কপটচারিতা থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে? বেশি দূর যাবেন না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রতি দৃষ্টি বুলিয়ে নিন। ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ বলা হয়। ভারতের সংবিধান সেক্যুলার। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ। সেক্যুলার ভারতে অন্যতম হিন্দু উগ্রপন্থী দল বিজেপির সরকার বিদ্যমান, যারা ‘ভারতের জনক’ মহাত্মা গান্ধীর খুনি নাথুরাম গডসেকে হিন্দুদের ‘হিরো’ বানিয়ে দিয়েছে। বৈপরিত্যে ভরা আজকের ভারতের নিউ জেনারেশন নিজেদের পূর্বসূরীদের সাথে শুধু কপটচারিতা শিখছে।

এখন আসুন নিজেদের পোশাকের ভেতর একটু উঁকি মেরে দেখি। পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি প্রতিটি পাকিস্তানি সর্বদা নিজেদের পকেটে রাখছেন, কেননা ‘পাকিস্তানের জনকে’র ছবি প্রতিটি মুদ্রায় রয়েছে। পাকিস্তানের জনকের ছবি সম্বলিত মুদ্রার সাহায্যে পাকিস্তানে শুধু রাজনৈতিক বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য নয়, বরং ঈমানও কিনে নেওয়া হয়। কেননা এখানে ক্ষমতাধরদের জন্য আইন একরকম এবং দুর্বলদের জন্য আইন অন্যরকম। পাকিস্তান রাষ্ট্র দেশপ্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতার (গাদ্দারি) এমন মাপকাঠি বানিয়ে রেখেছে, যা সময়ের সাথে সাথে বদলাতে থাকে। কায়েদে আজমের বোনকে তার ভায়ের জীবদ্দশাতেই মাদারে মিল্লাত (জাতির জননী) বলা হতে থাকে। কিন্তু মাদারে মিল্লাত যখন ১৯৬৫ সালে জেনারেল আইউব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াই করেন, তখন তিনি ভারতের এজেন্ট অভিহিত হন। মাদারে মিল্লাতের নির্বাচনী কর্মসূচির দায়িত্বে ছিলেন আজাদ কাশ্মিরের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও কায়েদে আজমের সাবেক প্রাইভেট সেক্রেটারি কে এইচ খুরশিদ। তিনিও ভারতীয় এজেন্ট অভিহিত হন। খুরশিদের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন মকবুল বাট, যিনি আইউবের শাসনামলে পেশোয়ার শহর থেকে মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার অধীনে কাশ্মির উপত্যকার মুহাজির আসন থেকে জয়লাভ করেছিলেন। এরপর কে এইচ খুরশিদকে আজাদ কাশ্মিরের প্রেসিডেন্ট বানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। খুরশিদ যখন ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী অভিযান শুরু করেন, তখন মকবুল বাটও তার সহযোগিতা করেছেন।

মকবুল শিক্ষিত যুবক ছিলেন। অধিকৃত কাশ্মির ভূমি ত্যাগ করে পেশোয়ারে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। বিখ্যাত কবি আহমদ ফারাযের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। এক বার তিনি পাকিস্তান এয়ারফোর্সে যোগদানের জন্য লিখিত পরীক্ষা দেন। কিন্তু যখন তার কাছে পাকিস্তানের নাগরিক হওয়ার প্রমাণ চাওয়া হলো, তখন তিনি এয়ারফোর্সের চাকরির স্বপ্ন মন থেকে মুছে ফেলেন। তিনি সাংবাদিকতার পেশা বেছে নেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ও তাসখন্দ চুক্তির পর মকবুল বাট পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি নিরাশ হয়ে গেলেন। তিনি কিছু সঙ্গী সাথে নিয়ে শিয়ালকোটের সন্নিকটে সুচিতগড়ের রণাঙ্গনের মাটি হাতে নিয়ে জম্মু-কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য মাহাজ রায় শুমারি বা প্লেবিসিট ফ্রন্ট গঠন করেন। এরপর তিনি নীরবে অধিকৃত কাশ্মির চলে যান এবং সেখানে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য যুবকদের তৈরি করতে শুরু করেন। অধিকৃত কাশ্মিরে তিনি গ্রেফতার হন।

সিআইডির অন্যতম অফিসার অমর চান্দ হত্যার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মকবুল বাট তার দুই জন সঙ্গী আমীর আহমদ ও গোলাম ইয়াসীনসহ শ্রীনগর জেলের ভেতর সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালিয়ে যান এবং দুর্গম বরফাচ্ছাদিত পথ ধরে আজাদ কাশ্মিরে ফিরে আসেন। তার উভয় পা ফ্রস্টবাইট বা হিমদংশনে ক্ষতবিক্ষত ছিল। তাকে গ্রেফতার করে মুজাফফারাবাদ দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়। অভিযোগ আরোপ করে বলা হলো, তুমি ভারতীয় এজেন্ট। ১৯৬৯ সালের মার্চে জেনারেল আইউব খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আইউব খান রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে গোলটেবিল কনফারেন্স ডাকেন। মাহাজ রায় শুমারি বা প্লেবিসিট ফ্রন্ট ঘোষণা দেয়, যদি মকবুল বাটকে মুক্তি দেওয়া না হয়, তাহলে প্লেবিসিট ফ্রন্ট গোলটেবিল কনফারেন্সের ভেন্যুর বাইরে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে। এ ঘোষণা শুনে মকবুল বাটকে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ আখ্যায়িতকারী স্বৈরশাসক আইউব খান এই মুক্তিকামীর মুক্তির নির্দেশ দেন। ৬ নভেম্বর, ১৯৬৯, জম্মুর শহীদ দিবস উপলক্ষে মুজাফ্ফারাবাদে মাহাজ রায় শুমারির চতুর্থ বার্ষিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মকবুল বাটকে মাহাজের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়েছিল।

ওই কনভেনশনে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগঠন পিএলও-র প্রতিনিধি খালেদ হালীমীও অংশগ্রহণ করেন। আর এভাবে মকবুল বাট কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলন ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের মাঝে সে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করেন, যা ফিলিস্তিনের মুফতিয়ে আজম আমীন আল-হোসাইনি ও চৌধুরী গোলাম আব্বাস কায়েম করেছিলেন। ১৯৭০ সালে আজাদ কাশ্মির অ্যাসেম্বলির নির্বাচন হলে মকবুল বাট ও তার সঙ্গীরা গিলগিট বালটিস্তানকেও সাংবিধানিক অধিকার প্রদানের দাবি জানান। মকবুল বাট একটি সমাবেশের জন্য গিলগিট পৌঁছলে তাকে আমানুল্লাহ খান, আবদুল খালেক আনসারি ও মীর আবদুল মান্নানসহ গ্রেফতার করে অ্যাবোটাবাদ কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তিন মাস পর মুক্তি পেয়ে মকবুল দ্বিতীয়বার গিলগিট পৌঁছলে তাকে আবারো গ্রেফতার করে রাওয়ালপিন্ডি পাঠানো হয়। এ সময় একটি ভারতীয় বিমান ‘গঙ্গা’ ছিনতাই হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার মকবুল বাটকে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ আখ্যায়িত করে বিমান ছিনতাইয়ের দায় তার ওপর চাপিয়ে দেয়।

১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি আদালত মকবুল বাটের মুক্তির নির্দেশ দেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো মিরপুরে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং আজাদ কাশ্মিরের প্রেসিডেন্ট বানানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু মকবুল বাট এতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অধিকৃত কাশ্মিরে তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আরো একবার অধিকৃত কাশ্মিরে যান। সেখানে তিনি আরো একবার গ্রেফতার হন। ১৯৮৪ সালের এগারো ফেব্রুয়ারি তাকে দিল্লির তিহার কারাগারে ফাঁসি দেয়া হয় এবং ওই কারাগারেই তাকে দাফন করা হয়েছে।

সারা বিশ্বের কাশ্মিরিরা এগারো ফেব্রুয়ারি এমন এক ব্যক্তির ‘শাহাদত দিবস’ পালন করেন, যাকে ভারতে ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’ এবং পাকিস্তানে ‘ভারতের এজেন্ট’ বলা হতো। উভয় রাষ্ট্রের বৈপরিত্যে ভরা নীতির বিরুদ্ধে মকবুল বাট স্বাধীন কাশ্মিরের স্লোগান দিয়েছিলেন। ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কোটলিতে বলেছেন, কাশ্মিরের জনগণ যখন পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেবেন, এরপর কাশ্মিরিদের এ অধিকার দেয়া হবে যে, তারা পাকিস্তানের সাথে অথবা স্বাধীন থাকবেন। ইমরান খানের এই বক্তব্যকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করা হলে জবাব আসে, ইমরান খানের বক্তব্য সংবিধানের ২৫৭ ধারা মোতাবেক দেয়া হয়েছে। যদি কাশ্মিরের স্বাধীনতার কথা ২৫৭ ধারা মোতাবেক হয়ে থাকে, তাহলে মকবুল বাটের অপরাধ কী ছিল?

মকবুল বাটের পত্রাবলির সঙ্কলন ‘শুউরে ফারদা’ (আগামীকালের ভাবনা) ২১ আগস্ট, ১৯৯৮ সালে কেন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল? পাকিস্তান রাষ্ট্রের এ বৈপরিত্য কবে শেষ হবে? ইমরান খান কি কাশ্মিরের স্বাধীনতার কথা শুধু আজাদ কাশ্মিরের আগামী নির্বাচনে স্বাধীনতার সমর্থকদের ভোট পাওয়ার জন্য বলেছেন? কাশ্মিরের নামে এ ধোঁকা দেয়া কবে শেষ হবে?

ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us