লড়াকু পাখি
বুলবুলি - ছবি সংগৃহীত
অতি পরিচিত দুঃসাহসী এক পাখি। বুলবুলি হিসেবে এরা সুপরিচিত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয় পাখি। এই এলাকার বাইরে চীনেও এদের দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম বাংলা বুলবুলির স্থায়ী আবাস।
এ ছাড়া আরো বিভিন্ন দেশে পাখিটি অবমুক্ত করা হয়েছে। ১৯০৩ সালে ফিজিতে চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে পাখিটি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৩ সালে সামোয়ায় পাখিটির bengalensis উপপ্রজাতি অবমুক্ত করা হয়েছে। ১৯১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে পাখিটি অবমুক্ত করা হলেও ১৯৪২ সালের পর এখানে আর তাদের দেখা যায়নি। এ ছাড়া বাহরাইন, ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নিউ ক্যালিডোনিয়া, ওমান, কাতার, টোঙ্গা ও যুক্তরাষ্ট্রেও এদের অবমুক্ত করা হয়েছে।
পৃথিবীতে এদের মোট সংখ্যা কত তা এখনো অজানা। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সে কারণে আইইউসিএন এই প্রজাতিটিকে Concern বা ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। বাংলার শহর-নগর-গ্রামেগঞ্জে প্রচুর বাংলা বুলবুলি দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও লোকগাথায় বারবার এসেছে এ পাখিটির নাম।
আমাদের অতিপরিচিত বাংলা বুলবুল ছোট বাদামি রঙের এক বৃক্ষচারী পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ২০ সেন্টিমিটার, ডানা ১০ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২ সেন্টিমিটার, লেজ ৯.৫ সেন্টিমিটার ও পা ২.২ সেন্টিমিটার। ওজন ৪২ গ্রাম। বাংলা বুলবুলের ঠোঁট দূর থেকে কালো দেখালেও তা আসলে কালচে-নীল। চোখ কালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতা সামান্য বাদামি-কালো। মুখের ভেতরটা ধূসর, বেগুনি ও হলুদে মেশানো। স্ত্রী ও পুরুষ বুলবুল দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ অপেক্ষাকৃত হালকা। মাথার কালো ঝুঁটি দেখে খুব সহজেই এদের শনাক্ত করা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা কালো বা কালচে-বাদামি। পালকের গড়ন আঁশের মতো বলে এমনটা হয়। লেজ বাদামি হলেও লেজের আগা কিছু অংশ গাঢ় বাদামি হয়ে প্রান্ত একদম সাদা। পেট অপেক্ষাকৃত ফিকে বাদামি। দেহতলে এবং কখনো কখনো উপপ্রজাতিভেদে পিঠে মাছের আঁশের মতো ফিকে দাগ থাকে। লেজের গোড়ার দিকটা সাদা। বাদামি দেহের শেষাংশ ও ডানার প্রান্ত কালচে-বাদামি। এর দেহের সবচেয়ে বিচিত্র স্থানটি হলো টকটকে লাল অবসারণী-ঢাকনি। এ লাল অবসারণীর জন্যই এর ইংরেজি নাম হয়েছে Red-vented Bulbul.
বাংলা বুলবুল বা বুলবুলি প্রচণ্ড লড়াকু পাখি। লড়াইবাজ পাখি হিসেবে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি এর। ইরান, ইরাক ও আফগানিস্তানের কোথাও কোথাও এখনো বুলবুলির লড়াই হয়। বাংলাদেশেও একসময় এদের লড়াই হতো। শুধু পোষা বুলবুল নয়, বুনো বুলবুলও লড়াইয়ে মেতে ওঠে অনেক সময়। লড়াইয়ে এতই মশগুল হয়ে পড়ে যে, কখনো কখনো শিকারির কবলে পড়ে যায়। এরা শহর, গ্রাম-গঞ্জ, পাতাঝরা বন, প্যারাবন, গ্রামীণ বন, বনের প্রান্ত, ক্ষেতখামার ও বাগানে বিচরণ করে। ঝোপঝাড় ও গাছের পাতায় এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। তীব্র রাসায়নিক পদার্থ এরা এড়িয়ে চলে। এদের খাদ্যতালিকার বড় অংশজুড়ে রয়েছে পোকামাকড়। এ ছাড়া ফুলের পাপড়ি, মধু ও ফলও খায় এরা। আগাছাজাতীয় গাছের বীজও এরা খায়।
বাসা বানাতে এদের সময় লাগে দুই থেকে পাঁচ দিন। সাধারণত এরা ছোট ঝোপঝাড়ে বাসা বানায়। এ ছাড়া গাছের গর্ত, ঝাপালো গাছ, নদী তীরের গর্ত, ভাসমান কচুরিপানা, বাসা-বাড়ির কার্নিশ এমনকি বাসের মধ্যেও বাসা বানায়। বাসার উচ্চতা ভূমি থেকে সাত থেকে ১০ ফুট ওপরে হয়। ডাল, ধাতব তার, পাতা, কঞ্চি, ঘাস, চুল ইত্যাদি মাকড়সার জালে জড়িয়ে পরিপাটি করে বাটির মতো বাসা বানায় এরা। বাসা বানানো হয়ে গেলে তিনটি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো হালকা গোলাপি রঙের, তার ওপরে লাল লাল ছিটমতো থাকে। ডিমের প্রশস্ত দিকে ছিট তুলনামূলক ঘন। ১৪ দিনের মাথায় ডিম ফুটে ছানা বের হয়। বাবা-মা উভয়েই সন্তান দেখাশোনার ভার নেয়।
জোড়ায় জোড়ায় বা ছোট দলে ঘুরে বেড়ায়। উড়ন্ত শিকার ধরার সময় এরা সামান্য উড়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। সচরাচর ডাকে : বি-কুইক-কুইক...। ভয় পেলে তীক্ষ্ম ও উচ্চস্বরে ডাকে : পিক...। সারা বছরই ডাকে এরা। কয়েক প্রজাতির বাসা পরজীবী পাখি বাংলা বুলবুলের বাসায় ডিম পেড়ে যায়। এপ্রিল-আগস্ট বাংলা বুলবুলের প্রধান প্রজনন মওসুম। কখনো কখনো সেপ্টেম্বর পর্যন্তও এরা ডিম পাড়ে, ছানা ফোটায়। একজোড়া বাংলা বুলবুল এক প্রজনন মওসুমে একাধিকবার ছানা তোলে। এ সময় পুরুষ বুলবুল আরো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। পুরুষ বুলবুল মাথার ওপর ডানা মেলে ধরে ও স্ত্রী পাখির দিকে লেজ ছড়িয়ে দিয়ে মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে।