নিকৃষ্ট প্রাণীর উৎকৃষ্ট আচরণ
নিকৃষ্ট প্রাণীর উৎকৃষ্ট আচরণ - ছবি সংগৃহীত
শরীরটা ভালো নেই। সূর্যোদয়ের সময় থেকেই জ্বর এসে, সমস্ত শরীর কাঁপছে। কিন্তু শরীরের যায় হোক না কেন, দৈনিক রুটিন তো পূরণ করতেই হবে! আমার ভাগের কাজ সমাপ্ত করতে গিয়ে মনটা ভীষণভাবে বিগড়ে গেল। শরীর পারছে না, তাই কিছুই সহ্য হচ্ছিল না। এমন সময় মা বলল, মাঠ থেকে সবজি আনতে। আদেশটা শুনে রেগে গেলাম। পরক্ষণে আবার ভাবলাম, মা বলেছে! আদেশ মানতেই হবে। তাই দুপুরের খাওয়া ৩টায় খেয়ে চলে গেলাম মাঠে মুলা এবং পালন শাক আনতে।
সবজি নিয়ে ফিরতেই চোখ পড়ল, নিচু ভূমির দিকে- যেখানে শাপ থাকার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেখলাম এখানে দুটি কুকুরের বাচ্চা রয়েছে, যারা এই সমাজের চোখে নিকৃষ্ট প্রাণী । দেখলাম দুটি বাচ্চা এই মাঠের কোণে একা একা রয়েছে। সাথে অন্য কোনো কুকুর নেই, শুধু গাছের উপরে কিছু প্রাণী করুণ সুরে শব্দ করছে। আমি উঁচুতে দাঁড়িয়ে দেখলাম- একটি বাচ্চা শুয়ে আছে আর অন্যটি তার পাশে মনমরা হয়ে বসে রয়েছে। আমি এই দৃশ্য দেখে বুঝলাম, শুয়ে থাকা কুকুরের বাচ্চাটা মরে গেছে আর বসে থাকা বাচ্চাটা তাকে পাহারা দিচ্ছে, এই শব্দহীন মাঠের মধ্যে। আমি তু তু বলে ডাকতেই সে আমার দিকে এমন করে তাকাল যা দেখে কোনো মানবিক মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারবে না। আমি দেখলাম- জীবিত বাচ্চার চোখে পানি ছলছল করছে।
তার মুখশ্রী থেকে সব আনন্দের রেখা মুছে গেছে। তার চেহারায় শোকের মাতম শুরু হয়েছে। তার উদরে কোনো খাবার নেই। পেটটা একেবারে খালি হয়ে আছে। সে চাইলেই পারত লোকালয়ে এসে কিছু খাবার ভক্ষণ করতে, কিন্তু সে আসেনি! মমতার বন্ধনের কারণে। আমি তাকে ডাকতেই সে উঠে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর তার মরা ভাইটার পাশে ঘুরছে। সে তার সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ভাই হারানোর শোক তাকে ব্যথিত করেছে। সে তার ভাইকে একা রেখে আসতে চাচ্ছে না। সে শুধুই কাঁদছে, চোখ দিয়ে অশ্রু পড়ছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি আর ভাবছি কতই না ভালোবাসা প্রভু প্রত্যেক প্রাণীর মাঝে দিয়ে রেখেছেন। আমি তাকে ডাকতেই থাকলাম- সে এলো ঠিকই। কিন্তু সে যতটা পা সামনে ফেলেছে ঠিক তার বেশিবার সে তার মৃত ভাইয়ের দিকে তাকিয়েছে। অবশেষে সে এলো। ১০ কদম পরপর সে থেমে যাচ্ছে আর পেছন ফিরে তাকাচ্ছে, আমি তাকে ডাকতেই থাকলাম, তাই সে আমার ডাক শুনে ৬০ কদম এলো। সে এবার থেমে গেল, আমার মুখের দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকাল। আমি তার দিকে তাকিয়ে আর তাকে ডাকতে পারলাম না। সে পেছনে ফিরল এবং আমার দিকে শেষবার চেয়ে, চলে গেল তার মৃত ভাইয়ের কাছে।
আমি তার এই শেষ চাহনি দেখে বুঝলাম, সে আমাকে কিছু দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু সে দায়িত্বটা কি? সেটা কি তার অন্ন জোগাড়ের? নাকি তার মৃত ভাইয়ের সৎকারের? আমি এই ভাবতে ভাবতে দ্রুত বাড়ি ফিরলাম। আমি জীবিত বাচ্চাটিকে ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্বকেই প্রথমে গ্রহণ করলাম। সবজি জায়গাতে রেখেই ভাতের হাঁড়ির কাছে চলে গেলাম। দেখলাম বেশি ভাত নেই, আব্বা এখনো খাইনি। ভাবলাম আব্বার ভাতে কম পড়লে অন্য বাড়ি থেকে চেয়ে আনবে কিন্তু এই কুকুরটিকে আমি ভাত না দিলে আর কেউ দেবে না। তাই হাঁড়ি থেকে অনায়াসে ভাত নিলাম এবং চলে গেলাম মাঠের ওই বাচ্চা কুকুর দুটির কাছে। জীবিত বাচ্চাটি আমাকে দ্বিতীয়বার দেখেই উঠে পড়ল, আমি তার সামনে খাবার দিলাম, সে চোখের অশ্রু ফেলতে ফেলতে খেতে লাগল। আমি এবার তার ভাইয়ের সৎকারের কথা ভাবলাম। সবজি আনতে যাওয়ার সময় মাঠের ভোগে কোদাল দেখেছিলাম, আমি চলে গেলাম কোদাল আনতে...।
কোদাল নিয়ে যখন হাজির হলাম তাদের কাছে, তখন জীবিত কুকুরটি আমার দিকে হাতা মারতে লাগল। আমি ভাবলাম, মৃত মানুষের আপনজনরা যেমন দাফন দিতে একটু দেরি করতে বলে, ঠিক সেও আমাকে তাই-ই বলছে, সে তার ভাইয়ের সাথে আরেকটু সময় থাকতে চাচ্ছে। আমি তাকে সান্ত্বÍনা দিয়ে মাটি খোঁড়া আরম্ভ করলাম। এরপর আমি ওই মৃত কুকিরটিকে মুক্ত আকাশের নিচে সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরের বক্ষে লোকচক্ষুর অন্তরালে অজানা ভূমিতে দাফন করে দিলাম। জীবিত বাচ্চাটা তার ভাইয়ের দাফন কার্যের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, আর শুধু অশ্রু ফেলতে লাগল...।
দাফন শেষে আমি তাকে ডাক দিলাম। সে এক ডাকেই এলো। সহজ-সরলভাবেই আমার সামনে সামনে চলতে লাগল। কিন্তু লোকালয়ে আসার আগেই সে থেমে গেল। সামনে থেকে চলে এসে পেছনে অবস্থান নিলো, আমি তাকে বললাম- কিরে চল, যাবে? আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম, বুঝলাম চোখের চাহনি দ্বারা সে আমাকে ধন্যবাদ দিলো। আর এখানে সে লোকালয়ে আসার জন্য আসিনে। সে তার এই উপকারী অতিথিকে বিদায় জানাতে এসেছে, যেমন মানুষরা অতিথি যাওয়ার পথে এগিয়ে দিতে আসে তেমনি! সে উল্টো ঘুরে দৌড়াতে লাগল, মাঝে আমার দিকে আবার তাকাল। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলাম আর ভাবলাম- ‘তার এখন অনেক কাজ, সে তার ভাগের অবশিষ্ট ভাতগুলো এখন তার আত্মীয় পাখিগুলোকে দিয়ে মেহমানদারির নিয়মটা পালন করবে। যারা তার সাথে সঙ্গ দিয়েছিল মৃত্যুসভায়। তাদের আপ্যায়ন না করে কি সে থাকতে পারে? তারও তো একটা দায়িত্ব আছে...।