শাবান মাস কিভাবে পালন করা উচিত

মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী | Mar 20, 2021 02:02 pm
শাবান মাস কিভাবে পালন করা উচিত

শাবান মাস কিভাবে পালন করা উচিত - ছবি সংগৃহীত

 

শাবান মাস রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের সময়। এ মাসের ফজিলত বিশুদ্ধ হাদিস দিয়ে প্রমাণিত। শাবান মাসে রাসূল সা: অধিক হারে রোজা রাখতেন। তিনি উম্মতকেও এর ওপর উৎসাহিত করেছেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা: বলেন, ‘আমি রাসূল সা:কে কখনো রমজান ছাড়া পূর্ণ কোনো মাস রোজা রাখতে দেখিনি। শাবান মাসে তিনি অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন। বছরের অন্য কোনো মাসে এরূপ করতেন না।’ (বুখারি-১৬৮৬)।

উসামা ইবনে জায়দ রা: নবীজী সা:কে শাবান মাসে অধিক রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ মানুষ এ মাসের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। অথচ এটি এমন মাস, যে মাসে আল্লাহর কাছে বান্দাদের আমলনামা পেশ করা হয়। আমি চাই আমার আমলনামা এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি রোজাদার।’ (নাসায়ি-২৩৫৭)।

এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ রাত হচ্ছে লাইলাতুন্নিসফি মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত। আরেকটু সহজ ভাষায় ১৪ শাবান দিবাগত রাত। যা আমাদের পরিভাষায় ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রাত। কুরআন-হাদিসে ‘বারাআত’ শব্দের উল্লেখ না থাকলেও সম্বন্ধের কারণ সম্ভবত রাসূল সা:-এর হাদিস। নবীজী সা: ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে সৃষ্টির দিকে (করুণার) দৃষ্টি করেন, মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করেন।’ (ইবনে হিব্বান-৫৬৬৫)।

হাদিস থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা দ্ইু প্রকার মানুষ ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। অন্যভাবে বললে- দোজখ ও শাস্তি থেকে মুক্তি দেন। হতে পারে এটাই নামকরণের স্বার্থকতা। আর এ কারণেই বলা হয় ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রাত।

আমাদের কেউ কেউ এ রাতের ফজিলত একেবারেই অস্বীকার করেন। আবার কেউ কেউ ইবাদতের নামে মনগড়া পথ ও পদ্ধতির অনুসরণ করেন। যা ইবাদতের পরিবর্তে বিদয়াতে রূপ নেয়। অস্বীকার কিংবা মনগড়া ইবাদত কোনোটিই কাম্য নয়। শরিয়ত যা যেভাবে নির্দেশ করেছে তা হুবহু সেভাবে পালন করাই ইবাদত এবং শরিয়তের চাহিদা। এতে কমবেশি করার কোনো প্রকার সুযোগ বা অবকাশ নেই।

‘লাইলাতুল বারাআত’ শব্দ সরাসরি হাদিসে নেই বলে এ রাতের কোনো মর্যাদা বা ফজিলত নেই, এ কথা বলা একেবারেই অবান্তর। মধ্য শাবানের রাত তথা শবেবরাতের ফজিলত একাধিক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যদিও বেশির ভাগ হাদিসের সনদ দুর্বল। এ ব্যাপারে যুুগের অন্যতম শীর্ষ আলেম শায়খুল ইসলাম আল্লামা তকী উসমানি বলেন, ‘১০ জন সাহাবি থেকে শবেবরাতের মর্যাদা সম্পর্কে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য কোনো কোনোটির সনদ দুর্বল। এই সনদগত দুর্বলতার কারণে কেউ বলে দিয়েছেন এ রাতের ফজিলত ভিত্তিহীন। কিন্তু মুহাদ্দিস ও ফকিহদের ফায়সালা হলো- কোনো একটি হাদিস যদি সনদগতভাবে দুর্বল হয় অতঃপর বিভিন্ন হাদিস দিয়ে তা সমর্থিত হয় তাহলে এ সমর্থনের কারণে তার দুর্বলতা রহিত হয়ে যায়। সুতরাং শবেবরাতের ফজিলতকে ভিত্তিহীন বলা একটি অকাট্য ভুল।’ (নির্বাচিত বয়ান, পৃষ্ঠা-৯৭)।

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা: বলেন, ‘একবার মধ্য শাবান রাতে রাসূল সা: আমার কাছে এসে আবার বের হয়ে গেলেন। আমি তাঁর পেছনে বের হয়ে তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে পেলাম। তিনি মুমিন ও শহীদদের জন্য ইস্তেগফার করছিলেন। রাসূল সা: ঘরে ফিরে আমাকে বললেন, হে আয়েশা, আজ মধ্য শাবানের রাত। আজ রাত আল্লাহ তায়ালা বনু কালব গোত্রের ছাগলের পশমের পরিমাণ (অধিক সংখ্যক) বান্দাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ তায়ালা মুশরিক, হিংসা পোষণকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী পুরুষ, মা-বাবার অবাধ্য ও মদপানকারীদের ক্ষমা করবেন না। অতঃপর রাসূল সা: আমাকে বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি আজ রাত আমাকে ইবাদতের অনুমতি দেবে? আয়েশা রা: বলেন, আমি বললাম আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গিত। রাসূল সা: দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে লাগলেন। অতঃপর এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার সন্দেহ হলো তাঁর রুহ মোবারক কবজ করা হয়নি তো! আমি উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তা নড়ে ওঠল। আমি শান্ত ও আনন্দিত হলাম যে, রাসূল সা: জীবিত আছেন। তিনি সিজদায় এ দোয়া পড়ছিলেন- (অনুবাদ) আমি আপনার কাছে আপনার শাস্তি থেকে ক্ষমার, আপনার অসন্তুষ্টি থেকে সন্তুষ্টির, আপনার কাছ (শাস্তি ও পাকড়াও) থেকে আশ্রয় চাই। আপনার সত্তা মহান, আমি আপনার উপযুক্ত প্রশংসা করতে অক্ষম, আপনি এরূপ, যেরূপ আপনি আপনার প্রশংসা করেছেন। আয়েশা রা: বলেন, আমি রাসূল সা:-এর কাছ থেকে এ দোয়া পড়তে লাগলাম। তিনি বললেন, হে আয়েশা, এ দোয়া শিখো এবং অন্যদেরও শিখিয়ে দাও।’ (বায়হাকি-৩৮৩৩)।

সাইয়িদুনা আলি রা: বর্ণনা করেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমাদের মাঝে মধ্য শাবানের রাত আসে, তখন তোমরা এ রাতে ইবাদত করো এবং দিনের বেলা রোজা রাখো।’ (ইবনে মাজাহ-১৩৮০)।

আগেও বলা হয়েছে, এ রাতের ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসগুলোর কোনো কোনোটি সনদের দিক থেকে দুর্বল। কিন্তু ১০ জন সাহাবায়ে কেরাম রা: থেকে এ বিষয়ে হাদিস বর্ণিত হওয়ায় এবং দুর্বলতা কঠিন না হওয়ার কারণে তা হাসানের স্তরে পৌঁছে গেছে। ফলে ফজিলত অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং আমাদের উচিত কোনো প্রকার অবজ্ঞা, অবহেলা না করে রাসূল সা:-এর আমলের আলোকে মনগড়া ও বাড়াবাড়িমুক্ত ইবাদত করা। উপরোল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে রাসূল সা:-এর আমল সুস্পষ্ট। যেমন- তিনি একবার মধ্য শাবানের রাতে মুসলমানদের কবরস্থানে গিয়ে মাগফিরাত কামনা করেছেন। দেখুন, রাসূল সা: থেকে তাঁর দীর্ঘ জীবনে মাত্র একবার এ রাতে কবরস্থানে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাও একাকী, সুতরাং আমরা এ রাতে কবর জিয়ারত করতে পারি। তবে তা যে প্রতি বছরই করতে হবে বা দলবদ্ধভাবে কবরস্থানে যেতে হবে এর ন্যূনতম প্রমাণ নেই।

রাসূল সা:-এর দীর্ঘ নামাজ সম্পর্কিত হাদিস আমাদের নামাজের জন্য মাপকাঠি। যা অস্বীকার করার দুঃসাহস কারো নেই। দেখুন, রাসূল সা: লম্বা সময় নিয়ে নামাজ পড়েছেন, সিজদা করেছেন কিন্তু তা একাকী এবং নিজ ঘরে। এ ছাড়া অন্যান্য রাত্রিতেও রাসূল সা: নফল নামাজ নিজ ঘরেই আদায় করেছেন। সুতরাং আমাদের নফল নামাজ ও ইবাদত অনুরূপ হওয়াই সুন্নাহর চাহিদা। স্মরণ রাখতে হবে, নফল নামাজ আল্লাহর সাথে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের সোপান, যা নির্জনে হওয়াই কাম্য। দেখুন, একদিকে নবীজী সা:-এর ঘরে স্থানস্বল্পতা, আবার দরজা খুললেই ছিল মসজিদে নববী। যদি নফল আমলের জন্য ঘরের চেয়ে মসজিদ উত্তম হতো তবে রাসূল সা: মসজিদে নববী পাশে রেখে, কস্মিনকালেও নফল আমল ঘরে করতেন না।

ইবাদতের নামে এমন কিছু কাজ এ রাতে করা হয়- যা একবারেই ভিত্তিহীন। যেমন- হালুয়া, শিরনি, আতশবাজি, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, আলোকসজ্জা, গোসল, মৃতের রুহ ঘরে আসার ধারণা, বরাতের নামাজ, আলফিয়া নামাজ ইত্যাদি। এ সবকটি কাজই কুসংস্কার কিংবা বিদয়াত।

মধ্য শাবান (১৫ শাবান) রোজা রাখার ব্যাপারে আল্লামা তাকি উসমানি বলেন, ‘এটাকে রীতিমতো সুন্নত মনে করা ঠিক নয়। যেহেতু হাদিসটি দুর্বল, তাই কেবল মধ্য শাবানের কারণে নয় বরং নবীজী সা: এ মাসে অধিক রোজা রাখতেন এবং এর ওপর উম্মতকেও উৎসাহিত করেছেন। এ ছাড়া প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখা মুস্তাহাব, উদ্দেশ্যে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া অধিক উত্তম। যাতে রাসূল সা:-এর অন্যান্য হাদিসের ওপরও আমল হয় এবং পুণ্য অর্জন হয়ে যায়।

লেখক : সম্পাদক, সিলেট রিয়েল ও সহকারী শিক্ষক; শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, সিলেট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us