বসনিয়ার গণকবর উদঘাটনে লাইডার প্রযুক্তি
বসনিয়ার গণকবর উদঘাটনে লাইডার প্রযুক্তি - ছবি সংগৃহীত
আজকাল ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে নানা কাজে। সময়ের সাথে ড্রোনপ্রযুক্তির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রতি নতুন একটি ক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহারের কথা শোনা যাচ্ছে। ড্রোনে Lidar রিমোট সেন্সিং টেকনোলজি সংযোজন করে তা ব্যবহার হবে বসনিয়ায় গণকবর খুঁজে বের করার কাজে। এর মাধ্যমে ২৫ বছর আগে শেষ হওয়া যুদ্ধে যে ৭,৫৭৩ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছে, তাদের গণকবর চিহ্নিত করা হবে।
ম্যাসোভিক গত ২৮বছর ধরে মানুষের দেহাবশেষ খুঁজে বেরিয়েছেন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাজুড়ে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে তিনি মাত্র ২৮ জন নিখোঁজ ব্যক্তির কবরের স্থান সম্পর্কে কিছু টুকরো তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন ও যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে নিহতদের গণকবর সম্পর্কিত তথ্য পেয়েছেন সামান্যই। সেটি উল্লেখ করার মতো নয়। যে যুদ্ধাপরাধীরা এসব গণকবর দেয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল, তাদের কাছ থেকেও তিনি কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ম্যাসোভিক এমনটিই জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরাকে। উল্লেখ্য, ম্যাসোভিক হচ্ছেন বসনিয়ার ‘মিসিং পারসন্স ইনস্টিটিউট’-এর পরিচালক।
বসনিয়ায় যুদ্ধাপরাধে অনেকেই অংশ নিয়েছিল। তারা কোথায় কোথায় নিহতদের গণকবর দিয়েছিল সেটা এখনো জানে। যারা ট্রিগার চেপে নির্বিচারে গুলি করে বসনীয়দের হত্যা করেছিল, যেসব ড্রাইভার তাদের পরিবহনে নিহতদের লাশ ঘটনাস্থল থেকে গণকবরের স্থানে করে নিয়ে গিয়েছিল এবং যারা গণকবরগুলো খনন করেছিল এদের কাছে তো অবশ্যই এই গণকবরের স্থানগুলো অজানা নয়। কিন্তু এদের কেউই অন্তত নাম পরিচয় গোপন রেখেও এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য জানাতে এগিয়ে আসেনি। বসনিয়ায় সংঘটিত ১৯৯২-৯৫ সময়ের যুদ্ধের পর ৩২ হাজার লোকের নাম নিখোঁজ হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এর মধ্যে আজ পর্যন্ত মাত্র ৩০০০ জনের গোপন গণকবর উদঘাটন করা হয়েছে। এ কাজকে ‘রিমার্কেবল’ বলে উল্লেখ করেছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পারসন্স’ (আইসিএমপি)-এর ফরেনসিক (আলামত) কো-অর্ডিনেটর স্যান্ড্রা স্টারিক। এই আন্তর্জাতিক কমিশনের সদর দফতর হেগে। উল্লেখ্য, ২৫ বছর আগে ডেটন শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ওই যুদ্ধের অবসান ঘটলেও নিহত ৭,৫৭৩ জন সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনো তথ্যের সন্ধান মেলেনি।
এ সম্পর্কিত বেশির ভাগ তদন্ত চলেছে সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। ১৯৯৬ সালে যখন এ যুদ্ধের পর বেঁচে থাকা অবশিষ্ট বসনীয়রা তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসতে শুরু করে, তখন ম্যাসোভিক ও তার টিম স্থানীয় লোকদের কাছে গিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তারা এলাকার কোনো স্থানের জমিতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পেয়েছে কি না? কোনো স্থানের অন্তত ২১৫ বর্গফুট স্থানে যখনই ভেজিটেশনের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা গেছে, তখনই তারা ধরে নিয়েছেন এ স্থানে বর্ধিত পরিমাণে জৈব পদার্থ রয়েছে, অর্থাৎ এখানেই রয়েছে সম্ভাব্য কোনো গণকবর। কিন্তু সময় যতই যাচ্ছিল, নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ পাওয়ার ব্যাপারটি ততই জটিল হয়ে উঠছিল।
বসনিয়ার স্রেব্রেনিকার কাছাকাছি পটোক্যারিতে অবস্থিত মেমোরিয়াল সেন্টার, যাতে রয়েছে কয়েক হাজার কবর। ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে সার্বদের পরিচালিত গণহত্যার শিকার ৮ হাজার বসনিয়াকের দেহাবশেষ রয়েছে এসব কবরে। যুক্তরাষ্ট্র ও আরো কয়েকটি দেশের ফরেনসিক গবেষকেরা লাইডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরো গণকবর ও দেহাবশেষের অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করছেন ড্রোন বা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে এ ক্ষেত্রে তাদের আশ্রয় নিতে হয় প্রযুক্তির : ড্রোন প্রযুক্তি ও লাইডার প্রযুক্তির। খরফধৎ বা পুরো কথায় খরমযঃ উবঃবপঃরড়হ ধহফ জধহমরহম হচ্ছে একটি রিমোট সেন্সিং টেকনোলজি। এই প্রযুক্তি আকাশ থেকে দ্রুত নিচের ভূমির দিকে আলোর অনেক পালস বা স্পন্দন পাঠায় ভূমি দূরত্ব পরিমাপের জন্য। এর মাধ্যমে যে ডাটা সংগ্রহ করা হবে, তা দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে ভূমির অতি সূক্ষè পরিবর্তন। কোনো বিমান, ড্রোন কিংবা হেকিপ্টারের সাথে এ লাইডার সংযুক্ত করে দিলে এটি বিরাট এলাকাজুড়ে স্ক্যান করতে পারে। এটি ভূমির গাছগাছড়া ভেদ করে ভূমির টপোগ্রাফিতে অসঙ্গতি চিহ্নিত করতে পারে। জানাতে পারে লাশ পচে গলে মাটির ওপর কোনো জৈবিক প্রভাব ফেলেছে কি না। এভাবে জানা যায় কোথাও কোনো গণকবর আছে কি নেই।
এখন পর্যন্ত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে চালকবিহীন গাড়িতে। এছাড়া এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখা হয়েছে কোথাও কোনো প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব আছে কি না। সম্প্রতি এই প্রযুক্তির সাহায্যে উদঘাটন করা মায়া সভ্যতার তিন হাজার বছরের পুরনো স্মারক একটি স্থাপত্য। গবেষকেরা এখন বলছেন, এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো যাবে বনিয়ার গণকবর চিহ্নিত করার কাজে।
মানুষের লাশ ডিকমপজিশনের (গলে যাওয়া বা ক্ষয় হওয়ার) বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজি সেন্টার’-এর গবেষকরা ডোনেট করা লাশগুলো আড়াই একর জায়গায় গণহারে কবর দেন। এই সেন্টার ‘বডি ফার্ম’ নামেও পরিচিত। এই ফার্ম ২০১৩ সালে তিনটি ভিন্ন আকারের কবরে পরীক্ষা শুরু করে। সবচেয়ে বড় কবরটিতে রাখা হয়েছিল ছয়টি লাশ। এই কবরে একটি তেপায়ার ওপর বসিয়ে রাখা হয় একটি লাইডার স্ক্যানার। তিন বছর সময়ের মধ্যে তারা কবরের উপরের মাটির উচ্চতার মধ্যে একটি পরিবর্তন লক্ষ করেন। এতে প্রমাণ হয়, লাইডার প্রযুক্তি সফলভাবে ব্যবহার করা যাবে বসনিয়ার কিংবা অন্যান্য স্থানের গণকবরগুলো খুঁজে বের করার কাজে। এই পরীক্ষায় অংশ নেনঅ্যামি মুনডর্ফ। তিনি সংবাদ সংস্থাকে জানান, মানুষের লাশ যখন কবরে পচেগলে যায় কিংবা ক্ষয় হয়, তখন কবরের মাটি কিছুটা বসে যায়, তখন এর গভীরতায় একটা পরিবর্তন আসে। প্রাথমিক পর্যায়ে কবরের আকারে পরিবর্তন ঘটে। তবে স্বাভাবিক অবস্থায়ও মাটিতে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। তাই কোথাও মাটি ধস স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে, না কবরের কারণে ঘটেছে সেটা বলা মুশকিল।
মানুষ গণকবর সন্ধান করতে লাইডার টেকনোলজি বহুবার ব্যবহার করেছে, কিন্তু তাতে এরা সফল হয়নি। এর কারণ, ভূপৃষ্ঠ প্রাকৃতিকভাবে উঁচুনিচু হতে পারে। তাই এখন গবেষকেরা যা করছেন, তা হচ্ছে বিশ্লেষণ পরিবর্তন। এরা কোথায় পরিবর্তনটা এসেছে, তা জানার জন্য সেই কবর দেয়ার আগের সময় থেকেই এখন লক্ষ রাখছেন লাইডারের সংগ্রহের ওপর। এরপর এই পরিবর্তন তুলনা করে দেখছেন।
বসনিয়ার পরিস্থিতিটা এই গবেষকদের প্রকল্পের জন্য ছিল একটি জোরালো প্রণোদনা। কিন্তু প্রায় তিন দশকের পুরনো গণকবর আজ চিহ্নিত করা যাবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। লাইডার গণহত্যা চলার আগের সময়ের ভূমি স্ক্যান করে। এই মাটির পার্থক্য তুলনা করে দেখা প্রয়োজন। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যেসব রেকর্ড পাওয়া যায়, তা কাঠামো নির্মাণ কাজে ব্যবহার হয়েছে কয়েক দশক আগেই।
মুনডর্ফ বলেন : ‘আমার মনে হয় আমরা বসনিয়ার গণকবরগুলো চিহ্নিত করতে পারব। দুর্ভাগ্য, বসনিয়ার এসব গণকবরের বেশির ভাগই খুব বড় আকারের। তাই একটি একক লাশের কবরের মতো এসব বহু লাশের গণকবরের রেজ্যুলেশন ততটা স্পষ্ট হবে না। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বসনিয়ার জ্যানিয়া গ্রামের সন্দেহজনক একটি কবর এলাকার ছবি সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছবিতে দখা গেছে, সেখানে অনেক গণকবর উদঘাটিত হয়েছে। উপগ্রহের মাধ্যমে এই ছবি তোলা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান থেকে এ এলাকার ছবিতেও তা ধরা পড়ে। রয়টার সে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করে।
আইসিএমপির সারায়েভো অফিস আলজাজিরাকে জানিয়েছে, লাইডারভিত্তিক কৌশল এখন কাজে লাগানোর পথে। বসনিয়ার তুজলার ‘জিওলজি ও জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির রয়েছে লাইডার ইকুইপমেন্ট। এটি মিসিং পারসন্স ইনস্টিটিউটকে বলেছে স্রেব্রেনিকার চার পাশের তিনটি স্থানে আবার পরীক্ষা চালানোর জন্য। এ তিনটি এলাকায় গণকবর পাওয়া যেতে পারে। আইসিএমপি’র ফরেনসিক কো-অর্ডিনেটর স্টারি সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, নিখোঁজ অবশিষ্টদের কবর খুঁজে পাওয়া এখন খুবই কঠিন কাজ। কিছু লোকের সন্ধান হয়তো কখনোই মিলবে না। তবে এ ক্ষেত্রে তিনি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারকে স্বাগত জানান।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব
ম্যাসোভিকও লাইডার প্রযুক্তি ব্যবহারকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বসনিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা নিখোঁজ ব্যক্তিদের দেহাবশেষ সন্ধানের ব্যাপারে সার্বদের পরিচালিত কর্তৃপক্ষ জবঢ়ঁনষরশধ ঝৎঢ়ংশধ-র রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। সম্ভাব্য সব উপায়ে এ কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালায় এই প্রক্রিয়ায় ধীরগতি সৃষ্টি করতে- এমনটিই মনে করেন ম্যাসোভিক।
তিনি আরো বলেন, ‘জবঢ়ঁনষরশধ ঝৎঢ়ংশধ-র শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নিখোঁজ ব্যাক্তিদের দেহাবশেষ খুঁজে বের করার ব্যাপারটি মোটেও আমলে নেয় না। এর কারণ খুবই সহজ। নিখোঁজ ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বসনিয়াক নৃ-গোষ্ঠীর লোক, প্রায় ৮৫ শতাংশ। আমাদের সাম্প্রতিক আরেকটি সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ মিসিং পারসন্স ইনস্টিটিউটকে বিশেষ ধরনের যান কেনার অনুমতি দিচ্ছে না। এর দাম প্রায় ৩১ হাজার ডলার। অতএব আমি যৌক্তিক প্রশ্ন তুলতে পারি- সরকার কি আমাদের হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করবে, যা গণকবর আবিষ্কারে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন।’
ম্যাসোভিকের টিমে রয়েছেন ১৮ জন ইনভেস্টিগেটর, যারা ভূপৃষ্ঠে কাজ করেন। ম্যাসোভিক বলেন, ‘এর অর্থ প্রতিজন ইনভেস্টিগেটরকে খুঁজে বের করতে হবে ৩২০ জনের দেহাবশেষ, যারা নিখোঁজ হয়েছেন ২৫ থেকে ২৮ বছর আগে। এরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের হাতে নিহত কিংবা অপহৃত হয়ছিল। শেষ পর্যন্ত যদি এদের দেহাবশেষ আবিষ্কারে লাইডার প্রযুক্তি সত্যিই ব্যবহার হয়, তবে আমি খুবই খুশি হবো। যদি এ ধরনের প্রকল্প শুরু হয় তবে আমাদের ইনস্টিটিউটের সম্পদ দিয়ে এ প্রকল্পে সার্বিক সহযোগিতা করবে।’