জয়দেবপুরে সেকেন্ড বেঙ্গলে সেদিন কী ঘটেছিল?
জয়দেবপুরে সেকেন্ড বেঙ্গলে সেদিন কী ঘটেছিল? - ছবি সংগৃহীত
পাকিস্তানি অভিযান, জনগণের ও সেকেন্ড বেঙ্গলের প্রতিরোধ-বিদ্রোহ
১৯ মার্চ ১৯৭১ সকালবেলায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে, ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের নেতৃত্বে কমবেশি ৭০ জন অফিসার ও সৈনিক সংবলিত একটি দল জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে, এই সফরের কারণ ব্যাখ্যা করা হলো এই বলে যে, জয়দেবপুরে সেকেন্ড বেঙ্গল কেমন আছে, এটা দেখা! ওই সেনাদল সকাল সাড়ে ১০টা-১১টায় রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছায়। স্থানীয় দেশপ্রেমিক বাঙালি জনগণ সবকিছুই অনুসরণ করছিলেন। তারা অনুধাবন করলেন, সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা হবে। স্থানীয় জনগণ সিদ্ধান্ত নিলেন, এটা কোনোমতেই হতে দেয়া যাবে না। স্থানীয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এবং নেতৃত্বে জয়দেবপুর বাজারে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গেল। জয়দেবপুর রেলস্টেশনে দণ্ডায়মান থাকা মালগাড়ির দুটি বগিকে টেনে এনে জয়দেবপুর বাজারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো যেন রাজবাড়ী থেকে কেউ বাজারের দিকে যেতে না পারে বা বাজারের দিক থেকে কেউ রাজবাড়ীর দিকে আসতে না পারে। ব্রিগেডিয়ার আরবাবের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সেনাদল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে এসে সেকেন্ড বেঙ্গলের অফিসার ও সৈনিকদের যুদ্ধংদেহী সাজসজ্জা দেখে, অফিসার ও সৈনিকদের কথাবার্তা শুনে এবং তাদের চেহারায় ফুটে উঠা অভিব্যক্তি ইত্যাদি অনুভব করে সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে আর সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা যাবে না! আজকে তাদের অস্ত্র কব্জা করা যাবে না! আরবারের নেতৃত্বাধীন সেনাদল সিদ্ধান্ত নিলো, ইজ্জতের সাথে নিজেরা ফিরে যেতে পারলেই যথেষ্ট। আরবাবের দল ফেরত যাওয়ার পথে জয়দেবপুর বাজারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হলো।
ব্রিগেডিয়ার আরবাব, সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলকে হুকুম দিলেন, যেকোনো নিয়মে, প্রয়োজনে গুলি করে, ‘উচ্ছৃঙ্খল’ জনতাকে সরিয়ে, লেভেল ক্রসিং থেকে মালগাড়ির বগি সরিয়ে, আরবাবের সেনাদলকে ফেরত যাওয়ার পথ নির্বিঘ্ন করা হোক। অধিনায়ক যেখানেই দণ্ডায়মান ছিলেন, আমি তার থেকে অল্প দূরেই তথা ‘সম্মানজনক’ দূরত্বে ঘুরঘুর করতাম; এটিই ছিল রেওয়াজ; অর্থাৎ অধিনায়কের যেকোনো হুকুম বা ইশারা তামিলের জন্য সবচেয়ে কাছে মজুদ বা প্রাপ্য অফিসারই হতেন ব্যাটালিয়নের ইন্টেলিজেন্স অফিসার; আমিই ছিলাম ইন্টেলিজেন্স অফিসার। আনুষ্ঠানিকভাবে (আলবৎ উপরোক্ত ব্রিগেডিয়ারকে দেখানোর জন্য), কর্নেল মাসুদুল হুকুম দিলেন সেকেন্ড বেঙ্গলের ‘ডি’ বা ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেনকে। এটা ছিল একটা চরম স্পর্শকাতর পরীক্ষা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্নেল, বাঙালি মেজর তথা অফিসাররা, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সিনিয়রদের নির্দেশে জয়দেবপুরের বাঙালি জনতার ওপর গোলাগুলি চালায় কি না- এটাই ছিল দেখার বিষয়। ওইরূপ উদ্বেগসঙ্কুল পরিস্থিতিতে মেজর মইনুল হোসেন ও তার সঙ্গী অফিসাররা ও জ্যেষ্ঠ সৈনিকরা অনেক কৌশলগত পদক্ষেপ নেন।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বুঝ দেয়ার জন্য, জনগণকে লক্ষ করে গুলি না ছুড়ে, বরং গাছের আগায় ও কচুরিপানা লক্ষ করে অল্প গোলাবর্ষণ করা হয়। অপরপক্ষে স্থানীয় হাজার হাজার বিক্ষুদ্ধ জনতাও কঠিন পরীক্ষার সামনে ছিল। তারা চাচ্ছিল, পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদলকে আক্রমণ করতে বা পর্যুদস্ত করতে। কিন্তু পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদল এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদল রেললাইনের একই দিকে থাকায়, বিক্ষুদ্ধ জনগণের পক্ষেও সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। জনগণ তাদের কাছে যেকোনোভাবেই রাখা বা পাওয়া স্থানীয় বন্দুক এবং একটি মারাত্মক ঘটনার মাধ্যমে পাওয়া পাঁচটি চাইনিজ রাইফেলের দু-একটি ব্যবহার করে। স্থানীয় জনতা পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদেরকে লক্ষ করে গোলাগুলি করে। বাঙালি মেজর মইনুলকে ব্রিগেডিয়ার আরবাব, কর্নেল মাসুদুলের সামনেই অনেক ধমকা-ধমকি করেন এবং শাস্তির ভয় দেখান এই মর্মে যে, ‘কী গোলাগুলি করলে যে, এখনো ১০টা লোকও মরে নাই?’ মেজর মইনুলও মোটামুটিভাবে কৌশলগত কথার ইশারায় জানিয়ে দিলেন, নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর গোলাগুলি করা যাবে না; আমরা বাঙালিদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে গুলি করব না। ব্রিগেডিয়ার আরবাব অফিসারদের গ্রেফতার করার ভয় দেখালেন এবং অধিনায়কের ও অফিসারদের কোর্ট মার্শাল করার ভয় দেখালেন, ব্যাটালিয়ন ভেঙে দেয়ার ভয় দেখালেন; কিন্তু মেজর মইনুল অধিনায়কের সামনেই অর্থাৎ অধিনায়কের মৌন সম্মতিতে, ব্রিগেডিয়ারের কথা অগ্রাহ্য করলেন।
যখন ব্রিগেডিয়ার ধমকা-ধমকি করছিলেন, তখন সব বাঙালি অফিসার চেহারায় ও অভিব্যক্তিতে আরো বিদ্রোহী হয়ে উঠছিলেন; সেকেন্ড বেঙ্গলের বাঙালি সৈনিকরা অবস্থা আঁচ করতে পেরে, পাকিস্তানিদের ওপর রাগান্বিত ও উত্তেজিত হচ্ছিলেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে, পরিস্থিতির যেন আরো অবনতি না হয়, তাই সেকেন্ড বেঙ্গলের জ্যেষ্ঠ অফিসাররা এবং স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা উদ্যোগ নিলেন পাকিস্তানিদের আড়ালে রেখে। সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে অনেকেই এখনো জীবিত আছেন এবং তাদের মধ্যে দুইজন অতি সুপরিচিত; যথা- একজন হলেন বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং অপরজন হলেন বর্তমান মন্ত্রিসভায় মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রী, আ ক ম মোজাম্মেল হক। তৃতীয়জন (সাবেক এমপি আবদুল মোত্তালিব চৌধুরী) এখন জীবিত নেই। তিনি ছিলেন শ্রমিক নেতা ও সংগঠক আবদুল মোত্তালিব চৌধুরী। এই তিনজন সাতদিন পরও সেকেন্ড বেঙ্গলকে সাহায্য করেছিলেন। সংগ্রাম পরিষদের পৃষ্ঠপোষক ও শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিক্ষানুরাগী প্রভাবশালী সামাজিক নেতা কাজী আজিম উদ্দীন।
সঙ্কটের পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া
প্রায় দুই ঘণ্টার অধিক সময়ের খণ্ডযুদ্ধের পর, বিক্ষুব্ধ জনতা সম্মত হয়েছিল মালগাড়ির খালি বগিগুলো সরিয়ে নিতে। ফলে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সকালে আগত সেনাদল ঢাকা ফেরত যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। যাওয়ার পথে তারা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনরত বাঙালিদের ওপর গোলাগুলি করে এবং এতে অনেক মানুষ নিহত হয়। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন এবং ঢাকা চলে আসতে হুকুম করেন। উপরে উপরে বা আনুষ্ঠানিকভাবে যে অজুহাতই দেয়া হোক না কেন, আসল কারণ ছিল ওইটা, যেটা ওই সময়ে প্রকাশ করা হচ্ছিল না যথা পাকিস্তানিদের মূল্যায়নে সেকেন্ড বেঙ্গল মনেপ্রাণে বিদ্রোহী হয়ে গেছে এবং তাদের অধিনায়ককে অপসারণ করলে তাদের সক্ষমতা কমে যাবে। ২৩ মার্চ কর্নেল মাসুদুল চলে যান এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত জনৈক বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিবকে সেকেন্ড বেঙ্গলের নতুন অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়।