মাওলানা আজমল এবং আসাম নির্বাচনের সমীকরণ
মাওলানা আজমল - ছবি সংগৃহীত
আমাদের মাওলানা ভাসানী আসামের যে জায়গা থেকে 'ভাসানী' খেতাব পেয়েছিলেন ঠিক ওই ধুবড়ির নেতা মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল। কৃষক থেকে সুগন্ধির সওদাগর বনে যাওয়া হাজী আজমল আলীর ছেলে বদরুদ্দীন আজমল। বাবার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার কাজ দেখাশোনা করতেন তিনি, পাশাপাশি বিভিন্ন মানবহিতৈষী কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ২০০৫ সালে অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইডিএফ) নামে একটি দল গঠন করেন দারুণ উলুম দেওবন্দ থেকে ধর্মতত্ত্ব ও আরবির উপর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করা এই মুসলিম নেতা।
ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে আসামে সর্বাধিক মুসলিম জনগোষ্ঠী থাকার পরও তাদের কোনো উপযুক্ত মুখপাত্র ছিল না। বদরুদ্দীন আজমল রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পর ওই শূন্যস্থান পূরণ হয়। এরপর তিনি ধুবড়ি থেকে পরপর তিনবার লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। জায়গা পেয়েছেন বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিম ব্যক্তিত্বের তালিকায়।
.
বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেষা ভারতের দুই রাজ্য আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে একই সময় বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এই ভারতের এই দুটি রাজ্যের নির্বাচন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি আসাম থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে প্রচার করে আসছে, অসমীয়ারাও তাই মনে করেন। এই মুসলিমদের সেখান থেকে বিতাড়িত করার জন্য বিজেপি জারি করেছে এনআরসি-সিএএ'র হুলিয়া।
১২৬ আসনের আসাম বিধানসভা নির্বাচনের দিন তারিখ ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। তিন ধাপে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যার প্রথম পর্বের ভোটগ্রহণ হবে ২৭ মার্চ। ১২৬ আসনের মধ্যে ৬০টিতে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল বিজেপি। যেখানে বদরুদ্দীন আজমলের দল ৭৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পেয়েছিল ১৩টিতে। অপরদিকে কংগ্রেস পেয়েছিল ২৬টি আসন। এবারের নির্বাচনে বিজেপির আজমল আতঙ্কের মূল কারণ হচ্ছে কংগ্রেসের সাথে এআইডিএফের জোট গঠন। ২০১৬ সালে কংগ্রেস আর এআইডিএফ আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিল। কিন্তু এবার বিজেপি আটকানোর জন্য জোট বেঁধেছে ১০ দলের মহাজোট গঠন করেছে কংগ্রেস। যেখানে মূল খেলোয়াড় কংগ্রেস ও এআইডিএফ।
বর্তমান বিজেপি জোটের দলগুলো ২০১৬ সালে একত্রে ৩৭.৬৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। যেখানে বর্তমান কংগ্রেস জোটের দলগুলো পেয়েছিল ৪৭.৯৫ শতাংশ ভোট। সর্বশেষ নির্বাচনের হিসেবে কংগ্রেসের মহাজোট অনেক এগিয়ে রয়েছে। পাঁচ বছর পর হিসেব নিকেশ আমূল বদলে যেতে পারে। তবে এ কথা সত্য যে এবার আসাম নির্বাচনে বিজেপির সরকার গঠন করা সহজ হবে না।
.
বিজেপির মূল টার্গেট হয়েছেন বদরুদ্দীন আজমল। তাকে আক্রমণ করেই বক্তব্য দিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। এমনকি তার বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দায়ের করারও চেষ্টা করছে বিজেপি। তুরস্ক ও যুক্তরাজ্যের কিছু সংস্থা, যারা বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থায়ন করেছে সেই সকল সংস্থা আজমলের এনজিওকে ফান্ডিং করছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। একই সাথে আজমলকে আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের জনক হিসেবে অভিহিত করেছেন বিজেপি নেতা সত্যরঞ্জন বোরা। শুধু অভিযোগ তুলেই বসে থাকেননি, গুয়াহাটির এক থানায় এফআইআরও করেছেন বোরা।
আজমলকে নিশানা করার অসংখ্য কারণ রয়েছে। আসামের প্রায় ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী মুসলিম। যাদের প্রায় সকলের ভোট যাবে এআইডিএফ আর কংগ্রেসের পক্ষে। যদিও তাদের ভোটের ধার ধারে না বিজেপি। কারণ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা এই মুসলিমরা কখনোই তাদের ভোট দিবে না। কিন্তু এই ভোটাররা প্রায় ৩৩টি আসনের নীতি-নির্ধারক। গত নির্বাচনে এই আসনগুলোর মধ্যে ১৭টিতে জয় পেয়েছিল কংগ্রেস আর ১২টিতে এআইডিএফ। আজমলের দল আর কংগ্রেসের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হওয়ার কারণে ৪টি আসনে জয় পেয়েছিল বিজেপি। এবারের নির্বাচনে সেই চারটি আসনে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিজেপির। কেননা আসামে মুসলিমদের জোট খুবই শক্ত।
২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি জোট আসন পেয়েছিল মোট ৮৬টি। এর মধ্যে বিজেপি ৬০টি, আসাম গণপরিষদ (এজিপি) ১৪টি এবং বোদোল্যান্ড পিপল'স ফ্রন্ট (বিপিএফ) ১২টি আসনে জয় পায়। আসামের নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণার পরই বিজেপি ছোট ছেড়ে দিয়ে কংগ্রেস-এআইডিএফের সাথে যোগ দিয়েছে হাগরামা মোহিলারির বিপিএফ।
এই দলটি আসামের বৃহৎ আধিবাসী জনগোষ্ঠী বোদোদের প্রতিনিধিত্ব করে। রাজ্যের ৫-৬% ভোট তাদের দখলে। ফলে মোহিলারি জোট ত্যাগ করায় আরো চাপের মুখে পড়েছে বিজেপি। যদিও তারা বোদোল্যান্ডের আরেক দল ইউনাইটেড পিপল'স পার্টি লিবারেলের সাথে জোট গঠন গঠন করেছে। কিন্তু বোদোদের মধ্যে মোহিলারির প্রভাব অনেক বেশি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ১৩ আসনে নির্বাচন করে তারা হেরেছিল মাত্র একটিতে।
বিজেপির জন্য এই নির্বাচন আরো কঠিন হতে পারে সিএএ'র কারণে। মোদি সরকারের এই আইন, অসমীয়াদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। বিজেপির মূল ভোট ব্যাঙ্কই এই অসমীয়ারা, যারা প্রায় ৩৬টি আসনের নীতি-নির্ধারক। গত নির্বাচনে এই আসনগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি পেয়েছিল কংগ্রেস। সিএএ'র ক্ষোভ থেকে কেন্দ্র করে গত বছর আসাম জাতীয় পরিষদ (এজেপি) নামে নতুন একটি দল গঠিত হয়েছে যারা আঞ্চলিক দলের সাথে জোট গঠন করেছে। এজেপিকে শক্তি যোগাচ্ছে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ও অসম যুব ছাত্র পরিষদ। বিজেপিবিরোধী হলেও কংগ্রেসের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নতুন জোটটি। কারণ তাদের জন্য বিজেপিবিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাবে। সেজন্য এজেপি আর আঞ্চলিক জোটকে হাত মেলানোর প্রস্তাব দিয়েছে কংগ্রেস। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি।
.
এবারের নির্বাচনে বিজেপি আবার তাদের পুরোনো অস্ত্র ব্যবহার করছে। তারা আগেরবারের মতো প্রচার করছে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি মুসলিমরা আসামের প্রকৃত জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকি। বিজেপি এই রাজ্যেও হিন্দু আর মুসলিমদের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সফএ হয়েছে। হিন্দুদের হৃদয় জয় করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল কিছু মুসলিম বিরোধী সিদ্ধান্তও নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, সেই সাথে 'মিয়া' জাদুঘর (আসামে মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বোঝাতে 'মিয়া' শব্দটি ব্যবহার করা হয়) স্থাপনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন।
এর বাইরে বিজেপিকে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশা জাগাচ্ছে সোনোয়াল সরকারের বেশ কিছু জনবান্ধব সিদ্ধান্ত। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা এনেছেন, করোনা পরিস্থিতিও বেশ ভালোভাবে সামাল দিয়েছেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আজমলের দলের সাথে কংগ্রেসের জোটকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না তাদের দলেরই কিছু নেতা। কংগ্রেসের অনেক নেতা মনে করছেন এআইডিএফের সাথে জোট গঠন করায় বিজেপির পক্ষে কংগ্রেসকে অসমীয়া বিরোধী হিসেবে দেখানো সহজ হবে। বিজেপি প্রচার করছে একমাত্র সিএএ কার্যকরের মাধ্যমেই আজমলের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পথ রুদ্ধ করা সম্ভব। এছাড়া বাংলা ভাষাভাষী যে সকল হিন্দু আছেন তারা কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক এবং তারাও সিএএ'র পক্ষে। এআইডিএফের সাথে জোট করার ফলে কংগ্রেস তাদের ভোট হারাতে পারে।
কংগ্রেসের মহাজোটে দলগুলো রয়েছে তারা প্রায় ৫০টি আসনে এগিয়ে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন আরো ১৪টি আসন। আসামে জাতিগত অনেক ভাগ থাকায় সেখানকার আসনগুলো নির্দিষ্ট দলের পক্ষে যায়। এখন সিএএকে কেন্দ্র করে নতুন যে বিজেপি বিরোধী মত তৈরি হয়েছে সেই ভোটগুলো কংগ্রেসের পক্ষে গেলে বিজেপির জন্য সরকার গঠন করা কঠিন হয়ে যাবে। মুখ্যমন্ত্রী পদে কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেনি কংগ্রেস জোট। যার ফলে বিজেপি প্রচার করছে কংগ্রেস জিতলে মুখ্যমন্ত্রী হবেন বদরুদ্দীন আজমল। যা অসমীয়া প্রধান আসনগুলোতে কংগ্রেসের লড়াই আরো কঠিন করে তুলতে পারে। যদিও আজমল ঘোষণা করেছেন তিনি মুখ্যমন্ত্রী হতে চান না।
আজমলকে নিশানা করার মাধ্যমে বিজেপি মূলত হিন্দু ও অসমীয়া ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। ধর্মের খেলা না খেললে বিজেপির ক্ষমতায় থাকা কঠিন। আজমল একদিকে মুসলিম নেতা, অপরদিকে অসমীয়াদের দৃষ্টিতে অনুপ্রবেশকারীদের মেরুদণ্ড। তাই মাওলানা বদরুদ্দীন আজমলকে ঘিরেই বিজেপির ভোটের রণনীতি।