খাঁটি দুধেও লোকসান!
দুধের দাম নিয়ন্ত্রণে লোকসানে জর্জরিত পাবনার খামারিরা - ছবি : অন্য এক দিগন্ত
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের বাথানগুলোর দিগন্ত বিস্তীর্ণ ভূমিতে উন্নতজাতের লক্ষাধিক গরু বিচরণ করছে। প্রায় দুই লাখ পরিবার এই গরু পালনের ওপর নির্ভরশীল। বাথান থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ করা হচ্ছে প্রায় এক লাখ লিটার কীটনাশক ও মেলামাইনমুক্ত খাঁটি তরল দুধ। ভোক্তাপর্যায়ে এই দুধের চাহিদা প্রচুর। খোলাবাজারে প্রতি লিটার তরল দুধ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও খামারিরা চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় তারা এই দুধ সরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটায় সরবরাহ করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন। বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা ও বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধের দাম দিচ্ছে মাত্র ৩৮ থেকে ৪৩ টাকা। তারা দুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখায় অব্যাহত লোকসানের শিকার হতে হতে গোখামারিদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। অথচ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এত কম দামে এই দুধ কিরে বিক্রি করে প্রতি কেজিতে লাভ করছে ৬২ টাকা। এ পরিস্থিতিতে কৃষকদের অনেকেই গরু বিক্রি করে অন্য পেশা চলে যাচ্ছেন।
এক শতাব্দী আগে থেকেই পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের গোখামারি ও কৃষকরা উন্নতজাতের জার্সি, ফ্রিজিয়ান, এফএস, শাহিওয়াল, সিন্ধি, হরিয়ানা ও মুলতানি গরু লালন পালন করে আসছেন। এ অঞ্চলের গো-সম্পদকে অর্থকরী সম্পদে রূপ দিতে স্বাধীনতার পর বাঘাবাড়িতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা করখানা স্থাপন করা হয়।
এদিকে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির দৌরাত্ম্যে মিল্কভিটার আওতাভুক্ত বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। প্রভাবশালীরা গো-চারণ ভূমির প্রায় ৫৫০ একর জমি জাল দলিল ও পত্তনির মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে। সেসব জমিতে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। বর্তমানে ব্যক্তিপর্যায়ে খাস জমি ও মিল্কভিটার নিয়ন্ত্রণাধীন বাথান অঞ্চল যেটুকু রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাথানে গরুর বিচরণ ও দুধ উৎপাদন অনেক কমে গেছে। বিগত বছরগুলোতে বাথানে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হতো। বর্তমানে দুধের উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ লিটার।
জানা যায়, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি-নিমাইচরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের রাউতরার কাছে অস্থায়ীভাবে নির্মিত বিকল্প রিং বাঁধটি প্রতি বছর আগাম বন্যায় ভেঙে তলিয়ে যায় গো-চারণভূমি। অথচ আধা কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হলে গবাদিপশু বছরে নয় থেকে ১০ মাস বাথানে সবুজ ঘাস খেতে পারত। খামারিদের লাখ লাখ টাকা সাশ্রয় হতো। গো-খাদ্যে খড়, ভুসি, খৈল, লালির উচ্চমূল্যের কারণে খামারিরা আর পুষিয়ে উঠতে পারছেন না।
অনেক খামারি অভিযোগ করে বলেন, মিল্কভিটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অথচ খামারিদের তেমন লাভ হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে দুধের মূল্যবৃদ্ধির দাবি করে এলেও কার্যকর হচ্ছে না। সরকারি বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধের দাম না বাড়িয়ে দুধ সংগ্রহের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে বলে খামারিরা অভিযোগ করেছেন। মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো গো-সম্পদ উন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে ঐতিহ্যবাহী গো-সম্পদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
মিল্কভিটাসহ বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে চার দশমিক শূন্য স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ বোনাসসহ ৪৩ টাকা দরে কিনে সেই দুধ থেকে ননী বের করে নিচ্ছে। পরে তিন দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ প্যাকেটজাত করে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছে। তবে ভোক্তাপর্যায়ে এ দুধ বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা লিটার। প্রতি লিটার দুধ থেকে শূন্য দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননী তুলে ঘি তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রতি লিটার দুধে লাভ হচ্ছে ১৫ টাকা। এ ছাড়া এক লিটার দুধ থেকে ৪৫ টাকার প্রায় ৪০ গ্রাম ঘি উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধে আয় করছে ৯০ টাকা। এতে প্রতি লিটার দুধে তারা প্রায় ৬২ টাকা লাভ করছে। অপর দিকে অব্যাহত লোকসানের মুখে কৃষক ও খামারিরা অনেকেই খামার বন্ধ করে দিয়েছেন।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে চলনবিল অঞ্চলের বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলায় ৪০০টি বাথানে প্রায় পাঁচ হাজার একর গোচারণ ভূমি ছিল। জাল দলিল ও ভুয়া পত্তন নিয়ে এলাকার একাধিক প্রভাবশালীরা গো-চারণ ভূমি আত্মসাৎ করেছে। শাহজাদপুর উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে গো-চারণ ভূমির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৪০০ একর। এর মধ্যে ফরিদপুর উপজেলায় প্রায় ১০০ একর খাস এবং শাহজাদপুর উপজেলায় ৭১২ দশমিক ৬৮ একর সমর্পিত খাস ও ৫৭৯ দশমিক ১৬ একর অর্পিত গো-চারণ ভূমি রয়েছে। মিল্কভিটার ম্যানেজার সোসাইটি জানান, মাত্র ৮৫০ একর জমি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অবশিষ্ট ৫৫০ একর জমি ভুয়া দলিল ও পত্তনের মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। তিনি জানান, ব্যক্তিমালিকানাধীন গোচারণ ভূমির পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার একর। অনেকে গোচারণ ভূমি বোরো আবাদে ব্যবহার করছেন। যে কারণে গো-চারণ ভূমি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। ফলে বিশাল এ গো-সম্পদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা অনিশ্চয়তা।
বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ ডেইরির সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ীতে অবস্থিত আঞ্চলিক সংগ্রহ কেন্দ্রেরের ম্যানেজার ইফতেখার জানান, তাদের রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চল থেকে প্রতিদিন দেড় লাখ লিটার তরল দুধ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাহিদার তুলায় সরবরাহ কম থাকায় প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে মাত্র এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার লিটার।