হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বনাম আসামের মুসলিম সম্প্রদায়
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা - ছবি সংগৃহীত
গতবার ভারতের আসাম রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে বিরোধীরা জোটবদ্ধ হতে না পারায় বিজেপি বিপুলভাবে জিতেছিল। এবার কিন্তু রাজ্যটিতে বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়েছে। কংগ্রেস– এআইডিইউএফ– সিপিআই– সিপিএম– বোড়োদের একটি দল সবাই মিলে জোটবদ্ধ হয়েছে দ্বিতীয়বার বিজেপির আসাম জয়কে রোখার জন্য। তার ওপর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সিএএ প্রয়োগ করার কখা ঘোষণা দিলে সামগ্র অসম অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। শুরু হয় প্রবল আন্দোলন। সিএএ মানতে অহমীয়ারা কিছুতেই রাজি নন। তাদের ধারণা– এই আইন আসামে প্রয়োগ করা হলে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী হিন্দু আসামে এসে বসত করতে চাইবে। আর তাতেই তাদের আপত্তি। তাই এবার বিজেপির অসম জয় গতবারের মতো মসৃণ হবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
আসামে বিজেপি ও আরএসএস’এর মহারথী হচ্ছেন অগ্নিবর্ষণকারী মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। তার অতীত সম্পর্কে অনেকে বলেন, প্রথমে তিনি ছিলেন আলফা ও সালফা’র সমর্থক। পরে তিনি কংগ্রেসে আসেন এবং মন্ত্রী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন– বর্ষীয়ান তরুণ গগৈয়ের পর তার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নেই– গোঁসা করে তিনি যোগ দেন বিজেপিতে। আর বিজেপিতে এসেই তিনি উপলব্ধি করতে পারেন– এটাই হলো তার আসল ঠিকানা। দেখা গেল– হিমন্ত বিশ্ব শর্মা টেক্কা দেয়ার ক্ষেত্রে পিতৃ-সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের কট্টর নেতাদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে তার জুড়ি মেলা ভার। বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি বলছেন– ‘কে আপনাদের শত্রু? হিন্দু না মুসলমান?’ জনতাকে তিনি বলিয়ে ছাড়ছেন– মুসলিমরাই হচ্ছে আসল শত্রু। তিনি ঘোষণা করেন– মুসলিম– বিশেষ করে মিয়া মুসলিমদের ভোট তার প্রয়োজন নেই। এই মিয়া মুসলিমরা নাকি মূলত ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’। মুসলিমদের বিরুদ্ধে অসমীয়া হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য তিনি এক থিয়োরি খাড়া করেছেন। আর তা হলো– বঙ্গীয় মূলের মুসলিমরা নাকি আসামের ভাষা– সংস্কৃতি– সভ্যতা সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে– বিনষ্ট করে দিচ্ছে। এই ধরণের সম্প্রদায়ভিত্তিক নিশানা এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচার করার জন্য তার বিরুদ্ধে এফআইআরও হয়েছে। কিন্তু হিমন্ত বিরত হননি। বরং আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন উগ্র বিদ্বেষ ও বিভাজননীতিকে। তার প্রধান হাতিয়ার ব্যবহার করে তিনি বলছেন– হে আসামবাসী– রাজ্যের মুসলিমরা তোমাদের প্রাণপ্রিয় অহমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনাশ করে দিচ্ছে। যারা এই মুসলিমদের ক্ষমতাহীন করে বহিষ্কার করবে তাদের অর্থাৎ বিজেপিকেই তোমরা ভোট দাও।
কিন্তু একটু চিন্তা করে তথ্য-তালাশ করলে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র সামনে আসবে। অসমের বরাক উপত্যকার কাছাড়– করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি বাদ দিলে আসামের মুসলিমরাই কিন্তু অহমীয়া ভাষাকে রক্ষা করে চলেছে। বঙ্গীয় মূলের এই অসমীয়া মুসলিমরা জনগণনায় সব সময় মাতৃভাষার প্রশ্নে ‘অহমীয়া’ ভাষাকেই নিজেদের ‘মাতৃভাষা’ বলে ঘোষণা করে আসছেন। আসামে বসবাসীকারী হিন্দু বাঙালিরা সর্বদাই নিজেদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’ বলে আদমশুমারিতে ঘোষণা দিয়ে থাকেন। বাঙালিরা মনে করেন– বঙ্কিমচন্দ্র– রবীন্দ্রনাথের বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ– শ্রেষ্ঠ। তাই তারা এই ভাষাকে পরিত্যাগ করতে পারবেন না।
কিন্তু আসামের বঙ্গীয় মূলের মুসলমানরা প্রথম থেকেই প্রদেশের ভাষা অহমীয়াকে ভালবেসে আদমশুমারিতে নিজেদের ‘অহমীয়াভাষী’ বলে নথিভুক্ত করে চলেছেন। তারা পড়াশোনাও করেন অহমীয়া মাধ্যমের স্কুল ও মাদরাসায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে নিজেদের মাতৃভাষা ত্যাগ করে অন্য ভাষাকে আপন করে নেওয়ার এটি দ্বিতীয় উদাহরণ। এর আগে ইসলামের আগমনের পর মিশরের লোকেরা নিজেদের স্থানীয় ভাষা ছেড়ে আরবি ভাষাকে তাদের মাতৃ-জবান করে নেয়। এটা যে কত বড় ত্যাগ– তা সচেতন মানুষ মাত্রেই অনুভব করতে পারবেন। নিজেদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) মানুষের শাহাদতবরণ এবং দীর্ঘ আন্দোলনের কথা সকলেরই জানা।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা’র হয়তো জানা নেই– আসামের বঙ্গীয় মূলের মুসলমানদের কারণেই অহমীয়া ভাষা এখনো রাজ্যের ‘প্রধান ভাষা’ হিসেবে টিকে রয়েছে। কারণ– আসামে অহমীয়াভাষীদের যা সংখ্যা তাতে বঙ্গীয় মূলের মুসলিমরা না থাকলে অহমীয়াভাষা বিপুলভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়ত। নিজভূমে অহমীয়াভাষীরা হয়ে পড়তেন সংখ্যালঘু।
অনেকে একটি উদাহরণ দিয়ে থাকেন। ত্রিপুরা রাজ্যে ছিল মূলত ট্রাইবাল বা আদিভূমিপুত্র উপজাতিদের প্রাধান্য। কিন্তু ৪৭-এ স্বাধীনতার পর প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্যাপকভাবে হিন্দু বাঙালিরা ত্রিপুরায় অনুপ্রবেশ করতে থাকে। তারপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তারপরে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী হিন্দু ত্রিপুরায় ঢুকে পড়ে। ফলে ত্রিপুরায় আদি অধিবাসী ট্রাইবালরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। আজকের দিনে ত্রিপুরার প্রধান প্রাদেশিক ও সরকারিভাষা হচ্ছে বাংলা। এক্ষেত্রে ত্রিপুরার ট্রাইবালদের উপস্থিতি এখন নেই বললেই চলে।
আসামের অবস্থা ও পরিণতিও ত্রিপুরার মতোই হতো– যদি না বঙ্গীয় মূলের মুসলিমরা অহমীয়াভাষকে নিজেদের মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা না করতেন। বঙ্গীয় মূলের মুসলমানদের এই ত্যাগকে উপলব্ধি ও স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে বিজেপি-র হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাদের বিরুদ্ধে মারাত্মক ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন ও সন্ত্রাসের ভাষা প্রয়োগ করছেন। আসলে হয়তো হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অহমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার পরিবর্তে তাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে চান। অহমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত করতে চান। হয়তো বা তিনি আরএসএস-এর থিয়োরি ও শ্লোগান ‘হিন্দু- হিন্দি-হিন্দুস্তান’-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী আসামেও হিন্দিকেই চাপিয়ে দিতে চান। নইলে প্রায় ৮০ লাখ বঙ্গীয় মূলের অহমীয়াকে তিনি কেন ‘মিয়া’ বলে অভিহিত করবেন? তিনি তাদের অহমীয়া ভাষা ছেড়ে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করার জন্য প্রকারান্তরে প্ররোচিতই করছেন।
বোড়ো উপজাতিরা সংখ্যার বিচারে আসামে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছেন– তারা ইতিমধ্যে অহমীয়া ভাষা ত্যাগ করে নিজেদের উপজাতি ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এখন শুধু বঙ্গীয় মূলের মুসলিমরাই অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের ‘প্রধানভাষা’ হিসেবে রক্ষা করে চলেছেন। অথচ হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এবং তার সহযোগী বিজেপি ও আরএসএস-এর কর্মকর্তারা এই বঙ্গীয় মূলের অহমীয়াদের আসামের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য ‘বিপদ’ হিসেবে প্রচার করছেন । হিমন্ত বিশ্ব শর্মা যেদিন বুঝবেন এই মুসলমানরা বিরূপ হলে অহমীয়া ভাষা আসামের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষাতে পরিণত হবে সেদিন কিন্তু অসমের জনগণ তাকে ক্ষমা করবে না। হিমন্ত একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িকতা প্রচর করে চলেছেন– অন্যদিকে তিনি অহমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে কার্যত ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছেন। আর তার উগ্র বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতাগুলো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হলেও আসলে কিন্তু তা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান সকল অহমীয়াভাষীর জন্য এক ‘মহাবিপদ’ ডেকে আনছে।
সূত্র : পুবের কলম