কী হচ্ছে মিয়ানমারে?

কী হচ্ছে মিয়ানমারে? - ছবি সংগৃহীত
রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে জাতিগত উৎখাতের ‘পাঠ্যবই দৃষ্টান্ত’ বলে বর্ণনা করেছে জাতিসঙ্ঘ। তাদের ওপর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলেও জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা স্বীকৃতি দিয়েছে। অপরাধ হিসেবে এটি বর্তমান সভ্যতার ইতিহাসে বৃহৎ একটি ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু সভ্য জাতিগুলো এ মানবতাবিরোধী অপরাধ মোকাবেলায় সাড়াদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতারণা করেছে। যারা এই অপরাধ করেছে এবং করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে কেউ জোরালো অবস্থান নেয়নি। শেষ পর্যন্ত এই অপরাধীরা মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছে।
সবমিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে মানবেতর জীবন যাপন করছে। দেশহীন এ বিপুল মানুষের শেষ পর্যন্ত কী হবে কেউ জানে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতারণাকে মিয়ানমারের অপরাধী জেনারেলরা অত্যন্ত সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব আনা হয়। ওই প্রস্তাবে দেশটির ওপর অবরোধ আরোপ এবং আরো কিছু ধারাবাহিক বিধিনিষেধ আরোপের বিষয় উত্থাপন করা হয়। যদি দেশটি রোহিঙ্গা সঙ্কট উত্তরণে অগ্রগতি অর্জন করতে না পারে তাহলে সেগুলো প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছিল। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিয়ে মিয়ানমার যাতে জাতিসঙ্ঘের সাথে সমান্তরালে কাজ করে সেই লক্ষ্যও ছিল ওই প্রস্তাবে।
স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র রাশিয়া ও চীন এই প্রস্তাব ভণ্ডুল করে দেয়। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত চীনের প্রতিনিধি ওই সময় এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। কেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না সে ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন করার মতো নৈতিক শক্তি সম্ভবত তার ছিল না। রাশিয়ার প্রতিনিধির মন্তব্য ছিল বিস্ময় জাগানোর মতো। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, এটি অযথার্থ, অসময়োচিত ও অপ্রয়োজনীয়।’ রাশিয়া কেন এতটা বোল্ডলি গণহত্যা চালানো একটি দেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে সাফাই গাইল বোঝা গেল না। নিরাপত্তা পরিষদ সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি মাত্র বিবৃতি দিতে পেরেছিল; সেটি ২০১৮ সালের অক্টোবরে। ওই বিবৃতিতে নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য অভিযুক্ত করা হয়। এরপর থেকে বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী সংস্থাটি ‘শীতনিদ্রায়’ রয়েছে।
গত বছরের একেবারে শেষে অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ৭৫তম সম্মেলনে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আশঙ্কাজনক অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ ২৫ দফা প্রস্তাব ছিল তাতে। বরাবরের মতো নিরাপত্তা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য চীন ও রাশিয়া এটিকে ঠেকিয়ে দিয়ে ঘাতক মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বন্ধু ভারত ভোটাভুটিতে ‘নিরপেক্ষ’ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে। এমনকি ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধু এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান ও শ্রীলঙ্কাও এ ব্যাপারে ভারতের প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করে। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে এ দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। তারা এ উপলক্ষে আয়োজিত আনন্দ অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছেন।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এবারের ঢাকা সফরে অন্তত রোহিঙ্গা সঙ্কট গুরুত্বপূর্ণভাবে আলোচনার টেবিলে থাকা উচিত ছিল। কারণ ভারতের পছন্দের ব্যক্তি সু চি এখন ক্ষমতাচ্যুত। এ অবস্থায় নিজেদের সমর্থনকে আড়াল করে গণতন্ত্রপন্থী সু চিকে সুবিধা দেয়ার যে ব্যাপার ছিল সেটা তো এখন আর নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে বেকায়দায় ফেলার এখন সময়। এর মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পক্ষেও কিছুটা কাজ হয়ে যেত। বাস্তবে এমনটা হবে বলে মনে হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো ইস্যু নয় বরং মোদি আমাদের আমন্ত্রণে আসছেন এতেই আমরা খুশি।
অন্যদিকে মিয়ানমার কিন্তু জঘন্য অপরাধ করার পরও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে ঠিকই সবসময় নিজের পক্ষে রাখতে সমর্থ হয়েছে। সাধারণ পরিষদেও ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম ন্যায়ের প্রতি সমর্থনের চেয়ে ‘বন্ধুত্বের মর্যাদা’কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। অন্যদিকে, আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের ন্যায়ের পক্ষে থাকার জন্যও পাশে পাচ্ছি না। এটি আরেকটি ধাঁধা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে।
রোহিঙ্গা সঙ্কট বিশ্বব্যবস্থার চরম অনৈতিকতাকে স্পষ্ট করে প্রকাশ করে দিয়েছে। গুটিকয়েক মানবাধিকার সংস্থা নিয়মিত বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছে। কিছু সাহায্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভরণ পোষণের নিয়মিত ব্যবস্থা করেছে। এ ক্ষেত্রে কিছু দেশের নামও উল্লেখ করা যায় যারা রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তরিকতা দেখিয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোনো পক্ষকে নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ পাওয়া যাবে না। এই সঙ্কট সমাধানের জন্য, ইউরোপ ও আমেরিকার নেয়া পদক্ষেপ মিয়ানমারের সাঁড়াশি সামরিক বাহিনীর বিপরীতে দুর্বল ও মৃদু মনে হয়েছে। বাংলাদেশ তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশ নিজেও মিয়ানমারের আগ্রাসী তৎপরতার বিপক্ষে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। দেখা গেছে, আমরা চাল-ডালের জন্যও মিয়ানমারের ওপর আমাদের নির্ভরতা দেখিয়েছি। তারা আমাদের বিপুল ক্ষতি করার পরও আমরা গায়ে পড়ে তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করছি।
অথচ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের উৎখাত করেই ছাড়েনি; তারা আমাদের সীমান্তে আক্রমণাত্মক সামরিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। নিয়মিত সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে চলেছে। তাদের যুদ্ধবিমান আমাদের দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। সেন্ট মার্টিনকে তারা নিজেদের ভূখণ্ড বলে মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করছে বারবার।
ভালো ব্যবহার ও মুখের ভাষা দিয়ে সামরিক কার্যক্রম ঠেকানো যায় না। এ জন্য একই ধরনের বিপরীত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র্র হিসেবে কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধের উন্মাদনা দেখাতে পারে না। কিন্তু ন্যূনতম সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শনের কি প্রয়োজন নেই? আমরা মিয়ানমারের সামরিক ও যুদ্ধংদেহী তৎপরতাগুলো সামান্য বেসামরিক প্রতিবাদের মাধ্যমে জবাব দিচ্ছি। আমাদের সর্বোচ্চ প্রয়াস হচ্ছে মিয়ানমার দূতাবাসের কর্মকর্তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করা, এটুকুই। পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং দেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা তৎপরতা জোরালোভাবে দৃশ্যমান করা প্রয়োজন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধ প্রস্তুতির তুলনায় আমরা পিছিয়ে নেই এমনটা তো তাদের বুঝাতে হবে। তারা কামান দাগিয়ে জনপদ ধংস করে দিয়ে লাখ লাখ উদ্বাস্তুর স্রোত বইয়ে দিয়েছে। আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এই উদ্বাস্তুদের খাবার সরবরাহ করা, বাসস্থান তৈরি করা ও তাদের রেকর্ড সংরক্ষণের কাজ করছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী যদি বুঝতে পারত বাংলাদেশের একটি বাহিনী রয়েছে, তারা শুধু বেসামরিক উদ্বাস্তু লোকজনের ব্যবস্থাপনা নয়; সামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে সাহসী কায়দায় যুদ্ধ করতেও সক্ষম- তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রতিকার পেতে সহজ হতো নিশ্চয়ই।
মিয়ানমারের সাথে প্রায় সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিনিয়োগ গত এক দশকে দেশটিতে দ্রতগতিতে বেড়েছে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তাদের সামরিক বাহিনীর গণহত্যার পরও সেটা স্বাভাবিক রয়েছে। সামরিক বাহিনীর যেসব জেনারেল রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ ও আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই। তারা বিচারের মুখোমুখি হবার আশঙ্কাও নেই। তাহলে কেন তারা রোহিঙ্গাদের উৎখাতে উৎসাহী হবেন না আর কেনই বা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবেন?
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার সামরিক বাহিনী নতুন করে দেশটির পূর্ণ ক্ষমতা আবার কুক্ষিগত করেছে। এবার মানবতা ও গণতন্ত্রের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড স্পষ্ট হলো। রোহিঙ্গা মুসলিম নিপীড়ন শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। তারপর থেকে মিয়ানমার সরকার এবং সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নিয়মিত তা চালিয়ে যায়। বিচার বহির্ভূত হত্যা, দলবেধে ধর্ষণ এবং রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম, স্কুল ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়ার ব্যাপক প্রমাণ জাতিসঙ্ঘ পেয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা মিলে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। ১৮ হাজার নারী ও শিশুকে ধর্ষণসহ নানা ধরনের যৌন হয়রানি করেছে। এক লাখ ১৬ হাজার রোহিঙ্গাকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে আগুনে ছুড়ে ফেলেছে।’
আজ মিয়ানমারের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছে। তারা মানবাধিকার চায়, গণতন্ত্র চায়। বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা সামরিক বাহিনীর দম বন্ধ হওয়া শাসন তারা আর চায় না। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই সামরিক বাহিনী ধারাবাহিক জাতিগত অপরাধ চালিয়ে এসেছিল তখন মানবতাবাদী গণতন্ত্রকামী এই মানুষরা কোথায় ছিল? তাদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য তখন মানবতা ও গণতন্ত্রের সামান্য ছিটেফোঁটা অধিকার পাওয়ার দাবিও তোলা হয়নি। এই নাগরিকদের একটি অংশ বরং সামরিক বাহিনীর বর্বর অভিযানের অংশ ছিল। আজ তারা রাস্তায় প্রাণ দিচ্ছে। অথচ সেদিন তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়েছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিশ্বব্যাপী এই সঙ্কট আজ সব জায়গায়।
মানুষ নিজের জন্য সর্বোচ্চ ভালোটা পছন্দ করছে। অন্যের জন্য তারা কিন্তু বাঁচার সামান্য অধিকার দিতেও রাজি হচ্ছে না। তখন তারা কাউকে চিহ্নিত করছে ভিন্ন জাতির; কাউকে চিহ্নিত করছে ভিন্নধর্মের লোক হিসেবে। সেই হিসেবে মিয়ানমারের লোকেরা চরম বর্ণবাদী আচরণ করেছে। নিজেরা বর্ণবাদী হয়ে নিজেদের জন্য অবর্ণবাদী মানবাধিকার ও গণতন্ত্র তারা দাবি করছে। তারা আজ যতটা রক্ত দিচ্ছে কিংবা মিয়ানমারের ইতিহাসে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা যতটা রক্ত ঝরিয়েছে, তার যৎসামান্য যদি রোহিঙ্গাদের সামান্য বাঁচার অধিকারের জন্য ঝরাত- পরিস্থিতি ভিন্নরকম হতো। তখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বর্ণবাদ ও জাতিবাদকে উসকে দিয়ে দানব হয়ে উঠার সুযোগ পেত না।
এখন মিয়ানমারের মানবতার আন্দোলনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র্রের নেতৃত্বে জাতিসঙ্ঘ অনেক সোচ্চার। জাতিসঙ্ঘ স্পেশাল র্যাপটিয়ার টম অ্যান্ড্রুস মিয়ানমারের জনগণের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাড়া দেয়ার আহ্বান রেখেছেন গত সপ্তাহে। জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে তিনি বলেছেন, ‘সামরিক বাহিনী বর্বর কায়দায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে দমাচ্ছে।’ তিনি এরপর যে ভাষাটা প্রয়োগ করেছেন সেটা লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, ‘এখন মিয়ানমারের জনগণের প্রতি কথার মাধ্যমে সমর্থন ব্যক্ত করা যথেষ্ট হবে না। এ জন্য তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘অ্যাকশন’ দরকার। এখন পর্যন্ত জান্তা সেখানে দুশ’ মানুষ হত্যা করেনি। এর মধ্যে এমন শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য আহ্বান এসেছে। এর আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরো জোরালোভাবে জান্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিশ্বশক্তিগুলোর এমন জোরালো সমর্থন প্রতিবাদকারীদের বেশ কাজে এসেছে।
সামরিক বাহিনী এবার সহজে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো সমর্থনের কারণে প্রতিবাদকারীদের মধ্যে উদ্যম ও সাহস ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বৃহত্তর শ্রমিক ইউনিয়ন দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সমাজের সব প্রান্ত থেকে সামরিক আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়েছে। সমাজের নানা খাত থেকে নানা শ্রেণীর মানুষ বিক্ষোভে শামিল হচ্ছে। তবে এই বিক্ষোভের কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে সামরিক বাহিনী চট করে কোনো একটা শ্রেণীকে আটক করে এটিকে স্তিমিত করতে পারছে না। ইতোমধ্যে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের একটি অংশ গোপন অবস্থান থেকে সক্রিয় হয়েছে। তারা সামাজিক মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের পক্ষে বার্তা পাঠাচ্ছেন। তারা বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সমর্থন চাইছেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে চীন সুর কিছুটা পাল্টে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধে বিবৃতি দিয়েছে।
মিয়ানমারে আমরা আসলে বিশ্বমানবতা ও উন্নত আদর্শ গণতন্ত্রের একটি পরীক্ষা দেখছি। পরিস্থিতি আমাদের হাতে ধরিয়ে দেখিয়ে দিলো, এ ধরনের মহান আদর্শ বলতে কিছু নেই। অং সান সু চি সামরিক বাহিনীর মানবাধিকারবিরোধী বিপুল কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিয়ে গেছেন। তিনি বাঁচাতে চেয়েছেন নিজ দেশের অপরাধী জেনারেলদের। এ জন্য তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিথ্যাচার করতে একটুও বিচলিত হননি। রোহিঙ্গাদের খুন, ধর্ষণ ও ভিটেমাটি ছাড়া করা সূচির কাছে অমানবিক কিংবা অগণতান্ত্রিক ঠেকেনি। এরপরও বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তিনি ‘গণতন্ত্রের আদর্শ মহামানব’। ইউরোপ ও আমেরিকার মানবতা ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়ে গেল। মিয়ানমারে তারা কি প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চায়, না চীনকে ঠেকাতে চায়? সে জন্যই কি শুধু সমর্থন নয়, অ্যাকশনও চাচ্ছে; যেমন অ্যাকশনের অভাবে ১২ লাখ বনি আদমের আজ কোনো ঠিকানা নেই।
jjshim146@yahoo.com