ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে শাসক হয়ে ওঠে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে শাসক হয়ে ওঠে - ছবি সংগৃহীত
ইংরেজি ভাষায় স্থান করে নেয়া প্রথম হিন্দুস্থানি শব্দগুলোর একটি ছিল ‘লুট’ অর্থাৎ লুণ্ঠন বা লুটতরাজ। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত এই শব্দটি উত্তর ভারতের সমতল অঞ্চলের বাইরে সচরাচর শোনা না গেলেও ওই সময়ে ‘লুট’ শব্দটি হঠাৎ করেই সমগ্র ব্রিটেনজুড়ে সাধারণ ব্যবহৃত শব্দে পরিণত হয়। কেন ও কীভাবে এতো দূরের এক ভূখণ্ডে শব্দটি শেকড় গেড়ে বিকশিত হয়েছিল কেউ যদি তা বুঝতে চান তা হলে তার উচিত শুধু ওয়েলশ মার্চেস-এ পোইস ক্যাসেল (Powis Castle) পরিদর্শন করা।
ওয়েলশ-এর শেষ বংশানুক্রমিক যুবরাজ, যিনি ওয়ায়িন গ্রাফিড অ্যাপ গেনওয়েনওয়েন নামে স্মরণীয়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পোইস ক্যাসেল নির্মাণ করেন একটি উঁচু স্থানে স্থাপিত দুর্গ হিসেবে। যে স্থানে দুর্গটি নির্মিত হয়েছে সেটি তিনি ইংলিশ রাজতন্ত্রের কাছে ওয়েলশ ত্যাগ করার বিনিময় হিসেবে লাভ করেছিলেন। কিন্তু দুর্গের সবচেয়ে দর্শনীয় সম্পদগুলো এসেছে পরবর্তী সময়ের ইংলিশ বিজয় ও আহরণের যুগে।
পোইস ক্যাসেল ছিল ভারত থেকে লুণ্ঠিত সম্পদে ঠাসা, রুমের পর রুম ভর্তি লুণ্ঠিত রাজকীয় পণ্য, যেগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতাব্দীতে আহরণ করেছে। ভারতের যে কোনো স্থানে, এমনকি দিল্লিতে অবস্থিত ন্যাশনাল মিউজিয়ামে প্রদর্শনের জন্য যত না মোগল নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে ওয়েলশের গ্রাম এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি মালিকানাধীন এই ভবনটিতে। সংরক্ষিত এসব নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে; চকচকে সোনা ও সবুজাভ আবলুস কাঠের কারুকাজ খচিত হুকা, অপূর্ব দর্শন লিপিখচিত বাদাখশানের তরবারি ও অলঙ্কৃত ছুরি, আলোর দ্যুতি ছড়ানো কবুতরের রক্তের রঙের মতো পদ্মরাগমণি এবং গিরগিটির ছোপ ছোপ গাঢ় সবুজের মত পান্না। নীলকান্তমণি ও হলুদ পোখরাজ বসানো বাঘের মাথা; মূল্যবান রত্নপাথর ও হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি অলঙ্কার; পপি ও পদ্ম ফুলের সূচিকর্মসমৃদ্ধ রেশমি পর্দা, হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ও হাতির সাজসজ্জা। বিজয়ের অহঙ্কার হিসেবে সেখানে রক্ষিত আছে দুটি যুদ্ধ স্মারক, যেগুলোর মালিকদের পরাজিত ও হত্যা করে দখল করা হয়েছে বাংলার নওয়াব সিরাজ উদ দৌলার পালকি, যেটি পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর সময় পেছনে রয়ে গিয়েছিল এবং আরেকটি হলো মহীশূরের বাঘ টিপু সুলতানের যুদ্ধাভিযানের সময় ব্যবহৃত তাঁবু।
চোখ ধাঁধানো এইসব সম্পদ লুণ্ঠিত সম্পদ কিভাবে সেখানে স্থান করে নিয়েছে ফ্রেমে বাঁধানো বিশাল এক ক্যানভাসে আঁকা চিত্রে তা দেখানো হয়েছে। চিত্রটি ঝুলানো হয়েছে কাঠের তৈরি রুমে দরজার ওপরের প্রায়ান্ধকার স্থানে, কাঠের প্যানেল বসানো সিঁড়ির উপরিভাগে। এটি সেরা কোনো শিল্পকর্ম নয়, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে চিত্রটিতে উপলব্ধি করা যাবে অখ্যাত কোনো ভারতীয় যুবরাজ সোনালি সূচিকর্মে সমৃদ্ধ পোশাক পরিধান করে রেশমি শামিয়ানার নিচে স্থাপিত সিংহাসনে আসীন। তার বাম পাশে তরবারি ও বর্শাধারী সৈন্যরা দণ্ডায়মান; ডান দিকে দাঁড়ানো মুখে পাউডার মাখা ও মাথায় পরচুলা ধারণ করা বেশ ক’জন ইংলিশ ভদ্রলোক। যুবরাজ অত্যন্ত আগ্রহের সাথে লাল রঙের ফ্রক-কোট পরিহিত কিছুটা ভারি গড়নের একজন ইংলিশম্যানের হাতে গোল করে পাকানো কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছেন।
এই চিত্রে ১৭৬৫ সালের একটি দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যখন তরুণ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম দিল্লি থেকে নির্বাসিত এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আটক হয়েছেন এবং তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার অনেক এখতিয়ার কোম্পানির হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। গোল করে পাকানো কাগজটি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় মোগল রাজস্ব কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করে তাদের স্থলে বেঙ্গলের নতুন গভর্নর রবার্ট ক্লাইভ এবং কোম্পানির ডাইরেক্টরদের দ্বারা নিয়োজিত একদল ইংলিশ বণিকদের নিয়োগ দান সম্পর্কিত আদেশ। দলিলে ইংলিশ কোম্পানির ডাইরেক্টরদের ‘উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতাধর, অভিজাতদের মধ্যেও মহিমান্বিত অভিজাত, খ্যাতিমান যোদ্ধাদের প্রধান, আমাদের বিশ্বস্ত সেবক ও আন্তরিক শুভাকাক্সক্ষী, রাজ-আনুকূল্য লাভের যোগ্য’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অতএব ওই সময় থেকে মোগলদের পক্ষ থেকে কর আদায়ের এখতিয়ার ন্যস্ত করা হয় এক শক্তিশালী বহুজাতিক করপোরেশনের ওপর, যাদের কর আদায় ব্যবস্থার স্বার্থ রক্ষা করবে তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী।
প্রতিষ্ঠাকালীন সনদের শর্তানুযায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’র কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছিল। ১৬০২ সালে একটি পর্তুগিজ জাহাজের ওপর হামলা পরিচালনা ও জাহাজটি দখল করার মধ্য দিয়ে সূচিত প্রথম সহিংস ঘটনার পর থেকে তারা জবরদস্তির পথ অনুসরণ করে আসছিল। তাছাড়া ১৬৩০ এর দশক থেকেই তারা ভারতে তাদের স্থাপনাগুলোর আশপাশের ছোট ছোট এলাকাগুলোও নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। তথাপি ১৭৬৫ সাল প্রকৃতপক্ষেই এমন এক সময় ছিল যখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে প্রচলিত অর্থে কোনোভাবেই একটি বাণিজ্যিক করপোরেশনের মনে করার আর কোনো কারণ ছিল না; রেশম ও মসলার কারবারসহ এ ধরনের সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় বাণিজ্য পরিস্থিতির ভারসাম্য বিনষ্ট হয়, বরং আরো বেশি অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যে স্থানীয়ভাবে বাছাই করা ২০ হাজার ভারতীয় সৈন্যের একটি সামরিক বাহিনী দ্বারা সমর্থিত কোম্পানির ২৫০ জন ক্লার্ক মোগল প্রদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশের কার্যকর শাসকে পরিণত হয়। একটি আন্তর্জাতিক করপোরেশন আগ্রাসী ঔপনিবেশিক শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল।
১৮০৩ সালের মধ্যে কোম্পানির সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা দুই লাখে উন্নীত হয়, তখন তারা সমগ্র উপমহাদেশকে দ্রুততার সাথে বশীভূত করে অথবা সরাসরি দখল প্রতিষ্ঠা করে। আশ্চর্যজনকভাবে এ প্রক্রিয়ায় অর্ধ-শতাব্দীর চেয়েও কম সময় লাগে। ভূখণ্ডগত প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের সূচনা ঘটে বাংলায়; কোম্পানির বিচরণ উত্তরদিকে মোগল রাজধানী দিল্লিতে পৌঁছার ৪৭ বছর পর এবং ওই সময়ের মধ্যে সেই নগরীর দক্ষিণ দিকে প্রায় সমগ্র ভারত কার্যকরভাবে শাসিত হতো লন্ডন নগরীতে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ডরুম থেকে। একজন মোগল কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা এখনও তাদের পশ্চাৎদেশ ধৌত করতে শিখেনি এমন গুটিকতক বণিকের নিকট থেকে যখন আমাদেরকে আদেশ গ্রহণ করতে হয়, তখন আমাদের মানসম্মানের কী আর অবশিষ্ট থাকে?” (করম আলী রচিত ‘মুজাফফরনামা,’ যদুনাথ সরকার কর্তৃক ফারসি থেকে ‘বেঙ্গল নওয়াবস’ নামে ইংরেজি অনুবাদ, কলকাতা, ১৯৫২)।
ব্রিটিশের ভারত বিজয়ের কাহিনীর মধ্যে আরো একটি বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। তা হলো, অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ সরকার ভারতের বৃহদাংশ দখল করতে শুরু করেনি, বরং দখল আরম্ভ করেছিল বিপজ্জনকভাবে নিয়ন্ত্রণহীন একটি বেসরকারি কোম্পানি, যেটির সদর দফতর লন্ডনে পাঁচ জানালাবিশিষ্ট একটি ছোট রুম এবং ভারতে পরিচালিত হয়েছে একজন সহিংস, চরম নিষ্ঠুর ও মানসিকভাবে অস্থির করপোরেট শিকারি ক্লাইভ কর্তৃক। ভারতের উপনিবেশে রূপান্তর ঘটেছে মুনাফা অর্জনকারী একটি করপোরেশনের অধীনে, যার অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ডের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বিনিয়োগকারীদের ধনবানে পরিণত করা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভিক্টোরীয় যুগ যখন বিকাশের উত্তুঙ্গে তখন ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠার সন্দ্বিগ্ধ ও বাণিজ্যিক পদ্ধতির ব্যাপারে বিব্রত হওয়ার প্রচণ্ড এক বোধ কাজ করেছে। ভিক্টোরীয়রা ভেবেছিলেন যে, ইতিহাসের মূল উপাদান হচ্ছে জাতি-রাষ্ট্রের রাজনীতি। তারা বিশ্বাস করতেন, দুর্নীতিগ্রস্ত করপোরেশনগুলোর অর্থনীতি নয়, বরং জাতি-রাষ্ট্রের রাজনীতি বিশ্লেষণই মৌলিক ব্যাপার এবং সেটিই মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে রূপান্তর ঘটানোর আসল চালিকাশক্তি। তা ছাড়া তারা তাদের সাম্রাজ্যকে সভ্যতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ, পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে জাতীয়ভাবে জ্ঞান, রেলওয়ে ও সভ্যতার কলাকৌশল ছড়িয়ে দেয়া কথা ভাবতে পছন্দ করতেন এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েমের মধ্য দিয়ে করপোরেট লুণ্ঠনের যে পথ সৃষ্টি করা হয়েছিল এর মধ্যে সেই নিরূপিত ও ইচ্ছাকৃত উদ্যোগটিও ছিল।
দ্বিতীয় একটি চিত্র হাউজ অব কমন্সের প্রাচীরে আঁকার জন্য বিখ্যাত চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রথেস্টেইনকে নিয়োগ করা হয়েছিল। এই চিত্রে দেখা যায়, এই প্রক্রিয়ার সরকারি স্মৃতি কতটা সফলভাবে ধারণ করে রাখা হয়েছে এবং ভিক্টোরীয়রা কত সূক্ষ্মভাবে তা নতুন করে ফুটিয়ে তুলেছে। এটি এখনও সেন্ট স্টিফেনস হলে, ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টের কোলাহলপূর্ণ অভ্যর্থনা স্থলে দেখা যায়। চিত্রটি ‘দ্য বিল্ডিং অফ ব্রিটেন’ শিরোনামে অঙ্কিত ধারাবাহিক চিত্রমালার অংশ। এর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে ওই সময়ের ‘হ্যাঙিং কমিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং ব্রিটিশ ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের দিকসমূহ: ৮৭৭ সালে রাজা আলফ্রেড কর্তৃক ডেনিশদের পরাজয়, ১৭০৭ সালে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন ইত্যাদি। এই সিরিজ প্রাচীরচিত্রের মধ্যে যেগুলো ভারতকে নিয়ে আঁকা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আরেকটি চিত্রে অপর এক মোগল যুবরাজকে একটি শামিয়ানার নিচে উঁচু একটি পাটাতনে আসীন দেখা যায়। এটিতেও দরবারি আবহ দৃশ্যমান, সবদিকে মস্তক অবনত অবস্থায় সেবকবৃন্দ, ভেরি বাজছে, এবং একজন ইংলিশম্যান দাঁড়িয়েছেন মোগল যুবরাজের সামনে। কিন্তু তখন ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই চিত্রে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে রাজা প্রথম জেমসের পাঠানো দূত স্যার টমাস রোকে দেখা যাচ্ছে, যাকে ১৬১৪ সালে পাঠানো হয়েছিল, যখন মোগল সাম্রাজ্য ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও অত্যন্ত শক্তিশালী। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার পিতা সম্রাট আকবরের নিকট থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করেন বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দুটি সাম্রাজ্যের একটি, যার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল শুধু মিং রাজবংশের শাসনাধীন চীন। জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পুরোটা এবং আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকাসহ প্রায় সমগ্র ভারত জুড়ে। তিনি আনুমানিক ১০ কোটি মানুষের ওপর তার শাসন পরিচালনা করেন, যা অটোম্যানদের দ্বারা শাসিত জনগোষ্ঠীর চেয়ে পাঁচ গুণ অধিক ছিল। ওই সময় সমগ্র বিশ্বে যেসব পণ্য প্রস্তুত হতো সেগুলোর এক চতুর্থাংশ উৎপাদন করতো তাঁর প্রজারা।
ইউরোপীয় অভিবাসীদের সভ্য ও মার্জিত করে তোলার জন্য জাহাঙ্গীরের পিতা আকবর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন, যাদেরকে তিনি বর্ণনা করতেন ‘একদল বর্বর অসভ্য’ বলে। কিন্তু তার ধারণা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বিবেচনা করে তিনি তা পরিহার করেন। বিদেশী কোনো কিছু এবং বন্য জানোয়ারের প্রতি জাহাঙ্গীরের বিশেষ ঝোঁক ছিল। প্রথম তুর্কির ভারতে আগমণকে তিনি যে আগ্রহের সাথে স্বাগত জানিয়েছিলেন, একই উৎসাহে তিনি স্যার টমাস রো’কেও স্বাগত জানান এবং ইউরোপের অস্বাভাবিক ও খাপছাড়া বিষয়গুলো নিয়ে রো’কে ঘনিষ্ঠভাবে প্রশ্ন করেন। যে কমিটি হাউজ অব কমন্সে চিত্রগুলো অঙ্কনের পরিকল্পনা করে, তাদের কাছে এটি ছিল ভারতে ব্রিটিশ যোগাযোগ স্থাপনের সূচনার স্মারক: দুটি জাতিরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন করতে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও এই গ্রন্থের প্রথম অংশে দেখানো হয়েছে যে, ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ সম্পর্কের সূত্রপাত কূটনীতি এবং দূতদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হয়নি, বরং শুরু হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমুদ্রচারী অভিজ্ঞ ব্যক্তি ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্সের নেতৃত্বে এক বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদলের মাধ্যমে। উইলিয়াম হকিন্স আগ্রায় উপস্থিত হয়ে সম্রাটের পক্ষ থেকে দেয়া স্ত্রী গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত উৎফুল্ল চিত্তে তাঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। হাউজ অব কমন্সের হ্যাঙিং কমিটি ইতিহাসের এই ভাষ্যকে বিস্মৃত হওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বহু উপায়েই বাণিজ্যিক দক্ষতা ও সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে একটি আদর্শের মতো ছিল: কোম্পানির ১০০ বছরের ইতিহাসে সদর দফতরে স্থায়ী কর্মচারি ছিল মাত্র পয়ত্রিশ জন। এই স্বল্প লোকবল সত্ত্বেও তারা ইতিহাসে এক নজীরবিহীন করপোরেট অভ্যুত্থান ঘটায়, যার মধ্যে ছিল সামরিক বিজয় অর্জন, দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড দখল ও লুণ্ঠন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকাণ্ড প্রায় নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব ইতিহাসে করপোরেট সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে ইতিহাসবিদরা বহু কারণের উল্লেখ করেছেন: মোগল ভারতের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা ও সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে পরিণত হওয়া; বিবদমান রাজ্যসমূহ, সামরিক শ্রেষ্ঠত্বÑ যা ‘ফেড্রারিক দ্য গেট’ কর্তৃক ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে প্রদান করা হয়েছিল তার কার্যকর প্রয়োগ, এবং বিশেষ করে ইউরোপীয় শাসন, কর আদায় ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যা কোম্পানিকে মূহূর্তের ঘোষণায় বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ আহরণের সুযোগ দিয়েছিল। কারণ লাল রঙয়ের ইউনিফর্ম ও ইংলিশ স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত প্রাসাদ, বাঘ শিকার ও সরকারি ভবনে ইউরোপীয় নৃত্যের পেছনে সব সময় থাকত কোম্পানির হিসাবরক্ষকের লেনদেন ও লাভ-ক্ষতির হিসাব এবং লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানির শেয়ার মূল্যের ওঠানামার চিত্র।
এসব বিষয় ছাড়াও সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি সমর্থন দান। পুরো অষ্টাদশ শতাব্দীজুড়ে তাদের মধ্যে সম্পর্ক পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছিল পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে, যা একটি সময়ে এমন সম্পর্কের রূপ নেয়, যে সম্পর্ককে আমরা বর্তমান অবস্থার বিচারে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব বলে বর্ণনা করতে পারি। ক্লাইভের মতো নওয়াবরা ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে তাদের সম্পদ ব্যয় করতেন আইন প্রণেতা ও পার্লামেন্টারি আসন- বিখ্যাত ‘রটেন বরো’ ক্রয় করার কাজে। বিনিময়ে পার্লামেন্ট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে কোম্পানিকে সাহায্য করতো: ফরাসি ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে তাদের কামান ব্যবহার করছিল তখন জাহাজ ও সৈন্যের প্রয়োজন পূরণ করে পার্লামেন্ট।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামনে সবসময় দুটি লক্ষ্য ছিল: যেখানে ব্যবসা পরিচালিত হবে সেই ভূখণ্ড; অপরটি ছিল যে দেশটি কোম্পানির জন্ম দিয়েছে। কারণ কোম্পানির আইনজীবী ও আইন প্রণেতা শেয়ার হোল্ডাররা ক্রমান্বয়ে ও সূক্ষ্মভাবে কোম্পানির অনুকূলে আইন প্রণয়নে প্রভাব বিস্তারের জন্য কাজ করেছে। বাস্তবিকপক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই সম্ভবত করপোরেট লবিংয়ের উদ্ভাবক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১০০ বছরের কম সময় পর ১৬৯৩ সালে কোম্পানিকে প্রথমবারের মতো দেখা গেছে পার্লামেন্টারিয়ানদের কেনার জন্য তাদের নিজস্ব শেয়ার ব্যবহার করতে। বিশিষ্ট আইন প্রণেতা ও মন্ত্রীদের জন্য তারা বার্ষিক ১,২০০ পাউণ্ড স্টার্লিং ব্যয় করতো। বিশ্বের প্রথম করপোরেট লবিং কেলেঙ্কারির ওপর পার্লামেন্টারি তদন্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ঘুষ প্রদান এবং শেয়ারের মূল্য সম্পর্কিত তথ্য পাচারের সাথে জড়িত দেখতে পায় এবং পরিণতিতে কাউন্সিলের লর্ড প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করা হয় এবং কোম্পানির গভর্নর কারারুদ্ধ হন।