মিসর-তুরস্ক সম্পর্কের সমীকরণ
এরদোগান ও সিসি - ছবি সংগৃহীত
গত মাসে, মিসর পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নতুন তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের ‘বিড’ ঘোষণা করেছে। তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যে ২০১৯ সালের চুক্তি অনুসারে এটি আঙ্কারার ঘোষিত ‘কন্টিনেন্টাল শেল্ফ’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিল। আঙ্কারা মিসরীয় পদক্ষেপকে একটি ইতিবাচক বার্তা হিসাবে নিয়েছে। আর এটি এ ধরনের প্রথম বার্তা ছিল না। তুরস্ক-লিবিয়া সমুদ্র চুক্তির সমালোচনা করা সত্ত্বেও, মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডিসেম্বর ২০১৯ সালের রোম সম্মেলনে এ চুক্তিটি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ‘মিসরের স্বার্থের ক্ষতি করে না’ বলে উল্লেখ করেছিল।
২০২০ সালের আগস্টে মিসর গ্রিসের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ চুক্তি স্বাক্ষর করলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন যে, এই চুক্তি দ্বীপের সমুদ্রসীমা নিয়ে তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায় নিয়েছিল।
কায়রো সম্প্রতি তার লিবিয়া নীতিতে এমন কিছু পরিবর্তন আনে যা দেশটিকে আঙ্কারার আরো কাছে এনেছে। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে আঙ্কারা জেনারেল হাফতারের অভিযানকে সাফল্যের সাথে ঘুরিয়ে দেয়ার পরে সেখানে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে মিসর বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মিসর একটি উচ্চ পদস্থ কূটনীতিক ও নিরাপত্তা প্রতিনিধি দল ত্রিপোলিতে প্রেরণ করে এবং পুনরায় দূতাবাস খোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে। এটি ছিল ২০১৪ সালে এরপর প্রথমবারের মতো ত্রিপোলিতে মিসরের দূতাবাস খোলা।
কায়রোর এই বার্তাগুলো আঙ্কারার নজর এড়ায়নি। গত ৩ মার্চ, তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেন, কায়রো তার দেশের সমুদ্রসীমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসোগলু মিসরের সাথে সমুদ্রসীমা এখতিয়ার চুক্তি বিষয়ে আলোচনার জন্য তুরস্কের প্রস্তুতির বিষয়ে ইঙ্গিত দেন।
এর তিন দিন পরে, তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার ‘ব্লু হোমল্যান্ড’ ২০২১ কৌশলগত অনুশীলনের সময় জোর দিয়ে বলেন যে, ‘দুটি দেশ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে শেয়ার করে।’ এর মাধ্যমে তিনি সম্পর্কের নতুন উন্নয়নের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেন।
রাষ্ট্রপতি এরদোগানের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন ব্লুমবার্গকে যখন বলেন, ‘মিসরের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় চালু হতে পারে’ তখন তিনি আগের বক্তব্যগুলোকেই প্রকারান্তরে সমর্থন করেন। এই বার্তাগুলো তুর্কি শাসনের উচ্চ পর্যায়ের নীতি প্রণেতাদের কাছ থেকে আসায় বিষয়টির গুরুত্বকে বিশেষভাবে প্রতিফলিত করে।
সম্পর্ক বাড়াতে পারস্পরিক স্বার্থ
দুই দেশের মধ্যে সাবধানে তৈরি করা বার্তা কেবল তাদের সাধারণ স্বার্থেই নয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক গতি পরিবর্তনকেও প্রভাবিত করতে পারে। গত বছরের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় মিসর ও তুরস্কসহ অনেক আঞ্চলিক দেশকে নতুন প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য নীতিগুলোর পুনর্বিন্যাস করতে বাধ্য করেছে।
মিসর উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের (জিসিসি) সাম্প্রতিক শীর্ষ সম্মেলনের ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ তার মিত্র সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত কায়রোর সাথে এ বিষয়ে কোনো সমন্বয় করেনি এবং তারা দোহার সাথে পুনর্মিলন করতে রাজি হওয়ার সময় মিসরের স্বার্থগুলোকে বিবেচনায় রাখেনি।
জিসিসির সমঝোতা তুরস্ককে কাতার, কুয়েত ও ওমানের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির সুযোগ এনে দেয় আর সৌদি আরব এবং কিছুটা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথেও সমঝোতার অবকাশ তৈরি করে। গত জানুয়ারিতে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকর্তারা যে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং তাদের পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ গড়ে তোলার ইচ্ছা নিয়ে এগোচ্ছেন সে বিষয়টি জানতে পারে মিসর। অথচ আমিরাতি চাপের ফলে মিসর লিবিয়ায় তুরস্কের সাথে সংঘর্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
এর পাশাপাশি গ্রিস ও তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় স্থবিরতার বিষয় নিয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম প্রত্যক্ষ আলোচনা শুরু করে। আর এ সময় জাতিসঙ্ঘ সাইপ্রাস সমস্যার সমাধান সম্ভব কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য একটি সভা আহ্বানের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। এ ধরনের এক অবস্থায় কায়রো হিসাব করেছে যে, তুরস্কবিরোধী থাকা তার পক্ষে আর স্বার্থানুকূল হবে না। বিশেষত যখন উপসাগর এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের অংশীদার সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, গ্রিস, ইসরাইল এমনকি ফ্রান্স ও আঙ্কারার সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে যাচ্ছে। এটি মিসর এবং তুরস্কের মধ্যে সাম্প্রতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার কারণ বলে মনে হচ্ছে।
সমুদ্রসীমার স্বার্থ
সমুদ্রসীমায় নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায় ইসরাইল পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের অবস্থানের সমালোচনার ব্যাপারে সতর্ক ছিল। ইউরোপে গ্যাস রফতানি করতে তেল আবিব ইস্টমেড পাইপলাইন প্রকল্পের ওপর নির্ভর করছে। এই পাইপলাইনটির চূড়ান্ত দৈর্ঘ্য ১,৯০০ কিলোমিটার, ব্যয় প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার এবং তুরস্কের দাবি করা অঞ্চল দিয়ে এটি যাওয়ার কারণে তা কখনো ‘দিনের আলো দেখতে পাবে’ কি-না সংশয় রয়েছে। এই কারণে ইসরাইল সম্ভবত তার বিকল্পগুলো তুরস্কের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত রাখতে চাইবে। এ জন্য ইসরাইল মিসর-তুরস্ক সম্পর্কের বিরোধিতা করছে না।
মিসরও সমুদ্রসীমা নিয়ে তুরস্কের সাথে একই ধরনের সমস্যায় রয়েছে। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গ্রিসের চেয়েও তুরস্কের সাথে একটি সমুদ্র চুক্তির পক্ষে বেশি রয়েছেন। কারণ এটি মিসরকে আরো অনেক বড় সমুদ্রাঞ্চল দেবে। তবে মিসরীয় প্রেসিডেন্ট কিছু রাজনৈতিক সুবিধার জন্যও এথেন্সের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তুরস্কের দরজা বন্ধ না করার জন্য সম্মত হয়েছেন। বিশেষত মিসরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্তকারী আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির পরে এর প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভব করেছে কায়রো।
এই ঘটনাগুলোর এবং কায়রোর ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করে আঙ্কারা পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও লিবিয়ায় তাদের সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিকে নীরবে মূল্যায়ন করছে। আঙ্কারার সাবধানে তৈরি করা বার্তাগুলো একটি বিজয়ী সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। তুরস্কের সাথে সহযোগিতার মধ্যে কায়রোর স্বার্থের বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, প্রাক-করোনাভাইরাস সময়কালেই, আঙ্কারা কায়রোকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং গ্যাস আমদানির পরিমাণ বাড়াতে প্রস্তাব করেছিল। তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক ওঠানামার মধ্যেও দেখা গেছে। গত কয়েক বছরে তা বেড়ে ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারকে অতিক্রম করেছে। তুরস্ক ও মিসর যদি লিবিয়ার পুনর্গঠনে একসাথে কাজ করে তবে লিবিয়ার স্থিতিশীলতা এই সহযোগিতাকে এক অভূতপূর্ব মাত্রায় বাড়িয়ে তুলতে পারে।