ভীতিহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
ভীতিহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র - ছবি সংগৃহীত
আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল গণতান্ত্রিক সমাজনির্মাণ। যেখানে মুক্তভাবে কথা বলা যাবে। মানুষের ভোটের অধিকার, অন্নের অধিকার নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন হবে না। থাকবে না কোনো বৈষম্য। পূর্ব-পশ্চিম কিংবা তথাকথিত অভিজাত-অনভিজাত শ্রেণীর মধ্যে থাকবে না শাসক-শোষকের দেয়াল। কিন্তু উনিশ’শ সাতচল্লিশ কিংবা তারও আগে পূর্ববাংলার বঞ্চিত জনগণ যে প্রত্যাশায় পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন সহসা তাদের মোহভঙ্গ হয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও পাকিস্তান আন্দোলনের কর্র্মী ছিলেন। সে আমলে এ জন্য তিনি জীবনের প্রথম কারাবরণও করেছেন। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠার আগে তিনি সেই রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে কোনো চিন্তা-ভাবনা করেছেন কিংবা দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করেছেন এমন কিছু জানা নেই। তিনি সব সময়ই বাঙালির অধিকার রক্ষা এবং শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এখানকার বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সপক্ষে,বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক ছিলেন তিনি। তার দেশপ্রেম নিয়ে কখনো কেউ প্রশ্ন তোলেনি। তা সত্ত্বেও এটা সত্য যে বঙ্গবন্ধুকে জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কারাগারে কাটাতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে যত আন্দোলন কিংবা সংগ্রাম গড়ে উঠেছে তার মূল লক্ষ্য ছিল শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে একটি বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ন্যূনতম এই চাহিদা পূরণ না করায় এক বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই বঞ্চনা সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ করে। এরই পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরির প্রেক্ষাপটে সবকালে সবদেশেই সবমানুষ যে একই রকম চিন্তাভাবনা করে এমনটি ভাবা যায় না। ভারত ভাগের সময় তৎকালীন এলিট শ্রেণীর অনেকেই তা মানতে পারেননি। প্রখ্যাত লেখক নিরোদ শ্রী চৌধুরী,অন্নদা শঙ্কর রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা ভারত বিভক্তি মেনে নিতে পারেননি। নীরোদ শ্রী চৌধুরী ইংল্যান্ড গমন করেন এবং সেখানেই মারা যান। আবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশমুক্তির স্বপ্ন দেখেন। এ জন্য তাকেও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এমনকি তিনি এক রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করার পর হয়ে ওঠেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মহাবীর। ব্রিটিশ পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশে এমন কাহিনী অসংখ্য। সরকারের কোনো নীতির সমালোচনার অর্থ এই নয় যে যিনি সমালোচনা করছেন তার দেশপ্রেম নেই। কিংবা তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী। একটি জাতি বিকাশের ধারায় অসংখ্য মানুষের সম্পৃক্ততা থাকে। অসংখ্য মানুষের ত্যাগ-তীতিক্ষার ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে একটি জাতি রাষ্ট্র। ইতিহাসে কারো নাম থাকে আবার কারো নাম উল্লেখ থাকে না। এটাই বাস্তবতা। জোর করে ইতিহাস সৃষ্টি করা যায় না। ইতিহাস নিজে থেকেই তার গতিপথ রচনা করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পূর্তির এই ক্ষণে এসব কথা মনে পড়ছে এ কারণে যে এখন কেন জানি মনে হয় অনেকেই জোর করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে চান। একটি সমাজ রাষ্ট্র কাঠামো টিকে থাকার অন্তর্নিহিত শক্তি হচ্ছে জাতীয় চেতনা। এই চেতনা জোর করে সৃষ্টির বিষয় নয়। সমাজে নানান ভাবনার মানুষ থাকেন। কেউ মুক্তভাবে চিন্তা করেন। কেউবা আপসকামিতার মাধ্যমেই চলতে পছন্দ করেন। অনেকে থাকেন ভীষণ প্রতিবাদী। অনেকেই আছেন সবকিছু এড়িয়ে চলাটাকে পছন্দ করেন। ব্যক্তি কিংবা সমাজ রাষ্ট্র কাঠামোর এ এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দিক। আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা ও আকাক্সক্ষার বিষয় ছিল বৈষম্যহীন সমাজ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু প্রচণ্ডভাবে বিভাজিত সমাজ ব্যবস্থায় এখন এই চেতনার জায়গাও ভাগ হয়ে গেছে। চেতনার ক্ষেত্রে আমরা এখন এক জায়গায় নেই। আমাদের চেতনা আজ ভাগ হয়ে গেছে নানান মত ও পথের বাঁকে। এ এক নিষ্ঠুর পরিহাস।
আমরা আগে বহুবার বলেছি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার চর্চা বেশি দিন নয়। এর টেকসই ব্যবস্থাপনা এখনো উদাহরণ সৃষ্টি করার পর্যায়ে পৌঁছেনি। যে ধারাবাহিক চর্চা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যায় বাংলাদেশ সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। তারপরও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সুনাম আছে। এখানে গণতন্ত্রের চর্চা অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে। কিন্তু এখন সেখানেও প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তির মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র। শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখলে ইতিহাস হয়তো আজ ভিন্নভাবে লিখিত হতো। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু গত ৫০ বছরে আমাদের অর্জন কতটুকু? উন্নয়নশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে হয়তো আমাদের উন্নতি ঘটেছে। অর্থনৈতিক মুক্তি ত্বরান্বিত হয়েছে। কিন্তু যে সাম্যের চেতনা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে বেগবান করেছে তা কি আজো অর্জিত হয়েছে? এ এক বিরাট প্রশ্ন। বাঙালির সমাজ চিন্তা এবং কাঠামোগত চেতনা বড্ড বিচিত্র। প্রচণ্ড আবেগি জাতি হিসেবে আমাদের পরিচিতি রয়েছে। একই সাথে রয়েছে একটি কথাকে টেনে সামনে এগিয়ে নেয়ার দুর্লভ গুন। আবেগি জাতি হিসেবে আমরা সামনে এগোনোর ক্ষেত্রে পরিণাম চিন্তা করি না। ফলে অনেক সময় এই আবেগ হিতেবিপরীত হয়ে যায়। যে বিতর্ক আমরা তৈরি করি সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারি না। ফলে এটাই আমাদের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। সমাজে যে ভেদ রেখা তৈরি হয় তা আর মুছতে চায় না। একটি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বাস করতে হলে অনেক কিছুই মেনে চলতে হয়। ইচ্ছা করলেই একটা কথা বলে ফেলা যায় না। অসতর্ক মুহূর্তে বলা কথা অনেক বড় বিপর্যয় তৈরি করে দেয়। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় যেকোনো বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা খুবই সাধারণ বিষয়। এমন বহু ঘটনা আছে যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির পর তা যুগের পর যুগ টিকে আছে। রাজনৈতিক অনেক বিতর্ক যখন সৃষ্টি হয় তখন আমরা অনেকেই মনে করি যে তা এমনি এমনিই একদিন ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবে তা কখনোই ঠিক হয়ে যায় না। ঠিক না হওয়ার জের আমাদের বছরের পর বছর টানতে হয়। এটা এমনো হয় যে এ আর কখনোই শেষ হবে না। এবং তা হয়ও না।
ফলে জাতির অন্তর্নিহিত শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। বিদ্বেষ চলতে থাকে যুগের পর যুগ। কোনো সরকারই এই বিতর্ক অবসানের চেষ্টা করেছেন বলে খুব একটা দেখা যায় না। পরের সরকার এসে সেই ভিত্তির ওপর আরেক বিভক্তির বীজ ছড়িয়ে দেন। উচিত হলো এসব বিতর্কের একটি যৌক্তিক পরিসমাপ্তির জন্য কাজ করা। বিভক্তির অবসান ঘটানো। ঐতিহাসিক কোনো বিষয়ে বিতর্ক দেখা দিলে নির্মোহভাবে তা নিরসন করা। যাতে এ থেকে কেউ ফায়দা হাসিল না করতে পারে। কিংবা নতুন বিতর্কের বীজ বুনতে না পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন কোনো উদ্যোগ কেউ নিয়েছে বলে শোনা যায়নি। বরং আমরা আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন নিয়েও বিতর্ক জিইয়ে রেখেছি যুগের পর যুগ। আবেগ দিয়ে আমরা ইতিহাস রচনার চেষ্টা করি। আমরা ভাবিনা এই ভাবনা কতটা ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী।
গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে বর্তমান সরকারের আমলে জারিকৃত একটি আইন নিয়ে নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই আইনটি নিয়ে আমরা আগেও কথা বলেছি। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এই আইনটি বলবৎ হয়। এ নিয়ে অনেক উচ্চবাচ্য হলেও ২৫ ফেব্রুয়ারি মুশতাক আহমেদ নামে একজন লেখক এই আইনে কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা গেলে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। লেখক মুশতাক আহমদের সাথে এই মামলায় কার্টুনিষ্ট আহমেদ কবীর কিশোর গ্রেফতার হন। ২০২০ সালের ৬ মে মুশতাক এবং কিশোরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটকের পর তাদের ওপর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন বেপরোয়া অত্যাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই দীর্ঘ দিনে তারা একাধিকবার আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। জামিনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো আদালতই তাদের জামিন দেননি। এমনকি আটকাবস্থায় তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করেনি সরকারি প্রশাসন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে ৫৪ বছর বয়সী লেখক মুশতাক এক রকম বিনা চিকিৎসায় কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মুশতাকের মৃত্যুর পর তার সহযাত্রী কার্টুনিষ্ট আহমেদ কবীর কিশোরকে ৩ মার্চ হাইকোর্ট জামিন দেয়। জামিনে মুক্তির পর কিশোর সংবাদপত্রের সাথে সাক্ষাৎকারে তার ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। সে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি যেভাবে কেঁদেছেন- তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ার যে দৃশ্য পত্রিকার পাতায় উঠেছে তা সভ্য সমাজকে কলঙ্কিত করে দিয়েছে। এই ক্ষত মুছবে কিনা জানি না। সাক্ষাৎকারে আহমেদ কিশোর আটকাবস্থায় প্রাণত্যাগকারী মুশতাক আহমেদের ওপর নির্মম নির্যাতনের যে ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করেছেন তা শিউরে ওঠার মতো। এই বর্ণনা অস্বীকার করার উপায় আছে কিনা আমরা জানি না। নির্যাতনের এই ঘটনা আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে ভীষণভাবে আঘাত করেছে। রাষ্ট্রের উচিত এর তদন্ত করা। তদন্তে কারো অতিরঞ্জন প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু সেটি না করা হলে এটি এক মন্দ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যা অনাগতকালে অসংখ্য প্রশ্নের সৃষ্টি করবে।
রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে ধীরস্থির না হলে নানান বিপর্যয় ঘটে। এখন বলা হচ্ছে বাকস্বাধীনতার একটি সীমারেখা থাকা উচিত। এটি ঠিক। স্বাধীনতার সাথে দায়িত্বশীলতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। দায়িত্বশীলতা না থাকলে সে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারের সীমাও অতিক্রম করতে পারে। এ কথা যেমন সত্য ঠিক তেমনি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। দেশের আইন কাউকে স্বেচ্ছাচারিতার অনুমোদন দেয়নি। যাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার হলে কোনো কথা ছিল না।
কিন্তু বিচারের আগেই যেভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি তারা দোষীই হবেন আইনে যে শাস্তি প্রাপ্য আদালত কর্তৃক সেটি নির্ধারণ হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি বিচারের আগেই তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে এবং বিনা বিচারে তারা দীর্ঘ হাজতবাস করেছেন। গণতান্ত্রিক কোনো সমাজে সভ্য কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটি হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধান কোনো নাগরিককে নিষ্ঠুর নির্যাতনের অনুমতি দেয়নি। সংবিধানে নাগরিকের যে ১৮টি মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম কোনো ব্যক্তিকে নিষ্ঠুর নির্যাতন অবমাননাকর কিংবা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না। মৌলিক অধিকার এমন একটি বিষয় যা থেকে অন্যকোনো আইনের দ্বারা কাউকে বঞ্চিত করা যায় না। সংবিধানে নাগরিক মাত্রেই আইনের দৃষ্টিতে সমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। সরকারি কর্মে নিয়োগ লাভ,আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, চলাফেরা ও সমাবেশের ক্ষেত্রে, সংগঠনের ক্ষেত্রে, চিন্তা বিবেক ও বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। মৌলিক এসব অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যায়না। আসলে কোনো রাষ্ট্রে যখন কোনো সরকার দীর্ঘ সময় দেশ পরিচালনা করে থাকে তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের অহমিকার সৃষ্টি হয়। তখন নিজেদের বাইরে আর কিছুই তারা ভাবতে পারেন না। এই ভাবনা তাদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়। তখন তারা জনগণের ওপর আস্থা এবং ভরসা রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এখানেও সেরকম হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বর্তমানে আমরা যে সমাজে বাস করছি সেখানে এক ধরনের ভীতি আমাদের সব সময়ই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এটি আমরা কামনা করি না। ভীতিহীন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর চিন্তা আমরা সব সময়ই করি। যেখানে শোষণ বঞ্চনা থাকবে না- মানুষ তার মৌলিক অধিকার ভোগ করবে। আইন দ্বারা স্বীকৃত নাগরিক অধিকার কেউ হরণ করবে না। রাষ্ট্র ও নাগরিক পরস্পরের দায়িত্ব পালন করবে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মর্মকথা এটাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্য যে বর্তমান বাস্তবতায় আমরা এর বিপরীত চিত্রই দেখতে পাই। একটি বৈরি- বিভক্তিকর সমাজে বাস করতে গিয়ে আমাদের মন মানসিকতা নিজেদের অজান্তেই আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমাদের বিতর্ক কোনো কিছুতেই যেন শেষ হতে চায় না। দৃশ্যত আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে অনেক কিছুই অর্জন করেছি। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। আমরা নিজেদের আয়ে দেশগড়ার স্বপ্ন দেখি। আমাদের কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। কোটি যুবক বিদেশের বুকে নিজেকে উজাড় করে দেয় স্বদেশের ভাবনায়। এক নির্ভেজাল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে স্বপ্ন দেখে। এই স্বদেশপ্রেমই আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও কোটি কোটি যুবককে জীবনের মায়াত্যাগ করে যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। কিন্তু আজ যখন গণতন্ত্র নিয়ে- নিজেদের ভোটের অধিকার নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয় তখন আশাভঙ্গের বেদনায় সব স্বপ্ন বিবর্ণ হয়ে যায়। এই স্বদেশ তো আমরা কখনো কল্পনাও করিনি!
৩ মার্চ হিন্দুস্থান টাইমস এক খবরে বলেছে, ভারতের সুপ্রিমকোর্ট জম্মু-কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ড. ফারুক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে দায়ের করা এক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা খারিজ করে দিয়েছে। বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কউলের নেততৃত্বাধীন ও বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তার সমন্বিত বেঞ্চ মামলা খারিজ করে বলেছেন, সরকারের মতের বিরোধী কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হলেই তাকে দেশদ্রোহ বলা যায় না। রজত শর্মা নামে এক ভারতীয় নাগরিক সুপ্রিমকোর্টে ড. ফারুক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ মামলা দায়ের করলে আদালত তা খারিজ করে দেন। সুপ্রিমকোর্ট এই অনর্থক মামলা দায়ের করায় আবেদনকারীকে ৫০ হাজার ভারতীয় রুপি জরিমানা করেছে। ফারুক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চীন ও পাকিস্তানের সাহায্য চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। আদালত এই অভিযোগ আমলে আনতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মামলাটি খারিজ করেছে।
সত্যিই একটি রাষ্ট্রে বহু মতের মানুষ থাকবে। নানান পথ- মতের সংমিশ্রণেই বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠবে সমাজ ও রাষ্ট্র। যেখানে ভয় থাকবে না। একে অপরকে মান্য করবে। পারস্পরিক সম্মান নিয়ে বসবাস করবে সব মানুষ। শ্রদ্ধা-সম্মান আর ভালোবাসা থাকবে সবার মধ্যে। দায়িত্বশীল আচরণ করবে প্রত্যেক নাগরিক। রক্তাক্ত প্রহারের চিহ্ন দেখা যাবে না কারো ললাটে। আমাদের পূর্বসূরিদের স্বপ্নের সে বাংলাদেশ কবে দেখা যাবে ভবিষ্যতেই তার উত্তর মিলবে।