খাইরুদ্দিন বারবারোসা : মহান তুর্কি অ্যাডমিরাল

সৌখিন আজিজ | Mar 14, 2021 06:30 pm
খাইরুদ্দিন বারবারোসা : মহান তুর্কি অ্যাডমিরাল

খাইরুদ্দিন বারবারোসা : মহান তুর্কি অ্যাডমিরাল - ছবি সংগৃহীত

 

যদি মুসলিম তরুণদের জিজ্ঞেস করা হয় খাইরুদ্দিন বারবারোসার কথা, তাহলে দেখা যাবে বেশির ভাগই তাকে চেনে না। যারা চেনে তারাও হয়তো এটুকুই জানে, তিনি ছিলেন লাল দাড়িওয়ালা একজন জলদস্যূ। ভূমধ্যসাগরে লুটতরাজ করে বেড়াতেন।

আফসোস, ইসলামের এই মহান মুজাহিদ সম্পর্কে এমন চিত্রই অঙ্কন করা হয়েছে হলিউড মুভি এবং পশ্চিমা লেখকদের গল্প-উপন্যাসে। অথচ, খাইরুদ্দিন বারবারোসা কোনো জলদস্যূ ছিলেন না। তিনি ছিলেন উসমানি সালতানাতের নৌবাহিনী প্রধান। উম্মাহর প্রতি তার অসামান্য অবদানের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় সংরক্ষিত আছে। কিন্তু আমরা কি কখনো ইতিহাসের পাতা উল্ট দেখার সুযোগ পেয়েছি? বা ইচ্ছে করেছি ?

খাইরুদ্দিন বারবারোসা হয়তো মধ্যযুগের আর দু-চারজন সেনাপতির মতই ইতিহাসের কোনো এক কোণে ঠাঁই পেতেন, কিন্তু তার অসামান্য কর্মকাণ্ডের ফলে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন। উম্মাহ তাকে স্মরণ করতে বাধ্য তার অবিস্মরনীয় কর্মকাণ্ডের জন্য। খাইরুদ্দিন বারবারোসাকে উম্মাহ স্মরণ করে কারণ,

১। তিনি অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মহান খেদমতে।
২। তিনি আন্দালুস থেকে ৭০ হাজার মুসলমানকে মুক্ত করে আলজেরিয়া নিয়ে আসেন।
৩। স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাত থেকে ভূমধ্যসাগরকে তিনি নিরাপদ করে তোলেন।
৪। প্রিভেজার যুদ্ধে তিনি ক্রুসেডারদের নির্মমভাবে পরাজিত করেন।

খাইরুদ্দিন বারবারোসার জন্ম ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে, গ্রিসের লেসবস দ্বীপে। তিনি ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। পিতা ইয়াকুব বিন ইউসুফ ছিলেন উসমানি বাহিনীর একজন সাধারণ যোদ্ধা। মা ছিলেন আন্দালুসের বংশোদ্ভুত। সাদামাটা ছিমছাম পরিবার। রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে এই পরিবারের কোনো কৃতিত্ব ছিল না। খাইরুদ্দিনের অন্য ভাইয়েরা হলেন আরুজ, ইসহাক ও মুহাম্মদ ইলিয়াস। খাইরুদ্দিনের মূল নাম খাসরুফ।
দ্বীপে বসবাস করার কারনে খাইরুদ্দিনের ভাইয়েরা নৌবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। বড় ভাই আরুজের বেশ কয়েকটি নৌকা ছিল। প্রথমদিকে তিন ভাই নাবিক হিসেবে কাজ করলেও পরে তারা ভূমধ্যসাগরে সেন্ট জনের জলদস্যুদের মোকাবিলা করতে থাকেন। আরুজ ও ইলিয়াস লিভেন্টে (আধুনিক সিরিয়া ও লেবানন) এবং খিজির এজিয়ান সাগরে ততপরতা চালাতেন। খাইরুদ্দিনের মূল ঘাঁটি ছিল থেসালোনিকা। ছোট ভাই ইসহাক গ্রিসেই অবস্থান করতেন। তার কাজ ছিল পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করা।

আরুজ ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ নাবিক। তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। লেবাননের ত্রিপোলিতে এক অভিযান শেষে ফেরার পথে সেন্ট জনের জলদস্যূরা তার উপর হামলা করে। আরুজ বন্দী হন। সংঘর্ষে ইলিয়াস নিহত হন। আরুজ তিন বছর বোদরুম দুর্গে বন্দী থাকেন। সংবাদ পেয়ে খাইরুদ্দিন বোদরুম যান, আরুজকে পালাতে সাহায্য করেন।

মুক্তি পেয়ে আরুজ তুরস্কের আনাতোলিয়ায় যান। সেখানে উসমানি গভর্নর শাহজাদা কোরকুতের সাথে দেখা করেন। শাহজাদা কোরকুত তার কর্মকাণ্ডের কথা জেনে তাকে ১৮ টি গ্যালে দেন এবং জলদ্যুসের বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব অর্পন করেন। সে সময় এই জলদস্যূরা উসমানিয়দের বানিজ্যিক জাহাজগুলোর ওপর হামলা করে বেশ ক্ষতি করছিল। পরের বছর আরুজকে ২৪ টি জাহাজ দিয়ে ইটালির আপুলিয়াতে এক অভিযানে পাঠানো হয়। এই অভিযানে আরুজ বেশ কয়েকটি দুর্গে গোলা বর্ষণ করেন। জলদস্যুদের দুটি জাহাজ দখল করেন। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে আরুজ আরো তিনটি জাহাজ আটক করেন। এসময় তিনি তিউনেসিয়ার জারবা দ্বীপকে নিজের ঘাঁটি বানান। আরুজ একের পর এক অভিযান চালাতে থাকেন। একবার তিনি পোপের দুটি জাহাজ আটক করেন। তবে আরুজ বিখ্যাত হয়ে উঠেন আন্দালুস তথা স্পেনে অভিযান পরিচালনা করে।

১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে আন্দালুসের ইসলামী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। আন্দালুসের মুসলমানদের অনেকে এসময় সাগর পাড়ি দিয়ে তিউনেসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকায় চলে আসেন। যারা পালাতে পারেননি তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। তাদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। এই ধর্মান্তরিতদেরকেই পরে মরিসকো বলে অভিহিত করা হয়। তবে মুসলমানদের অনেকেই বাহ্যিকভাবে ধর্ম পরিবর্তন করে গোপনে নিজের আকিদা বিশ্বাস ধরে রেখেছিলেন। তারা গোপনে ইবাদতও করতেন। কিন্তু এই সুযোগ বেশিদিন মিললো না। তাদেরকে মুখোমুখি হতে হলো ইনকুইজিশনের। ইনকুইজিশন হলো ক্যাথলিক চার্চের অধিনে প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থা যাদের কাজ ছিল বিরোধী মত দমন করা। ইতিপূর্বে ইনকুইজিশনের মাধ্যমে ইউরোপে হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। আন্দালুসের পতনের পর এখানেও চালু করা হয় ইনকুইজিশন।

ইনকুইজিশনের গোয়েন্দারা শহরের অলিগলিতে ঘুরতে থাকে। কারো ঘরে কুরআনুল কারিম পাওয়া গেলে কিংবা কাউকে ইবাদত করতে দেখলেই তাকে গ্রেফতার করা হত। এমনকি কেউ যদি মূকরের মাংস খেতে অস্বীকার করতো, কিংবা শুক্রবার গোসল করতো তাহলেও তাকে গ্রেফতার করা হতো। ইনকুইজিশনের আদালত ছিল ভয়ঙ্কর। সেখানে কারো নামে অভিযোগ উঠলে তার আর রেহাই ছিল না। কোনো না কোনো শাস্তি তাকে পেতেই হতো। ইনকুইজিশনের কাছে নির্যাতন করার জন্য অনেক ভয়ঙ্কর যন্ত্রপাতি ছিল। এসবের সাহায্যে নির্যাতন করা হতো কিংবা জীবন্ত কবর দেয়া হতো।

ইনকুইজিশন শুরু হলে আন্দালুস হয়ে উঠে মুসলমানদের জন্য নরকতূল্য। এমন নরক, যেখান থেকে পালানোর উপায় নেই।

১৫১৪ সালে আরুজ ও খাইরুদ্দিন আলজেরিয়ার জিজেল শহরে অবস্থিত স্প্যানিশদের নৌঘাটিতে হামলা চালান। এই যুদ্ধে স্প্যানিশরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। শহরের নিয়ন্ত্রন আরুজের হাতে চলে আসে। শহরটি সমুদ্রের কূলে অবস্থিত হওয়ার কারণে এর সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করে আরুজ এই শহরকেই নিজেদের হেড কোয়ার্টার বানান। ইতিমধ্যে রোডস দ্বীপে একটি অভিযান চালানোর সময় আরুজ সেন্ট জনের বাহিনীর হাতে বন্দী হন। কিন্তু শিগগিরই তিনি কারাগার থেকে পালিয়ে ইটালি চলে যান। সেখানে ক্রুসেডারদের একটি জাহাজ দখল করে মিসরের পথ ধরেন।

১৫১৮ খিস্টাব্দে আরুজ ও খাইরুদ্দিন তিলিসমান শহরে অবস্থিত স্প্যানিশ বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করেন। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের এক ফাঁকে আরুজকে স্প্যানিশরা ঘিরে ফেলে। তরবারির আঘাতে তাকে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়। আরুজ আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। কালিমায়ে শাহাদাত পড়তে পড়তে তিনি শহিদ হয়ে যান। স্প্যানিশরা আরুজের মাথা কেটে ইউরোপে নিয়ে যায়। তার কাটা মাথা ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ঘুরানো হয়। আরুজের কাটা মাথা যেদিক দিয়ে যেত সেখানকার গির্জায় ঘন্টা বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করা হত।

আরুজের মৃত্যুতে ইউরোপিয়ানরা খুশি ছিল। তারা ভাবছিল আরুজের মৃত্যুর ফলে মুসলমানদের মনোবল ভেঙে যাবে। অথচ মুসলমানরা ব্যক্তি নির্ভর কোনো জাতি নয়। তাদের কাছে পতাকা উত্তোলন করাটাই মূল কাজ, কে করলো তা বড় নয়। আরুজের মৃত্যুতে ইউরোপিয়ানদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছিল। কিন্তু তাদের জানা ছিল না, তাদের এই স্বস্তি বাতাসে মিলিয়ে যাবে। শিগগিরই তাদের মুখোমুখি হতে হবে এমন এক সেনাপতির, যিনি আরুজের চেয়েও দুর্ধর্ষ ও বিচক্ষণ। সামনের দিনগুলোতে যিনি একাই ইউরোপিয়ান বাহিনীর ঘুম কেড়ে নিবেন।
ওই সেনাপতির নাম খাইরুদ্দিন বারবারোসা।

আরুজের মৃত্যুর পর মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব খাইরুদ্দিনের হাতে আসে। তার হাতে ছিল ছোট একটি নৌবাহিনী । এছাড়া আলজেরিয়ার বিশাল এলাকা তার দখলে। তিনি চাইলে স্বাধীন শাসক হিসেবে আলজেরিয়ায় নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। আরাম আয়েশে দিন কাটাতেন। স্প্যানিশদের সাথে খাতির করে নিজের রাজত্ব দৃঢ় করতে পারতেন, যেমনটা করছিল তখন তিউনেসিয়ার হাফসি সুলতানরা।

খাইরুদ্দিন ওই পথে গেলেন না। তিনি তো আরাম আয়েশের জীবন চান না। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহই তার জীবনের ধ্যানজ্ঞান। প্রায়ই তিনি সঙ্গীদের বলতেন, মৃত্যুই যখন শেষ গন্তব্য তখন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বেছে নেয়াই শ্রেয়। খাইরুদ্দিন ভাবছিলেন আন্দালুসের মুসলমানদের কথা। ইতিপূর্বে তিনি ও তার ভাই বেশ কয়েকজন মুসলমানকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এখনো অনেকে বন্দী ইনকুইজিশনের কারাগারে। খাইরুদ্দিন তাদেরকেও মুক্ত করতে চান। এদিকে ভূমধ্যসাগরে ঘুরছে ইউরোপিয়ানদের নৌবহর। খাইরুদ্দিন চান তাদের দম্ভ চূর্ণ করতে। কিন্তু খাইরুদ্দিনের ছোট বাহিনী নিয়ে একাজ করা সম্ভব নয়। তারপাশে চাই শক্তিশালী কোনো মিত্রকে।

খাইরুদ্দিন ভাবছিলেন কে হতে পারে সেই মিত্র। অনেক ভেবে খাইরুদ্দিন ঠিক করলেন, উসমানিয়রাই হতে পারে কাঙ্ক্ষিত সেই মিত্র।

৩ নভেম্বর ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে খাইরুদ্দিনের আদেশে আলজেরিয়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বরা সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে একটি পত্র লিখে। পত্রে তারা আরুজ ও খাইরুদ্দিনের অবদানের কথা উল্লেখ করে। ইউরোপিয়ানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়। তারপর সুলতানের কাছে আবেদন জানানো হ,য় সুলতান যেন আলজেরিয়াকে উসমানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

সুলতান প্রথম সেলিম তখন সবেমাত্র মিসর ও সিরিয়া সফর শেষে ফিরেছেন। এই পত্র পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হন। তিনি আলজেরিয়াকে উসমানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। ওই দিন থেকে সুলতান সেলিমের নামে আলজেরিয়াতে খুতবা পড়া শুরু হয়। সুলতান আলজেরিয়াতে দু'হাজার সৈন্য ও একটি তোপখানা প্রেরণ করেন। খাইরুদ্দিনকে সম্মানসূচক বেলারবি পদ দান করা হয়। খাইরুদ্দিন তার ভাইয়ের স্থাল্ভিষিক্ত হন, ভাইয়ের অসমাপ্ত মিশন সমাপ্ত করার দায়িত্ব পান।

খাইরুদ্দিন তো এটাই চাচ্ছিলেন। তিনি ক্ষমতা চাচ্ছিলেন না। চাচ্ছিলেন সামান্য একটু সাহায্য, যা নিয়ে তিনি ছুটে যাবেন নির্যাতিত মুসলমানদের কাছে।

সুলতান প্রথম সেলিমের পর ক্ষমতায় বসেন সুলতান সুলাইমান আল কানুনি। তিনিও পিতার মতো খাইরুদ্দিনকে সাহায্য করতে থাকেন।
১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে খাইরুদ্দিন আলজেরিয়ার একটি দ্বীপে অবস্থিত স্প্যানিশ দুর্গে হামলা করেন। তিনি ২০ দিন একটানা গোলাবর্ষণ করেন। পরে কেল্লার পতন হয়। স্প্যানিশরা পালিয়ে যায়, অনেকে বন্দি হয়। সে বছরই খাইরুদ্দিন ৩৬ টি জাহাজ নিয়ে স্পেনের উপকূলের বিভিন্ন শহরে যান এবং অনেক মুসলমানকে মুক্ত করে আলজেরিয়া নিয়ে আসেন। স্পেন তখন রোমানিয়ার শাসক চার্লস পঞ্চমের অধীনে। এভাবে খাইরুদ্দিন বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন।

খাইরুদ্দিন সাত দফায় ৭০ হাজার বন্দী মুসলমানকে স্পেন থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। খাইরুদ্দিনের মূল নাম ছিল খসরুফ।

আন্দালুসিয়ার বাসিন্দারা তাকে উপাধি দেয় খাইরুদ্দিন। পরে এই নামই প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এই নামের সাথেই মিশে আছে দ্বীন ও উম্মাহর জন্য তার অসামান্য কোরবানীর ইতিহাস। ইউরোপিয়রা তাকে নাম দেয় বারবারোসা। ইটালিয় ভাষায় এই শব্দের অর্থ লাল দাড়িওয়ালা।

খাইরুদ্দিন নিয়মিত ভূমধ্যসাগরে অভিযান পরিচালনা করছিলেন। একের পর এক ইউরোপিয়ান নৌবহরকে তিনি পরাজিত করতে থাকেন। তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য।

১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সুলাইমান কানুনি খাইরুদ্দিনকে ইস্তাম্বুলে আমন্ত্রণ করেন। খাইরুদ্দিন ৪৪টি জাহাজ নিয়ে ইস্তাম্বুলের পথে রওনা হন। পথে যেসব দ্বীপে তিনি যাত্রাবিরতি করছিলেন সবখানেই উৎসুক জনতা তাকে একনজর দেখতে ছুটে আসে। খাইরুদ্দিন ইস্তাম্বুল পৌঁছলে তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয়া হয়। প্রাসাদের পাশেই একটি মহলে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

উজিরে আযম তখন হালাবে অবস্থান করছিলেন। খাইরুদ্দিনের ইস্তাম্বুল আগমনের সংবাদ পেয়ে তার মন আনচান করে ওঠে। তারও ইচ্ছে হয় এই মর্দে মুজাহিদকে একনজর দেখার। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যস্ততার কারণে তিনি ইস্তাম্বুল ফেরার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। তিনি সুলতানের কাছে পত্র লিখে নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন। সুলতান সুলাইমান খাইরুদ্দিনকে হালাবে প্রেরণ করেন। একইসাথে উজিরে আজমকে পত্র লিখে বলেন, খাইরুদ্দিনকে সম্বর্ধনা দিতে, আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি না করতে।

হালাবে খাইরুদ্দিনকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। পরে তিনি ইস্তাম্বুল ফিরে আসেন। সুলতান তাকে উসমানি নৌবাহিনীর প্রধান (কাপুদান-ই-দরিয়া) নিযুক্ত করেন। একইসাথে তাকে উত্তর আফ্রিকার বেলারবি (গভর্নর) নিয়োগ দেয়া হয়। সুলতান তাকে রত্নখচিত একটি তরবারি উপহার দেন। খাইরুদ্দিনকে নির্দেশ দেয়া হয় একটি নতুন নৌবাহিনী গঠন করার। তাকে অস্ত্রাগার ও গোল্ডেন হর্নের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়। খাইরুদ্দিন দ্রুত কাজ শুরু করেন। এক বছরে ৮৪টি জাহাজ নির্মাণ হয়। খাইরুদ্দিন তার বহর নিয়ে ইটালির কয়েকটি দ্বীপে হামলা করেন। কয়েকটি শহর উসমানিদের দখলে আসে।

ঐতিহাসিক হাজি খলিফা লিখেছেন, বারবারোসা ১২টি দ্বীপ দখল করেন। আরো ১৩টি দ্বীপে হামলা করে আর্থিকভাবে লাভবান হন। তার অভিযানে মোট ১৬ হাজার লোক বন্দী হয়। মুক্তিপণ হিসেবে পাওয়া যায় চার লাখ স্বর্ণমুদ্রা।

একের পর এক হামলায় বিপর্যস্ত ইউরোপিয়ানরা সিদ্ধান্ত নেয় এবার তারা খাইরুদ্দিনের উপর চূড়ান্ত হামলা করবে। ভূমধ্যসাগর থেকে মুসলিম নৌবহরকে বিতাড়ন করা হবে। পোপ তৃতীয় জন পল হলি লীগ আহবান করেন। পুরো ইউরোপে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। গঠিত হয় সে সময়ের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী। এই বহরে ছিল

১। রিপাবলিক অব ভেনিস
২। ডাচি অব মান্তুয়া
৩। স্প্যানিশ এম্পায়ার
৪। পর্তুগিজ এম্পায়ার
৫। পাপাল স্টেটস
৬। রিপাবলিক অব জেনোয়া
৭। অর্ডার অব সেইন্ট জন

ইউরোপিয়ানদের প্রস্তুতির খবর পৌঁছে যায় খাইরুদ্দিনের কাছে। তিনিও তার বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকেন। অবশেষে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর দুই বাহিনী গ্রিসের প্রিভেজা এলাকায় মুখোমুখি হয়।

২৮ সেপ্টেম্বর ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ।
ইউরোপিয়ান বাহিনীর মুখোমুখি উসমানি বাহিনী। আজই ফয়সালা হবে কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে ভূমধ্যসাগরের নৌপথ। ইউরোপিয়ানদের বিশাল বাহিনী। যুদ্ধ জাহাজ এসেছে ৩০২টি। মোট সেনাসংখ্যা ৬০ হাজার। অপরদিকে উসমানি বাহিনীর জাহাজ ১২২টি। সেনাসংখ্যা মাত্র ১২ হাজার। ইউরোপিয়ান বাহিনীর নেতৃত্বে এন্ডড়িয়া ডোরিয়া। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে খাইরুদ্দিন বারবারোসা। তার সহকারী হিসেবে আছেন সাইয়িদি আলি রইস, বিখ্যাত মিরআতুল মামালিক গ্রন্থের লেখক।

যেকোনো বিশ্লেষণেই এই যুদ্ধ ছিল অসম যুদ্ধ। শক্তির বিচারে দুর্বল উসমানি বাহিনী ইউরোপিয়ান বাহিনীর সামনে বেশিক্ষণ টেকার কথা নয় ।

খাইরুদ্দিন বারবারোসা তার বহরকে চারটি ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম তিনটি বহর তিনি বক্রাকারে সাজান। যুদ্ধের শুরুতেই এই তিন বহর বক্রাকারে এগিয়ে যায় ইউরোপিয়ান বাহিনীর দিকে। এন্ড্রিয়া ডোরিয়া অবাক হয়ে দেখলেন উসমানি বাহিনী তাকে ঘিরে ফেলতে চাচ্ছে। স্বল্পসংখ্যক উসমানি বাহিনী থেকে এমন দুঃসাহসিক হামলা পুরোপুরি অবিশ্বাস্য। এন্ড্রিয়া ডোরিয়া তার বহর নিয়ে সরে যেতে চাইলেও বাতাস স্থির থাকায় তার চেষ্টা সফল হয় না। ইতিমধ্যে খাইরুদ্দিনের বহর থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। ইউরোপিয়ান বাহিনী পাল্টা জবাব দেয়, কিন্তু খাইরুদ্দিনের প্রথম আক্রমণ তাদের মনোবলে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়।

যুদ্ধ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্র হয়ে ওঠে কুরুক্ষেত্র। একের পর এক কামান গর্জাচ্ছে, বাতাসে বারুদ ও রক্তের গন্ধ। চারপাশ থেকে আহতদের চিৎকার ও জীবিতদের শ্লোগান ভেসে আসে। যুদ্ধে উসমানি বাহিনী এগিয়ে যায়। বিপুল সেনা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপিয়ান বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। সাত ঘন্টার লড়াই শেষে ইউরোপিয়ান বাহিনী পরাজিত হয়। এন্ড্রিয়া ডোরিয়া পালিয়ে যায়। যুদ্ধে ইউরোপিয়ানদের ১৩টি জাহাজ ধবংস হয়। ৩৬টি জাহাজ উসমানিয়রা দখল করে। ৩০০০ ইউরোপিয়ান সেনা বন্দি হয়। অপরদিকে উসমানিয়দের ৪০০ সেনা নিহত হন, ৮০০ আহত হন। তাদের কোনো জাহাজই হারাতে হয়নি।

এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল অবিশ্বাস্য। শিগগিরই এই যুদ্ধের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম বিশ্বজুড়ে। মক্কা, মদীনা, আল কুদস, সমরকন্দ, দামেশক, কায়রোর মসজিদ্গুলোর মিনার হতে উচ্চারিত হতে থাকে আল্লাহু আকবর ধবনী।
এই যুদ্ধের ফলে ভূমধ্যসাগরে উসমানিয়দের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী তিন শ' বছর ধরে ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতেই। এমনকি ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও সিসিলির জাহাজগুলো ভূমধ্যসাগরে চলার জন্য উসমানিয়দের ট্যাক্স দিত।

এই যুদ্ধ জয়ের পেছনে ছিল খাইরুদ্দিন বারবারোসার কুশলী আক্রমণ ও সেনা পরিচালনা। ইউরোপের কাছে এই নাম ছিল আতঙ্কের মতো।

১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে খাইরুদ্দিন ইতালির সানরেমো, বোরঘেট্টো সান্টো স্পিরিটো ও সিরাইলিতে আক্রমণ করেন। তিনি স্পেন ও ইতালির নৌবহরকে পরাজিত করেন। নেপসলের ভেতরে হামলা চালান। এরপর তিনি ২১০ জাহাজের পুরো বহর নিয়ে জেনোয়ার দিকে রওনা হন। সেখানে তুর্কি এডমিরাল তুরগুত রইসকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। খাইরুদ্দিন হুমকি দেন রইসকে মুক্তি না দিলে তিনি শহরে হামলা চালাবেন। জেনয়ার ফাসোলতে এন্ড্রিয়া ডোরিয়ার প্রাসাদে খাইরুদ্দিনের সাথে বৈঠক হয়। শেষে সিদ্ধান্ত হয় তিন হাজারের স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে রইসকে মুক্তি দেয়া হবে।

এরপর খাইরুদ্দিন এলবো শহরের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হন। এই শহরে অটোমান নৌকমান্ডার সিনান রইসের পুত্র বন্দী ছিলেন। খাইরুদ্দিন হুমকি দেন তাকে মুক্তি দেয়া না হলে তিনি শহরে গোলাবর্ষন করবেন। শহরের প্রশাসক খাইরুদ্দিনের কথায় রাজি না হলে খাইরুদ্দিন তীব্র হামলা চালান। শেষে বারবারোসার তীব্রতার কাছে শহরের প্রশাসক হার মানতে বাধ্য হন। সিনান রইসের পুত্রকে মুক্তি দেয়া হয়।

খাইরুদ্দিন বারবারোসার সারাজীবন কেটেছে সমুদ্রে। একের পর এক লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। চাইলেই নির্বিঘ্ন জীবন বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু সে পথে হাটেননি কখনো। উম্মাহর কল্যানসাধনের মাঝেই খুজে পেয়েছিলেন সুখ।
পুঁথিগত বিদ্যায় খাইরুদ্দিন হয়তো বড় কেউ ছিলেন না। কিন্তু তার জীবনটাই হয়ে উঠেছে উত্তরসূরিদের জন্য হাজারো বইয়ের চেয়ে মূল্যবান কিছু।

১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে পুত্র হাসান পাশাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে খাইরুদ্দিন বারবারোসা ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন। তিনি মুরাদি সিনানকে তার আত্মজীবনী লেখার জন্য নির্দেশ দেন। পাঁচ খণ্ডে হাতে লেখা এই আত্মজীবনী সমাপ্ত হয়। এটি সাধারণত গাজাওয়াত-ই-খাইরুদ্দিন নামে পরিচিত। সম্প্রতি তুর্কি অধ্যাপক ড আহমদ সামগিরশিল কাপ্তান পাসানিন সায়ের দেফতরি (ক্যাপ্টেন পাশার লগবুক) নামে এই আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন।

খাইরুদ্দিন বারবারোসার পতাকার শীর্ষে ছিল সুরা আস সাফের ১৩ নম্বর আয়াত।

‘এবং আরো একটি (অর্জন) যা তোমরা খুব পছন্দ কর। (অর্থাৎ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়। আর মুমিনদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও।’

আয়াতের নিচে ছিল চারটি তারকা। চার তারকার ভেতরে চার খলিফার নাম। চার তারকার মাঝখানে একটি দ্বিফলা তরবারি যা ছিল জুলফিকারের প্রতীক। নিচে একটি ৬ প্রান্তবিশিষ্ট তারকা।

এই মহান যোদ্ধা ৪ জুলাই ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইস্তাম্বুলে ইন্তেকাল করেন।

সূত্র

১। আদ দাওলাতুল উসমানিয়া : আলি মুহাম্মদ আস সাল্লাবি
২। খাইরুদ্দিন বারবারোসা : বাসসাম ইসিলি।
৩। দাওলাতে উসমানিয়া : ডক্টর মুহাম্মদ আজিজ
৪। মুজাকারাতু খাইরুদ্দিন : ইমরান রায়হান

 

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us