খাইরুদ্দিন বারবারোসা যেভাবে ধ্বংস করেছিলেন ইউরোপের নৌবহরকে
বারবারোসা ও তার নৌবহর - ছবি সংগৃহীত
নাম তার খাইরুদ্দিন বারবারোসা। তবে মূল নাম ছিল খসরুফ। উসমানিয়া সুলতান তাকে তার নৌবাহিনীর প্রধান বানিয়েছিলেন। আর আন্দালুসিয়ার বাসিন্দারা তাকে উপাধি দেয় খাইরুদ্দিন। পরে এই নামই প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এই নামের সাথেই মিশে আছে দ্বীন ও উম্মাহর জন্য তার অসামান্য কোরবানীর ইতিহাস। ইউরোপিয়রা তাকে নাম দেয় বারবারোসা। ইটালিয় ভাষায় এই শব্দের অর্থ লাল দাড়িওয়ালা।
খাইরুদ্দিন নিয়মিত ভূমধ্যসাগরে অভিযান পরিচালনা করছিলেন। একের পর এক ইউরোপিয়ান নৌবহরকে তিনি পরাজিত করতে থাকেন। তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য।
১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সুলাইমান কানুনি খাইরুদ্দিনকে ইস্তাম্বুলে আমন্ত্রণ করেন। খাইরুদ্দিন ৪৪টি জাহাজ নিয়ে ইস্তাম্বুলের পথে রওনা হন। পথে যেসব দ্বীপে তিনি যাত্রাবিরতি করছিলেন সবখানেই উৎসুক জনতা তাকে একনজর দেখতে ছুটে আসে। খাইরুদ্দিন ইস্তাম্বুল পৌঁছলে তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয়া হয়। প্রাসাদের পাশেই একটি মহলে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
উজিরে আযম তখন হালাবে অবস্থান করছিলেন। খাইরুদ্দিনের ইস্তাম্বুল আগমনের সংবাদ পেয়ে তার মন আনচান করে ওঠে। তারও ইচ্ছে হয় এই মর্দে মুজাহিদকে একনজর দেখার। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যস্ততার কারণে তিনি ইস্তাম্বুল ফেরার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। তিনি সুলতানের কাছে পত্র লিখে নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন। সুলতান সুলাইমান খাইরুদ্দিনকে হালাবে প্রেরণ করেন। একইসাথে উজিরে আজমকে পত্র লিখে বলেন, খাইরুদ্দিনকে সম্বর্ধনা দিতে, আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি না করতে।
হালাবে খাইরুদ্দিনকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। পরে তিনি ইস্তাম্বুল ফিরে আসেন। সুলতান তাকে উসমানি নৌবাহিনীর প্রধান (কাপুদান-ই-দরিয়া) নিযুক্ত করেন। একইসাথে তাকে উত্তর আফ্রিকার বেলারবি (গভর্নর) নিয়োগ দেয়া হয়। সুলতান তাকে রত্নখচিত একটি তরবারি উপহার দেন। খাইরুদ্দিনকে নির্দেশ দেয়া হয় একটি নতুন নৌবাহিনী গঠন করার। তাকে অস্ত্রাগার ও গোল্ডেন হর্নের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়। খাইরুদ্দিন দ্রুত কাজ শুরু করেন। এক বছরে ৮৪টি জাহাজ নির্মাণ হয়। খাইরুদ্দিন তার বহর নিয়ে ইটালির কয়েকটি দ্বীপে হামলা করেন। কয়েকটি শহর উসমানিদের দখলে আসে।
ঐতিহাসিক হাজি খলিফা লিখেছেন, বারবারোসা ১২টি দ্বীপ দখল করেন। আরো ১৩টি দ্বীপে হামলা করে আর্থিকভাবে লাভবান হন। তার অভিযানে মোট ১৬ হাজার লোক বন্দী হয়। মুক্তিপণ হিসেবে পাওয়া যায় চার লাখ স্বর্ণমুদ্রা।
একের পর এক হামলায় বিপর্যস্ত ইউরোপিয়ানরা সিদ্ধান্ত নেয় এবার তারা খাইরুদ্দিনের উপর চূড়ান্ত হামলা করবে। ভূমধ্যসাগর থেকে মুসলিম নৌবহরকে বিতাড়ন করা হবে। পোপ তৃতীয় জন পল হলি লীগ আহবান করেন। পুরো ইউরোপে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। গঠিত হয় সে সময়ের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী। এই বহরে ছিল
১। রিপাবলিক অব ভেনিস
২। ডাচি অব মান্তুয়া
৩। স্প্যানিশ এম্পায়ার
৪। পর্তুগিজ এম্পায়ার
৫। পাপাল স্টেটস
৬। রিপাবলিক অব জেনোয়া
৭। অর্ডার অব সেইন্ট জন
ইউরোপিয়ানদের প্রস্তুতির খবর পৌঁছে যায় খাইরুদ্দিনের কাছে। তিনিও তার বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকেন। অবশেষে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর দুই বাহিনী গ্রিসের প্রিভেজা এলাকায় মুখোমুখি হয়।
২৮ সেপ্টেম্বর ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ।
ইউরোপিয়ান বাহিনীর মুখোমুখি উসমানি বাহিনী। আজই ফয়সালা হবে কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে ভূমধ্যসাগরের নৌপথ। ইউরোপিয়ানদের বিশাল বাহিনী। যুদ্ধ জাহাজ এসেছে ৩০২টি। মোট সেনাসংখ্যা ৬০ হাজার। অপরদিকে উসমানি বাহিনীর জাহাজ ১২২টি। সেনাসংখ্যা মাত্র ১২ হাজার। ইউরোপিয়ান বাহিনীর নেতৃত্বে এন্ডড়িয়া ডোরিয়া। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে খাইরুদ্দিন বারবারোসা। তার সহকারী হিসেবে আছেন সাইয়িদি আলি রইস, বিখ্যাত মিরআতুল মামালিক গ্রন্থের লেখক।
যেকোনো বিশ্লেষণেই এই যুদ্ধ ছিল অসম যুদ্ধ। শক্তির বিচারে দুর্বল উসমানি বাহিনী ইউরোপিয়ান বাহিনীর সামনে বেশিক্ষণ টেকার কথা নয় ।
খাইরুদ্দিন বারবারোসা তার বহরকে চারটি ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম তিনটি বহর তিনি বক্রাকারে সাজান। যুদ্ধের শুরুতেই এই তিন বহর বক্রাকারে এগিয়ে যায় ইউরোপিয়ান বাহিনীর দিকে। এন্ড্রিয়া ডোরিয়া অবাক হয়ে দেখলেন উসমানি বাহিনী তাকে ঘিরে ফেলতে চাচ্ছে। স্বল্পসংখ্যক উসমানি বাহিনী থেকে এমন দুঃসাহসিক হামলা পুরোপুরি অবিশ্বাস্য। এন্ড্রিয়া ডোরিয়া তার বহর নিয়ে সরে যেতে চাইলেও বাতাস স্থির থাকায় তার চেষ্টা সফল হয় না। ইতিমধ্যে খাইরুদ্দিনের বহর থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। ইউরোপিয়ান বাহিনী পাল্টা জবাব দেয়, কিন্তু খাইরুদ্দিনের প্রথম আক্রমণ তাদের মনোবলে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়।
যুদ্ধ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্র হয়ে ওঠে কুরুক্ষেত্র। একের পর এক কামান গর্জাচ্ছে, বাতাসে বারুদ ও রক্তের গন্ধ। চারপাশ থেকে আহতদের চিৎকার ও জীবিতদের শ্লোগান ভেসে আসে। যুদ্ধে উসমানি বাহিনী এগিয়ে যায়। বিপুল সেনা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপিয়ান বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। সাত ঘন্টার লড়াই শেষে ইউরোপিয়ান বাহিনী পরাজিত হয়। এন্ড্রিয়া ডোরিয়া পালিয়ে যায়। যুদ্ধে ইউরোপিয়ানদের ১৩টি জাহাজ ধবংস হয়। ৩৬টি জাহাজ উসমানিয়রা দখল করে। ৩০০০ ইউরোপিয়ান সেনা বন্দি হয়। অপরদিকে উসমানিয়দের ৪০০ সেনা নিহত হন, ৮০০ আহত হন। তাদের কোনো জাহাজই হারাতে হয়নি।
এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল অবিশ্বাস্য। শিগগিরই এই যুদ্ধের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম বিশ্বজুড়ে। মক্কা, মদীনা, আল কুদস, সমরকন্দ, দামেশক, কায়রোর মসজিদ্গুলোর মিনার হতে উচ্চারিত হতে থাকে আল্লাহু আকবর ধবনী।
এই যুদ্ধের ফলে ভূমধ্যসাগরে উসমানিয়দের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী তিন শ' বছর ধরে ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতেই। এমনকি ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও সিসিলির জাহাজগুলো ভূমধ্যসাগরে চলার জন্য উসমানিয়দের ট্যাক্স দিত।
এই যুদ্ধ জয়ের পেছনে ছিল খাইরুদ্দিন বারবারোসার কুশলী আক্রমণ ও সেনা পরিচালনা। ইউরোপের কাছে এই নাম ছিল আতঙ্কের মতো।