ভারতের একটি বীভৎস চিত্র
ভারতের একটি বীভৎস চিত্র - ছবি সংগৃহীত
ভারতে বর্ণপ্রথা তথা কাস্ট সিস্টেম হচ্ছে সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকা সোশ্যাল হায়ারারকি। দেশটিতে কার্যকর রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো বর্ণক্রমভিত্তিক সামাজিক কর্তৃত্ব ব্যবস্থা। সংবিধানভাষ্যে ভিন্ন কথা থাকলেও বাস্তবে ভারত যেমনিভাবে একটি বর্ণভিত্তিক দেশ, তেমনিভাবে এটি একটি কৃষিভিত্তিক দেশও। এর পুরো সামাজিক কাঠামো হচ্ছে বর্ণ ও শ্রেণীভিত্তিক। দেশটিতে চারটি বর্ণ হচ্ছে, ব্রাহ্মণ (যাজক), ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা), বৈশ্য (বণিক) এবং শূদ্র (শ্রমিক)। বর্ণপ্রথার বাইরে পঞ্চম আরেকটি গোষ্ঠী রয়েছে, যারা চিহ্নিত অস্পৃশ্য বা দলিত নামে। এই বর্ণপ্রথা আজকের এই দিনে বিভাজিত হয়েছে আরো হাজারো বর্ণে, যেখানে দলিতরা সবচেয়ে অবহেলিত-নিপীড়িত ও প্রান্তিক।
পেশা বিভাজিত হয়েছে বর্ণের ওপর ভিত্তি করে এবং আজকাল এগুলোকে একচেটিয়া করে তোলা হয়েছে। ধরা যাক, একজন নিম্নবর্ণের হিন্দু একটি চায়ের দোকান খুলতে চায়। এই ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলাকে তুলনামূলক অনেক বেশি বাধার মুখে পড়তে হবে একজন উচ্চবর্ণের হিন্দুর তুলনায়। ভারতে বিভিন্ন চায়ের দোকানে দু-ধরনের চায়ের কাপ ও গ্লাস দেখতে পাওয়া যায়। এক সেট নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য, আর অপর সেট উচ্চ বর্ণের মানুষের জন্য। খবরে প্রকাশ ঝাঁসির গ্রামগুলোতে এখনো উচ্চবর্ণের মানুষের বাড়ির সামনে দিয়ে নিম্ন বর্ণের মানুষকে পায়ের জুতা খুলে পার হতে হয়। এটি সোশ্যাইটাল হায়ারারকির একটি উদাহরণ।
৭৮ বছর বয়সী সারওয়ান রাম ধারাপুরি। পাঞ্জাবের জলন্ধর জেলার লোক। তিনি ১৯৭২ সালের ব্যাচের উত্তর-প্রদেশ ক্যাডারের একজন আইপিএস অফিসার। ২০০৩ সালে তিনি অবসরে যান। অবসর-উত্তর সময়ে তিনি প্রচুর কাজ করেছেন মানবাধিকার-সম্পর্কিত বিষয়ে। পাশাপাশি কাজ করেছেন দলিতদের অধিকার, আরটিআই, বর্ণ অধিকার আইন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। বর্তমানে তিনি উত্তর-প্রদেশ রাজ্যের মজদুর কৃষাণ মঞ্চের প্রেসিডেন্ট, ড. আম্বেদকার মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ‘অল ইন্ডিয়া পিপলস ফ্রন্ট’-এর জাতীয় মুখপাত্র।
তিনি সম্প্রতি গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছেন দলিত সম্প্রদায় ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত নিপীড়ন ও বৈষশ্যেও কিছু উদাহরণ। গুরকপুরে আইপিএস অফিসার পদে তার পদায়নের সময় তিনি প্রথম বারের মতো এক সমস্যায় পড়েন। কিছু লোকের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি দেখতে পান- কিছু লোক বসে আছে মাটিতে, আর কিছু লোক বেঞ্চে। তাকে জানানো হলো- যারা মাটিতে বসেছে, এরা নিম্নবর্ণের মানুষ। আর যারা বেঞ্চের ওপর বসে আছে তারা উচ্চবর্ণের মানুষ। তিনি ভাবতে শুরু করেন- ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, যেখানে সরকারের কাজ হচ্ছে এই বর্ণপ্রথার অবসান করা, সেখানে সরকারি আয়োজনে চর্চিত হচ্ছে এই বর্ণপ্রথার হায়ারারকি?
তার অবসরোত্তর সময়ে তিনি উত্তর-প্রদেশের হারোদি জেলায় জমির মালিকানা বিষয় নিয়ে কাজ করেন। ১৯৭০-এর দশকে একটি দলিত পরিবারকে কিছু জমি দেয়া হয়। কিন্তু সে জমি দখল করতে দেয়া হয়নি। স্থানীয় লোকদের শোষণের কারণে নিজের জমিতে তাকে চাষাবাদ করতেও দেয়া হয়নি। সারয়ান রাম ধারাপুরি বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন এবং ঘটনার শিকার পরিবারের সাথে ধরনা দিতে শুরু করেন এবং ৩৪ বছরের দুর্ভোগের পর পরিবারটি তাদের জমির ওপর পূর্ণ দখল পায়। আরেকটি ঘটনা ঘটে একটি গ্রামে। সে গ্রামে নতুন নির্বাচিত গ্রামপ্রধান ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের লোক। কিন্তু তিনি তার দায়িত্ব নিতে পারেননি। তিনি পূর্ববর্তী অ-দলিত গ্রামপ্রধানের মতো দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না। পূর্ববর্তী অদলিত গ্রামপ্রধান তার কাছে রেজিস্টার ও দায়িত্বও হস্তান্তর করছিলেন না। এ ঘটনায়ও ধারাপুরি ও সমাজকর্মীরা হস্তক্ষেপ করেন। তারা লড়াই করেন এই নতুন নির্বাচিত দলিত গ্রামপ্রধানের অধিকার আদায়ের পক্ষে।
২০১৮ সালে তিনি লক্ষেèৗয়ে কিছু বর্ণপ্রথা চর্চার কথা জানতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টের জারি করা আদেশকে ভিত্তি করে রাজ্য সরকারকে নিশ্চিত করত হয় বর্ণপ্রথা অবসানকল্পে সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী থেকে লোক নিয়োগ করতে হয় স্কুলে শিশুদের দুপুরের খাবার তৈরির জন্য। স্কুলে ৭৬ জন্য তালিকাভুক্ত ছাত্রের মধ্যে ৭০ জন এই খাবার খেতে অস্বীকার করে। কারণ, দলিত মহিলারা এই খাবার তৈরি করেছিল। ছাত্রদের বাবা-মায়েরাও প্রতিবাদ জানিয়েছিল দলিত মহিলাদের দিয়ে এই খাবার পাক করার ব্যাপারে। ধারাপুরি এ ব্যাপারে একটি তদন্ত দাবি করেন। সেই সাথে এই এলাকায় দলিত মহিলাদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি উল্লেখ করেন, বর্ণপ্রথার অবসানের ছোট ছোট পদ্ধক্ষেপই যথেষ্ট। আর সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে বর্ণপ্রথা সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে। অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের বেলায় একই কথা খাটে যেমন : নারী-পুরষ, ধর্ম, গোত্র ও যৌন বৈষম্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানও সামাজিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই অবসান ঘটাতে হবে।
ভারতে দলিত রাজনীতি ও দলিত আন্দোলন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সীমিত ছিল সরকারি চাকরিতে তাদের কোটা সংরক্ষণের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে দলিত নেতাদের বিজয়কে দলিত রাজনীতির বিজয় বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু এটি বললে ভুল হবে না, এমনকি একজন দলিতও যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন, তবু দলিতদের উন্নয়ন সহজে ঘটবে না। এর লাভটুকু পাবেন শুধু দলিত নেতারা, যারা রাজনৈতিক ক্ষমতাসমৃদ্ধ হবেন। কিন্তু দলিত শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক ও আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন কখনোই বন্ধ হবে না। তাদের চিরদারিদ্র্য যথারীতি বহাল থাকবে। তাই দলিত রাজনীতি ও আন্দোলন নিয়ে যেতে হবে সে পথে, যে পথে নিম্নবর্ণের দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করা যায়। সোশ্যাল হায়ারারকি তথা সামাজিক বর্ণক্রমভিত্তিব কর্তৃত্ব বন্ধ করতে না পারলে সমাজে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বর্ণপ্রথার অভিশাপ দূর করা সম্ভ হবে না।
এত গেল বর্ণপ্রথার সামাজিক দিক। ভারতীয় সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বর্ণপ্রথাকে ভিত্তি করে। আর সে কারণেই সামাজিক পরিবর্তন না এনে রাষ্ট্র বা সরকার কোনো উপায়েই বর্ণপ্রথা দূর করে সব শ্রেণীর ও বর্ণের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে না। কারণ, বর্ণপ্রথাভিত্তিক সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় উঁচু বর্ণের লোকদের দিয়ে। রাষ্ট্র এই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করে, তাদের মধ্যে কেউ তা করতে চাইলেও করতে পারে না। তাই প্রশ্ন আসে- যে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে চাইলেই কি পারবে সমাজ থেকে বর্ণপ্রথার অবসান ঘটাতে? বিকল্প প্রশ্ন আসতে পারে- বর্ণপ্রথাবিরোধী জনগোষ্ঠী কি শাসকগোষ্ঠী হতে পারে? এমন কিছু ভারতে ঘটেনি স্বাধীন ভারতের কোনো কালে। সংবিধান তাদের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।
ড. আম্বেদকার ১৯৪২ সালে কানাডার কিউবেকের ‘ইনস্টিটিউট অব প্যাসিফিক রিলেশনস’ আয়োজিত এক সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য ‘মি: গান্ধী অ্যান্ড দ্য এমানসিপেশন অব দ্য আনটাচেবলস’-শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধটি ছিল তার ‘কাস্ট অ্যান্ড কনস্টিটিউশন’ সম্পর্কিত বইয়ের একটি অধ্যায়। প্রবন্ধটি বই আকারে ছাপা হয় ১৯৪৩ সালে। উপরে উল্লিখিত শিরোনামে অধ্যায়ে ড. আম্বেদকার লিখেন : ‘একটি সংবিধান প্রণয়নকালে সামাজিক কাঠামোকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। রাজনৈতিক কাঠামোকে সম্পর্কিত করতে হবে সামাজিক কাঠামোর সাথে। সামাজিক শক্তির কর্মকাণ্ড সামাজিক ক্ষেত্রেই সীমিত নয়। এরা ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও।’
রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর তার জোর তাগিদ সামাজিক ব্যবস্থা অনুসরণ করেই। একই প্রবন্ধে তিনি দাবি তোলেন অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকারের। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের জনগোষ্ঠীর একমাত্র নিরাপত্তা হচ্ছে রাজনৈতিক অধিকার থাকা। অস্পৃশ্যরা সংবিধানে সংজ্ঞায়িত হিন্দু সংখ্যাগুরুর জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই সুরক্ষা দাবি করে।’
অতএব ড. আম্বেদকার দলিতদের সুরক্ষা চেয়েছেন সংবিধানের মাধ্যমে। তিনি নিজে ছিলেন ভারতের সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান। তার ১৯৪২ সালের ভাবনা প্রতিফলন রয়ছে ১৯৫০ সালে কার্যকর ভারতীয় সংবিধানে। সংবিধান হচ্ছে শাসকদের রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ- প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ পরিচালনার নির্দেশিকা। ড. আম্বেদকার রচিত ভারতীয় সংবিধান বর্ণপ্রথা নাশের সর্বোচ্চ সমর্থক এক সংবিধান। এতে রয়েছে একটি রষ্ট্রের জন্য বর্ণপ্রথা বিনাশের গাইডলাইন। এই সংবিধানের মুখবন্ধে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে : সব নাগরিকের প্রতি ন্যায়বিচার, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায্যতা বিধান করা, সমমর্যাদা ও সমসুযোগ দেয়াসহ তাদের মধ্যে সব ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ ও ব্যক্তি মর্যাদার উন্নয়ন। সংবিধানের মুখবন্ধ হচ্ছে স্থিরসংকল্প। এটি মৌলিক অধিকারের কোনো অনুচ্ছেদ নয়। কিন্তু মুখবন্ধের আওতার স্থিরসংকল্পগুলো রাষ্ট্রের মাধ্যমে আজো ভারতে অর্জিত হয়নি।
ভারতীয় সংবিধানের ১৪ থেকে ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে সমতার অধিকার। অনুচ্ছেদ১৪-তে বলা আছে আইনের চোখে সবার সমানাধিকার; অনুচ্ছেদ ১৫-তে বলা আছে : ধর্ম, সম্প্রদায়, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থান বিবেচনায় কোনো বৈষম্য করা যাবে না। ১৬ অনুচ্ছেদ মতে, সরকারি চাকরিতে সমসুযোগ লাভের অধিকার দিতে হবে, এতে পশ্চাৎপদ শ্রেণীর জন্য চাকরি সংরক্ষণের কথাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং ১৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে অস্পৃশ্যতা অবসানের তাগিদ।
সংবিধানে এসব স্থিরসিদ্ধান্ত থাকলেও সমাজে এর বাস্তবায়ন হয়েছে কি? হয়নি। অস্পৃশ্যতার অবসান ঘটেনি। ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্যতা প্রবলভাবে প্রচলিত- গ্রামীণ ও শহুরে উভয় সমাজে। অথচ সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়ছে রাষ্ট্রকে অবসান ঘটাবে অস্পৃশ্যতার। ড. আম্বেদকারও অভিমত দিয়ে গেছেন- বর্ণপ্রথার অবসান না ঘটলে অস্পৃশ্যতারও অবসান ঘটবে না। অতএব অস্পৃশ্যতার অবসানবিষয়ক সংবিধানের অনুচ্ছেদ আজ পর্যন্ত ভারতে এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেনি।
তাই প্রশ্ন আসে- কেনো সংবিধান কথায়, কাজে ও চেতনায় বাস্তবায়ন হয়নি? আম্বেদকারের কথায় বলতে হয়, আগে বর্ণপ্রথার অবসান ঘটাতে হবে। সামাজিক আচরণে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তবেই অবসান ঘটবে অস্পৃশ্যতার ধারণার। ড. আম্বেদকার যা চেয়েছিলেন, নিম্নবর্ণের দলিতরাও তাই চেয়েছিল। কিন্তু উচ্চবর্ণের শাসক শ্রেণী তা হতে দেয়নি। এই উচ্চবর্ণের শ্রেণীটি আজো দলিতদের এই বলে বোকা বানাতে চায়, সংবিধান তো রচনা করে গেছেন আম্বেদকার। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনভাবেই সংবিধান রচনা করে গেছেন। কিন্তু সত্যটি হচ্ছে- তিনি এই সংবিধানের ব্যাপারে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না। শুধু ‘রাইট টু ইকুয়ালিটি’ ধরনের শব্দগুচ্ছে তিনি এই সংবিধান রচনা করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ‘সামাজিক সমতা’, যা আজো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। সংবিধানে সই সামাজিক সমতা সৃষ্টি করতে পারলে ভারতে বর্ণপ্রথার যেমন অবসান ঘটত, তেমনি অবসান ঘটত অস্পৃশ্যতার। সেই সূত্রে দূর হতো সামাজিক বিভাজন, শোষণ আর বৈষম্যের।
ভারতে আজো বর্ণপ্রথা বিলোপ না হলেও এই প্রথা বিলোপের উদ্যোগের ইতিহাস রয়েছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে উচ্চ ও নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনার প্রয়াস ছিল। এ ধরনের উদ্যোক্তার মধ্যে প্রথমেই নাম আসে বুদ্ধের। তিনি বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে বলে গেছেন শিক্ষার মাধ্যম হবে জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি নয়। তিনি ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব কমানোয় বিশ্বাসী ছিলেন। অশোক থেকে বৃহদ্রতা পর্যন্ত কেইউ ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শ অনুসরণ করতেন না। মৌর্য শাসকেরা গণশিক্ষা নীতির সূচনা করে। এসব পদক্ষেপ বর্ণপ্রথা বিলোপের অংশ হিসাবে নেয়া হয়। ড. আম্বেদকার বলেছেন, ‘মৌর্য আমলটা ছিল সেই আমল, যখন চতুর্বর্ণ পুরোপুরি বিলোপ করা হয়েছিল। তখন জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই ছিল শূদ্র। তারাই হয়েছিল দেশটির শাসক। তাদের পরাজয় ও অন্ধকারের যুগটায় চতুর্বর্ণ বিস্তার লাভ করে। মৌর্য শাসনের পর দেশটি বিভাজিত হয়ে যায়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, যখন শাসকেরা বর্ণপ্রথাবিরোধী হয়, তখন রাষ্ট্র হাতিয়ার হতে পারে বর্ণপ্রথাভিত্তিক সামাজিক হায়ারারকি বিলোপের। বুড্ডিস্ট রাষ্ট্রের পর ভারত সমাজ চলে যায় বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতাভিত্তিক শাসকদের হাতে।
সাত দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে এই সংবিধান বহাল। এ পরিস্থিতিতে বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশতার অবসানে এই রাষ্ট্রটি কি করতে পারে? বর্তমানে ভারত রাষ্ট্রটি উচ্চবর্ণের গভার্নিং ক্লাসে কবলে পতিত। মনে রাখতে হবে গভার্নিং ক্লাস আর রুলিং ক্লাস এক নয়। ভারতে রুলিং পিপল আসে বিভিন্ন বর্ণ থেকে। এর বিভিন্ন বর্ণগোষ্ঠীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে : উচ্চ ও নিম্নবর্ণ, এমনকি দলিতদের ও অস্পৃশ্যদের। কিন্তু রুলিং পিপল সবাই একই ধরনের শাসনাদর্শ অনুসরণ করে না। তবে সার্বিকভাবে এসব শাসক জনগোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যবাদী। ড. আম্বেদকার তার ‘হোয়াট গান্ধী অ্যান্ড কংগ্রেস হেভ ডান টু দ্য আনটাচেবলস’ বইয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই ‘গভার্নিং ক্লাসের’ কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে- ‘গভার্নিং ক্লস’ হচ্ছে সেই শ্রেণী, যারা মানুষের মনমানসিকতা ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে। এর মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে। তিনি বলেছেন, ব্রাহ্মণেরা হচ্ছে ভারতের গভার্নিং ক্লাস। এর পরই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বেনিয়ারা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- একটি রাষ্ট্র অথবা সরকার কি জনগণের মনমানসিকতা নিয়ন্ত্রণকারী ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি পাল্টে দিতে পারে? রাষ্ট্র অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি। যে পার্টিই ক্ষমতায় আসুক না কেনো, সেটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে পারে না। একটি রাষ্ট্র যদি কখনো রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে দখল করা হয়, যে শক্তিটি ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির বিরোধী, তবে সেই শক্তিটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে পারে। আজ পর্যন্ত ভারতে তেমনটি ঘটেনি। রাষ্ট্র চাইলে পরিবর্তন আনতে পারে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এবং এটিকে করে তুলতে পারে নন-ব্রাহ্মণিক। কিন্তু এটিও পুরোপুরি ভারতে ঘটেনি। শাসক দলগুলো উচ্চবর্ণের কর্তৃত্ব খর্ব করার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন হতে দেয়নি গভার্নিং ক্লাস। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হচ্ছে, ১৯৯০ সালে ভিপি সরকারের নেয়া একটি পদক্ষেপ। এটি পুরোপুরি পরিবর্তনের পদক্ষেপ ছিল না। সেখানে বলা হয়েছিল ব্যুরোক্রেসিতে ২৭ শতাংশ চাকরি সংরক্ষিত থাকবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর লোকদের জন্য। এর মাধ্যমে ব্যুরোক্রেসিকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু সে পদক্ষেপও ভেস্তে গেল প্রবল প্রতিবাদের মুখে।
তাই অবশেষ রইল একটিমাত্র আশা : ভারতে বর্ণপ্রথার অবসান ঘটবে শুধু তখনই যখন ভারতের ক্ষমতায় আসবে এমন কোনো পক্ষ, যারা শাসনাদর্শ হিসেবে হিন্দুত্ববাদকে অনুসরণ করবে না। বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থা বিরুদ্ধ দাঁড়াবে সাহস নিয়ে। রাষ্ট্রিক ও সামাজিকভাবে হায়ারারকিকে দেখবে ঘৃণার চোখে।