স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী - ছবি : অন্য এক দিগন্ত
দেখতে দেখতে আমাদের স্বাধীনতা, মানে স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হচ্ছে। পহাড়সম বাঁধা, চড়াই-উতরাই পেড়িয়ে আজকের বাংলাদেশ যেকোনো সময়ের চেয়ে পরিণত। এই পথচলা কখনোই মসলিন ছিল না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শুধু এই পঞ্চাশ বছর ছাড়া ভাটি বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ শাসন করেছে বহিরাগতরা। এ জনপদের জনগণ কখনোই নিজেদের শাসনভার পায়নি। ফলে শতাব্দীর পর শতব্দী বহুমাত্রিক বঞ্চনার শিকার হয়ে ভাগ্য বিড়ম্বিত হতে হয়েছে তাদের। সেই তারাই বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পায় মুক্তির স্বাদ।
সুলতানি, নবাবি আমল হয়ে বাংলায় শাসন কায়েম হয় ইংরেজদের। ব্রিটিশরা বাংলা দখলের পর এখানকার মানুষজন হয় চূড়ান্তভাবে বঞ্চিত। ইংরেজ ও বর্ণ হিন্দুদের যৌথ আগ্রাসনের শিকার হয় বাংলার মুসলিম সমাজ। ব্রিটিশ আমলে পরাধীন ভারতের পুরো সময়টাই বাংলার ভাটি অঞ্চল ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক নগর সভ্যতার কাঁচামাল সরবরাহের জোগানদাতা। সত্যি বলতে কী, শুধু মধ্যযুগে সুলতানরা বাংলা অঞ্চলের উন্নয়নে মনোযোগী ছিলেন। নবাবী আমলেও সে ধারা অব্যাহত ছিল। ভয়াবহ বঞ্চনার সূচনা ইংরেজ আমল থেকে। এর অন্যতম কারণÑ পূর্ব বাংলা দীর্ঘ দিন ধরেরই মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ। ইংরেজরা যেহেতু বাংলার নবাবদের কাছে থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়, যে কারণে অনিবার্যভাবেই ব্রিটিশদের রোষানলে পড়ে পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী। তাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। এর জন্য মুসলিম পরিচয়ই ছিল মুখ্য।
পৌনে দুই শ’ বছর শাসনের পর দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটতে থাকে। ভারতেও ইংরেজ শাসনের অবসান হয়। সাতচল্লিশে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয় ব্রিটিশরা। ঐতিহাসিক বাস্তবতায় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে অভ্যুদয় ঘটে দু’টি স্বাধীন দেশ ভারত ও পাকিস্তান। ইতিহাসে যা দেশ ভাগ হিসেবে উল্লিখিত। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বঞ্চনার অবসানে। বিভক্তি অনিবার্য হয়ে ওঠে বাংলার। পূর্ব বাংলা হয় পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু দেশ ভাগের অব্যবহতি পরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চেপে বসে বাঙালির ঘাড়ে। লিখিত হয় প্রায় ২৫ বছরের অনাকাঙ্ক্ষিত বঞ্চনার ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্তি পেতে অনিবার্য হয়ে ওঠে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম।
সাতচল্লিশ-পরবর্তী বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নের নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন এবং ছষট্টির ৬ দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়। সর্বশেষ একাত্তরের ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। মৃত্যু আর ধ্বংসের ভেতর দিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠল একটা ছোট্ট স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। অর্জিত হয় কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। আমাদের সেই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি। মানে সুবর্ণজয়ন্তী।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের চাওয়া-পাওয়া, সাফল্য-ব্যর্থতা তথা অর্জন নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। তবে সাথে সাথে আলোচনা করতে হবে যে পাকিস্তানের জন্য বাঙালি মুসলমান সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই তারাই কেন মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে স্বাধীন দেশের প্রয়োজন বোধ করল। কেন কবি ইকবাল আর মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ‘স্বপ্নের’ দেশ পাকিস্তান ভেঙে গেল? ভারতীয় উপ-মহাদেশের মুসলিমদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৪৭ সালে যে দেশ গঠিত হয়েছিল, মাত্র ২৫ বছরের মধ্যে সেটির মৃত্যু ঘটল কেন? অবশ্য বিষয়টি নিয়ে বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে বিস্তর গবেষণা-ব্যাখ্যা-বিতর্ক হয়েছে, এখনো অব্যাহত। এই প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে আগামীর সফল ও টেকসই বাংলাদেশ গঠার কাজে হাত দিতে হবে আমাদের।
সন্দেহ নেই, পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর যুক্তিতে সায় দিলেও পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা কখনই তাদের বাঙালি জাতিসত্তা এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আকাঙ্খা ত্যাগ করেনি। কিন্তু সেই আকাক্সক্ষা পূরণে এত দ্রুত কেন অস্থির হয়ে পড়ল বাঙালি? কেন পাকিস্তান সৃষ্টির দুই দশক না যেতেই বাঙালি জাতিসত্তা নিয়ে তাদের আবেগ, আকাঙ্খার বাঁধ ভেঙে পড়েছিল? এক কথায় উত্তর- বৈষম্য, শোষণ।
সাতচল্লিশে পাকিস্তান অর্জিত হলে প্রথমে পূর্ব বাংলার মানুষ চেয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরেই তাদের সার্বিক সমস্যার সমাধান। ১৯৪৮ সাল থেকে একাত্তরের মার্চ পর্যন্ত সেই কাঠামোর ভেতরে যাবতীয় বিশ্বাসঘাতকতা, জুলুম-নির্যাতন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির প্রয়াস চলেছে। কিন্তু এই সময়ের অভিজ্ঞতায় যখন দেখা গেল, তা সম্ভব নয়; তখনই স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। তদুপরি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবির জবাবে এবং আলোচনাকালে বিশ্বাসঘাতকতা করে একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তখনই ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। এ ছিল বাঁচার সংগ্রাম, অস্তিত্বের লড়াই। ছিল বৈষম্য, শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির লড়াই। ছিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম। ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। কাজেই এ যুদ্ধের পটভূমি, এ যুদ্ধের প্রকৃতি ও লক্ষ্যই বলে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা হচ্ছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তি, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের অবসান, মানুষের মর্যাদা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা, সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েম এবং জনগণের সমর্থিত সরকার তথা গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এ জন্যই জনগণ যুদ্ধ করেছিল। বস্তত ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গের মাধ্যমে গঠিত ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলার চূড়ান্ত পরিণতিই আজকের বাংলাদেশ। ধারাবাহিক সংগ্রাম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই একাত্তরে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতু দেশের পশ্চিমাংশে ঘাঁটি গাড়েন, শাসন ক্ষমতাও সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। সেই সাথে শুরু হয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে দেশের অন্য একটি অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য।
যেখানে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশে মাথাপিছু আয় ছিল সমান, ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় আগের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের অভাবে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু পশ্চিমে বেড়ে যায় কয়েক গুণ। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে, সেনাবাহিনীর উঁচু পদে বাঙালিদের নিয়োগ পাওয়া খুব কঠিন ছিল। সেই সাথে, বিনিয়োগে অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে হয়ে উঠেছিল পশ্চিমের কল-কারখানার কাঁচামালের জোগানদাতা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ক্রেতা।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল ‘ডেডলি এমব্রেস‘ বইতে লিখেছেন পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই ‘পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়’ এবং বাঙালিদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হিসেবে দেখা হতো। একসময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর বিশ্লেষক রিডেল তার বইতে লিখেছেন, ‘প্রথম থেকেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার ভরকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ পাঞ্জাব রাজ্যের হাতে চলে যায় এবং সেই একচ্ছত্র প্রাধান্য ধরে রাখার চেষ্টা পাকিস্তানের জন্য কাল হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানকে এক রকম উপনিবেশ হিসেবে দেখা শুরু হয়’। প্রায় ২৫ বছর সেই প্রভুসুলভ মনোভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে প্রতি মুহূর্তে। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে বাঙালির দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েছে। তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে।
কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক মোহাম্মদ নিয়াজ আসাদুল্লাহ ২০০৬ সালে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিমের চেয়ে বেশি হলেও সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দে বৈষম্য কতটা পাহাড় সমান ছিল। পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৫০-৫৫), কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ২০ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬৫-৭০) সেই বরাদ্দ বাড়লেও তা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ একাত্তরের মে মাসে একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল; তাতে বলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক যত বেড়েছে দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে, জীবনযাত্রার মানের তারতম্য বেড়েছে। সাতচল্লিশে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় তেমন কোনো তারতম্য না থাকলেও, অব্যাহত বৈষম্যের পরিণতিতে পরের ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মনে করেন, শাসক শ্রেণী অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং পাকিস্তানেও সেটাই হয়েছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভি, যিনি পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন, বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা এবং উন্নয়নে পিছিয়ে ছিল এ যুক্তি সবসময় এখানে এক পক্ষ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের জন্য যে ভাগাভাগি, সাম্য, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল তা কি ছিল? ছিল না’। বরঞ্চ পাকিস্তানের সামরিক এবং রাজনৈতিক শাসকরা উল্টো পথে হেঁটেছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে জবরদস্তি করে দূরে রাখার পাশাপাশি সরকারি চাকরি এবং সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব আটকানোর অব্যাহত চেষ্টা হয়েছে।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে রিজওয়ান উল্লাহ কোকাব একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে সরকারি উঁচু পদের নিয়োগে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। গবেষণাপত্রের উপসংহারে তিনি লিখেছেন, ‘সরকারি চাকরিতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং কম প্রতিনিধিত্ব- এই দুটো বিষয় বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতায় ইন্ধন দিয়েছে’।
ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী জেনিফার কোটস পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই নিয়ে গবেষনাধর্মী একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। ওই বইতে তিনি লেখেন, ‘বছরের পর বছর অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক-সংস্কৃতি নির্যাতন বাঙালিদের পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে মনস্তাত্বিকভাবে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করেছে এবং তাদের মধ্যে দিনে দিনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শক্ত হয়েছে’।
মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর উদযাপনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতার ঘোষণা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার বিপরীতে হাঁটছে শাসকশ্রেণী। পাঁচ দশকে তাদের ব্যর্থতা ও দেউলিয়াত্বে জনগণের মুক্তির আকাক্সক্ষা অনেকটাই প্রতারিত হয়েছে। পাকিস্তানি জমানার মতো এক দেশে দুই সমাজ, দুই অর্থনীতি কায়েম হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সীমিত হয়েছে। উন্নয়নের কথা বলে গণতন্ত্র ও সুশাসন একসঙ্গে দুর্বল থেকে দুর্বল হয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুরুতে আমাদের যেমন পেছনে তাকাতে হবে, কারণ, এই ৫০ বছরের ইতিহাসকে পেছনে রেখেই আমরা এ অবস্থানে এসেছি, তেমনি দৃষ্টিটা সামনেও মেলে রাখতে হবে, কারণ সুবর্ণজয়ন্তী একটা গন্তব্যমাত্র, যাত্রা শেষ নয়। যাত্রাটা ভবিষ্যতের দীর্ঘ পথে। সেই পথে চলার পাথেয় আমাদের কিছুটা হয়েছে বটে; কিন্তু তা দিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দেয়া কঠিন। কিভাবে পাথেয় আরো বাড়ানো যায়, যাত্রাটা সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য করা যায়, তার একটা হিসাব এখনই করতে হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা পটভূমি আছে, একটি দ্রুপদি ইতিহাস আছে। কিন্তু এই ইতিহাসকে অনেকে দলীয় কাচের নিচে ফেলে দেখেন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটা সম্পাদিত রূপ অনেকের কাছেই পছন্দনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা যখন ভেবেছি একটা উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছি, বাস্তবে অনেকের মনে সেই উপনিবেশ শেকড় গেড়ে বসেছে। ইতিহাস-সম্পাদনার কাজটা তাদের হাত ধরেই শুরু। জাতি হিসেবে আমাদের আত্মবিশ্বাসে যদি ঘাটতি থাকে, যদি মনটা অন্য কেউ দখলে নিয়ে নেয়, তাহলে ভবিষ্যতের পথচলা কঠিন হবে।
মনের উপনিবেশমুক্তি আমাদের অনেক দূর নিয়ে যেতে পারত, বহু হানাহানি, রক্তপাত, কলহ-বিবাদ থেকে রক্ষা করতে পারত। যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস থাকে, তাহলে রাজনীতির মাঠে অনেক দল থাকবে, তাদের চিন্তাভাবনায়, মত ও আদর্শে ভিন্নতা থাকবে। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেন অহেতুক বিতর্ক হবে, দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক কেন লজ্জা দেবে? ৫০ বছরে যথেষ্ট হয়েছে, এখন মুক্তিযোদ্ধাদের মতো দেশ ঘিরে কর্মোদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ জন্য নিজেদের গৌরবের ইতিহাসের সত্য ও কল্পনাকে আশ্রয় করে এগোতে হবে।
পেছন দৃষ্টিতে যে বিষয় আমাদের বিস্ময় জাগায়, তা হলো এত বিভক্তি, দলাদলি, হানাহানি, তিক্ততা আর বৈরিতার পরও দেশ এগিয়েছে। এটি খোলামনে স্বীকার করতে হবে। না হলে যারা এ উন্নয়নের প্রধান রূপকার, সেই গণমানুষ, তাদের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হবো। তারা রাজনীতির স্লোগান না দিয়ে, হানাহানির পঙ্কিলতায় পা না ফেলে কাজ করেছেন। পরিশ্রম করে যাচ্ছেন; কিন্তু প্রায়ই তাদের ন্যায্য মজুরি পান না, সেটি যায় নানা জনের পকেটে। কার্যসম্পাদনের প্রায় সব ক্ষেত্রে দুষ্টচক্র লুটেরাদের উদ্ভব হয়েছে। এই ব্যবস্থা থাকবে, বৈষম্য বাড়বে। বৈষম্য বাড়লে উন্নয়নের বিস্তার এক দিন একটা পাথুরে দেয়ালে গিয়ে ঠেকবে। বৈষম্য সৃষ্টির আরো অনেক পথ বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, পুঁজির শাসন, দুর্নীতি, স্বার্থান্বেষী এবং লুণ্ঠনকারীদের অবাধ শক্তি অর্জন, দুর্বল আইনের শাসন, রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা থেকে, মৌলিক অধিকার থেকে, অধিকাংশ মানুষের বঞ্চিত থাকা এগুলোর কয়েকটি মাত্র। এসবের নিষ্পত্তি না হলে নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নে যে ভারসাম্য প্রয়োজন, তা গড়ে উঠবে না।
আমাদের ৫০ বছরের ইতিহাসটা আশা-জাগানিয়া। অর্জনগুলোও চমৎকার। কিন্তু উন্নয়নের প্রদীপের নিচে যে অন্ধকার, যার একটি নাম বৈষম্য, সেদিকে নজর দেয়া আবশ্যক। অর্ধশতাব্দতে অর্থনীতি থেকে শিক্ষা, যোগাযোগ থেকে কৃষি, প্রায় সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রের বিস্তার বিস্ময়কর। শিক্ষায় বাজেটের যে জোগান দিই, তা অপ্রতুল, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম। তার পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি, নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, সবকিছুতেই বিস্তার প্রশংসনীয়। কিন্তু শুধু সংখ্যা দিয়ে সক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানো যাবে না। আমাদের ভাষাজ্ঞান সীমিত, গণিত ও বিজ্ঞানে অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়, উৎকর্ষ অর্জন তো দূরের কথা। যে শিক্ষা পেলে আমরা পরমুখাপেক্ষী হবো না, বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাবো, যে শিক্ষা পেতে একটা ব্রেকথ্রো জরুরি, সে জন্য কি প্রস্তুতি নিচ্ছি? সম্পদের জোগান দিচ্ছি? চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যখন গতি পাবে, আমরা কি তাতে অংশ নিতে পারব, নাকি ছিটকে পড়ে যাবো?
মান অর্জন শুধু নয়, মানের ঘরে সমৃদ্ধি ঘটানোও নিত্যদিনের চর্চায় নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য খোলামনে এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে দলাদলির রাজনীতি, চর দখল আর ক্ষমতার শাসন প্রাচীন পথ। এগুলোর নতুন সংস্করণ তৈরি হয়েছে, তরুণেরা তাতে বিনিয়োগ করছে, সেসব গ্রহণ করতে হবে। দেশ পরিচালনায় সত্যিকার অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি আর সুনীতি হচ্ছে বিকল্প। যেসব ব্যক্তি ও দলের মনজুড়ে আছে পুরনো উপনিবেশ, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা, তারা আমাদের ইতিহাসে, সংস্কৃতিতে, গণতন্ত্রে, স্বচ্ছতায়, সততায় আস্থা স্থাপন করলে অপশাসন যেমন অতীত হবে, নতুন চর্চার পথগুলো সুগম হবে।
এ নতুন চর্চার অর্থাৎ প্রাচীন পন্থার বিকল্পের মধ্যে আছে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, সেবাধর্মিতা, সম-অধিকারের চর্চা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নেতার পরিবর্তে সহযাত্রী, প্রশাসকের পরিবর্তে কার্য সমন্বয়কের ভূমিকা গ্রহণ। ইন্টারনেট তরুণদের এখন সারা বিশ্বের সাথে সংযুক্ত করেছে। তারা নতুন চর্চাগুলো সম্পর্কে বিশদ জানে। তাদের ভাবনা আমলে না নিলে বিপর্যয় অবধারিত, কারণ আগামীর পথ তারাই তৈরি করবে। যদি তাদের আকাঙ্খার বাস্তবায়ন হয়, তারা একাত্তরের কল্পনাকে বিবেচনায় নিয়ে গণতন্ত্রকে মানের বিচারে উন্নত করে দেশকে এগিয়ে নেবে। তখন নির্বাচন অবাধ হবে, দলগুলো মানুষের কাছে দায়বদ্ধ হবে, জাতীয় সংসদে তৃণমূলের রাজনীতিবিদেরা মানুষের পক্ষে আইন তৈরি করবেন।
কিন্তু প্রাচীন পন্থা আঁকড়ে বসে থাকলে, নতুনের দিকের জানালাগুলো সব বন্ধ রেখে দিলে অসহিষ্ণু রাজনীতির খোলস থেকে বেরোতে না পারলে, উপনিবেশী ও নানা উগ্র চিন্তায় মাথা বোঝাই করে রাখলে এগুলো অনর্জনীয় বিকল্পই থেকে যাবে। মনে রাখা আবশ্যক, আগামীর পথে বিশ্বের গতি মেনে চলতে সনাতন পন্থা কিছুদিনের মধ্যেই অকেজ হয়ে পড়বে। এ জন্য প্রাচীন পন্থার বিকল্প সন্ধানে তরুণদের দ্বারস্থ হতে হবে। যেহেতু বিকল্পটাও তারা জানেন।
আমাদের ৫০ বছরের ইতিহাসটা আশাজাগানিয়া। অর্জনগুলোও চমৎকার। কিন্তু এ উন্নয়নের প্রদীপের নিচে যে অন্ধকার, যার একটি নাম বৈষম্য, সেদিকে নজর দিতে হবে। এখন যদি উন্নয়ন সুষম করে একে আরো বেগবান করে মানের সমৃদ্ধি ঘটিয়ে এগিয়ে যেতে চাই, তবে বিকল্পের সমাবেশ ঘটাতে হবে। একবার কৃতসঙ্কল্প হয়ে পথে নামলে বিকল্পের জোগান দ্রুতই পাওয়া সম্ভব। এখন যারা প্রাচীনপন্থী, সীমাবদ্ধতাটা স্বীকার করে তরুণদের কথা বরং শুনতে হবে, দেখি নতুন গল্পগুলো তারা কত দ্রুত, কত সুন্দর আর ঝকঝকে বিন্যাসে লিখতে থাকেন।
উপরের আলোচনা এ জন্যই যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একাত্তরের ১৭ এপ্রিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। কিন্তু আজো ঘোষিত সেই বিষয়গুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। মনে রাখা দরকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো সার্বজনীন মূল্যবোধের ওপর একটি জাতি ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে হলে এসব বিষয় যেকোনো ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। নতুন করে বিশ্বাস ও আস্থাযোগ্য মনোভাব, ভাষা ও পদ্ধতিতে নেহায়েত সমন্বয়ধর্মী তাত্ত্বিক প্রস্তাব হিসাবে এসব বিষয়কে তুলে ধরতে হবে।
প্রয়োজনে এসবের তাৎপর্য বহন করে কিন্তু বিতর্ক এড়ানো যায় এমন শব্দ ব্যবহার করতে হবে। একটি ভৌগোলিক সীমারেখার ভেতরকার জনগোষ্ঠীকে একটি একক রাজনৈতিকতার মধ্যে আনতে হলে ক্ষুদ্রতম ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, নৃ-তাত্ত্বিক ও ভাষাগত গোষ্ঠীকেও সন্তোষজনকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে এমন বিষয়কে পরিচয় হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে। ইতিহাসের চলমান ঘটনার মধ্য থেকে কোনো বিশেষ ঘটনা ও বিষয়কে বিচ্ছিন্নভাবে তুলে এনে যুক্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে জাতীয় রাজনৈতিক পরিচয় নির্ণয়ের প্রস্তাব ও প্রচেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এরচেয়ে বড় কথা হলো, জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করে দেয়া যায় না। জাতীয় পরিচয় তথা জাতীয়তা নির্ধারণের মানে হলো, এমন ঐকমত্যের বিষয়গুলো যথাসম্ভব নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে আগে ভাষায় রূপদান করা। পরে তা রাষ্ট্রীয় কাঠামো যথাযথভাবে প্রতিস্থাপন করা। এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য এক পক্ষের ওপর দেবত্ব আরোপ এবং অপর পক্ষের ওপর দানবত্ব আরোপ করে কখনো টেকসই দেশ ও জাতি গঠন হতে পারে না। সুতরাং ঐকমত্যের বিষয়গুলো খুঁজে বের করে তা গ্রহণ করে নেয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। কৃত্রিম বিনয় ও কপট আন্তরিকতা দিয়ে কোনো জাতিগঠন সম্ভব নয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসব বিষয় আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। তবেই আগামীর পথচলা সহজ হবে।