এমবিএস কি পার পেয়ে গেলেন?
এমবিএস কি পার পেয়ে গেলেন? - ছবি সংগৃহীত
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের নতুন মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ওপর সিআইএ-এর তদন্ত প্রতিবেদন, যা আগের ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ করতে বাধা দিয়েছিল, তা প্রকাশিত হয়। পরের দিন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক অ্যাভ্রিল হেইন্স সংবাদ মাধ্যমে চার পাতার এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এর আগে জানা গিয়েছিল, সিআইএ-এর এক দল সদস্য, যারা একাধিক তথ্যসূত্র অভ্যন্তরীণভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন, তারা শেষ র্পযন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মেদ বিন সালমান বিন আব্দুলাজিজ আল-সৌদ ওরফে এমবিএস খাশোগি হত্যার নির্দেশ দেন। তদন্ত প্রতিবেদনেও খাশোগি হত্যার জন্য বিন সালমানকেই অভিযুক্ত করা হয়। অবশ্য অল্প কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিবেদনটির প্রকাশ করা হয়, যাতে তিনজনের নাম অপসারণ করা হয়েছিল। এই প্রতিবেদনের ফলে মার্কিন সরকার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক সৌদি নাগরিকের ওপর অবরোধ আরোপ করে। তবে বিন সালমান এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েননি। এতে করে অনেকে আশঙ্কা করছেন, খাশোগি হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা বিন সালমান হয়ত কোনো ধরনের শাস্তি ছাড়াই অব্যহতি পেয়ে যাচ্ছেন। আর তা যদি সত্যি হয়, তবে ন্যায় বিচারের আশা সুদূর পরাহত।
জামাল আহমাদ খাশোগি জন্মগ্রহণ করেন সৌদি খাশোগি পরিবারে, যা দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত পরিবারগুলোর একটি। খাশোজির দাদা মোহামেদ খালেদ খাশোগির জন্ম তুরস্কের কায়সেরিতে, মেহমেদ হালিদ কাশিকচি নামে। তিনি ছিলেন প্রথম সৌদি রাজা ইবনে সৌদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। খাশোগি পরিবারের অনেকেই সৌদি আরবের সবচেয়ে সম্পদশালী ও সাংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে গণ্য হন। চাচা অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগি সৌদি আরবের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। ফুপাত ভাই দোদি ফায়েদ প্রিন্সেস ডায়ানার প্রেমিক হিসেবে বিশ্বব্যপী পরিচিতি লাভ করেন, পরে গাড়ি দুর্ঘটনায় একই সাথে মৃত্যুবরণও করেন। আশির দশকের মাঝামাঝি খাশোগি সাংবিদকতা পেশায় যোগ দেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভ্রমণ করেন।
আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ প্রতিরোধে যুদ্ধরত মুজাহিদিন নেতা ওসামা বিন লাদেনের একাধিকবার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তিনি। ধারণা করা হয়, এ সময় তিনি সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি সিআইএ-এর হয়েও কাজ করছিলেন। বিন লাদেনের সাথে তার এই ঘনিষ্ঠতা পরে বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এমনকি ২০১১ সালে বিন লাদেন মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত হলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে শোকাপ্লুত হন এবং বিন লাদেনের উগ্র পন্থায় দীক্ষিত হওয়ার ব্যাপারে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। খাশোগি ব্যক্তিগতভাবে ওয়াহাবি মতবাদ-সালাফি আন্দোলনের উগ্রতার বিপক্ষে উচ্চকন্ঠ ছিলেন। তবে তিনি নিজে বৈশ্বিক ইসলামি রাজনীতির দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য ছিলেন, এমন দাবিও মেনে নিয়েছেন প্রায় সবাই। যদিও তিনি রাজনীতিতে কখনোই সক্রিয় হননি; দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কর্মকাণ্ডেও অংশ নেননি।
বিশ্লেষকরা বলেন, খাশোগি ছিলেন মুসলিম গণতন্ত্র বা ইসলামী গণতন্ত্রের ধারণায় বিশ্বাসী। সৌদি আরবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অধিকারের জন্য তিনি আমৃত্যু আপ্রাণ চেষ্টা চালান। সাংবাদিক জীবনের শেষ দুই দশকে সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সময় তিনি তার সংবাদপত্রে বিভিন্ন প্রগতিশীল মতামত তুলে ধরতে সাহায্য করেন। তিনি ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বে হাউছিবিরোধী অভিযান, কাতারের উপর সৌদি-আরোপিত অবরোধ, সেনাভ্যুত্থানে মিসরের বৈধ সরকার উৎখাত, পশ্চিম তীরে ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপন এবং বিশেষত সৌদি নারীবাদী মানবাধিকার কর্মীদের ওপর ধরপাকড়ের প্রবল সমালোচনা করেন। আর এর পিছনে সদ্য অভিষিক্ত যুবরাজ বিন সালমানকে দায়ী করে তারও কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি ইরানের শিয়াপন্থী সম্প্রসারণবাদেরও নিন্দা জানান এবং যুক্তি দেখান যে ইরানকে ঠেকাতে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে গাঁটছাড়া বাধা ছাড়া সৌদি আরবের আর কোন বিকল্প নেই। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি সৌদি আরব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। তার দাবি ছিল, মার্কিন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করায় সৌদি সরকার তার সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি বা উপস্থিত হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পরে তারা তার টুইটারও বন্ধ করে দিয়েছে। এমন কি পরবর্তীতে তার সহযোগী কানাডায় অবস্থানরত ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মী ওমার আব্দেলাজিজের মুঠোফোনে স্পাইওয়ারের মাধ্যমে তার নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও দাবি খাশোগি করেন।
২০১৭ সাল জুড়ে সৌদি সরকার খাশোগিকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যায়। রাজসভার উপদেষ্টা পদে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় তাকে। কিন্তু খাশোগির আশঙ্কা ছিল, একবার দেশে ফিরলে তাকে আর দেশ ছাড়তে দেয়া হবে না। বরং তার পরিণতি হতে পারে জেলখানা কিংবা তার চেয়েও খারাপ। জানা যায়, এরই ফলে খাশোগি মার্কিন নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন। অন্য দিকে প্রাক্তন স্ত্রী হানান এল-আতরের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন করে খাশোগি তার তুর্কি বাগদত্তা হাতিচে চেঙ্গিজকে বিয়ে করার উদ্যোগ নেন।
বিবাহবিচ্ছেদ বিষয়ক সরকারি কাগজপত্র পাবার জন্য তিনি সৌদি দূতাবাসে যোগাযোগ করলে তারা তাকে তুরস্কের দূতাবাস যোগাযোগ করার পরামর্শ দেয়। ইস্তাম্বুলের তুর্কি দূতাবাসে ধর্ণা দেয়ার পরে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করা হয় এবং পরে আরেকবার আসতে বলা হয়। এতে সন্তুষ্ট হলেও খাশোগি চেঙ্গিজ ও অন্যদের কাছে তার নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। তার ভয় ছিল, গোপনে সৌদি আরবে নেয়ার উদ্দেশ্যে তাকে অপহরণ করা হতে পারে। তিনি চেঙ্গিজকে বলেন, তিনি নিখোঁজ হলে সাথে সাথে যেন তুর্কি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। ২০১৮ সালের ২ অক্টেবর দুপুর একটার দিকে তিনি চেঙ্গিজকে নিয়ে সৌদি দূতাবাসে পৌঁছান। চেঙ্গিজকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে তিনি ভিতরে ঢোকেন। সাড়ে তিনটায় দূতাবাসের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পরও খাশোগি বের হন না। চেঙ্গিজ চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর অবশেষে তুর্কি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। তুর্কি সরকার তদন্ত শুরু করলে একে একে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর সব তথ্য।
উধাও হওয়ার পরের কয়েক দিন খাশোগির ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছে তা সঠিকভাবে নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। সৌদি দূতাবাস থেকে বলা হয়, খাশোগি স্বেচ্ছায় পিছনের দরজা দিয়ে দূতাবাস ত্যাগ করেন। কিন্তু দূতাবাসের বাইরের সিসিটিভির রেকর্ডিংয়ে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরে দেখা যায়, ওই দিন দূতাবাসের ভেতরের সিসিটিভির রেকর্ডিং মুছে ফেলা হয়েছিল। একই দিন দূতাবাসের স্থানীয় কর্মচারীদের হঠাৎ করে ছুটি দিয়ে দেয়া হয়।
তুর্কি কর্মকর্তা প্রথমে দাবি করেন, খাশোগি দূতাবাসের ভিতরেই আছেন। কিন্তু ক্রমে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে খাশোগিকে দূতাবাসের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে। তদন্তকারী তুর্কি পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই কাজে অংশ নেয় ১৫ জনের এক আততায়ী বাহিনী। ১ অক্টোবর সাড়ে চারটায় তিনজন সৌদির একটি দল ইস্তাম্বুলে এসে হোটেলে ওঠে এবং পরে সৌদি দূতাবাসে যায়। পরে হত্যা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দূতাবাস থেকে এক দল কর্মকর্তা ইস্তাম্বুল কাছের জঙ্গল এবং নিকটবর্তী শহর ইয়ালোভা পরিদর্শন করে। ২ অক্টোবর আততায়ীদের মূল দলটি রিয়াদ থেকে দু’টি ব্যক্তিগত বিমানে করে ইস্তাম্বুল আসে। একই দিন খাশোগি দূতাবাসে আসার এক ঘন্টা আগে তারা দূতাবাসে প্রবেশ করে। পরে তারা তাকে নির্যাতন করে হত্যা করে।
একটি অজ্ঞাত সূত্রে দাবি করা হয়, খাশোগির লাশ টুকরা টুকরা করে কেটে গোপনে দূতাবাসের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই সমস্ত ঘটনা ভিডিওতে রেকর্ড করা হয়ে এবং সেই রেকর্ডটেপও দেশের বাইরে চলে গেছে।
‘মিডল ইস্ট আই’ দাবি করে, হত্যা সংঘটিত হওয়ার আরেকটি সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে আততায়ীরা খাশোগির আঙুল কেটে নিয়ে মোহাম্মেদ বিন সালমানকে দেখান ।
অন্য দিকে সিএনএন জানায়, খাশোগি ‘জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভুলবসত মারা গেছেন’, সৌদি সরকার এমন দাবি করতে যাচ্ছে।
‘মিডল ইস্ট আই’ জানায়, হত্যাকাণ্ড শেষ হতে সময় লাগে সাত মিনিট। সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সালাহ মুহাম্মদ আল-তুবাইজি হাড় কাটা করাত দিয়ে খাশোগিকে কেটে টুকরো টুকরো করেন। এ সময় খাশোগি জীবিত ছিলেন।
ডেইলি সাবাহ খবর দেয়, দূতাবাসের আসপাশের প্রতিবেশীরা সেদিন প্রথমবারের মতো দূতাবাসের বাগানে বার্বিকিউ পার্টি হতে দেখেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত লাশ পোড়ানোর গন্ধ ঢাকতে ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লেখে, শীর্ষ সৌদি কূটনীতিবিদ প্রধান রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আল-ওতাইবির সামনেই খাশোগিকে নির্যাতন করা হয়। পরে তুর্কি গোয়েন্দারা আল-ওতাইবির ঘর তল্লাশি করার কয়েক ঘন্টা আগেই তিনি ইস্তাম্বুল ত্যাগ করে রিয়াদের চলে যান।
শেষ পর্যন্ত সৌদিরা খাশোগির মৃত্যু নিশ্চিত করে। তবে তাদের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হয়, খাশোগি গ্রেফতারের সময় ধস্তাধস্তিতে মারা গেছেন। এক অজ্ঞাতনামা সৌদি কর্মকর্তা জানান, সৌদি কর্মকর্তা মাহের মুতারেব খাশোগিকে ওষুধ দিয়ে বেহুঁশ করে অপহরণ করার চেষ্টা করলে খাশোগি তাতে বাধা দেন। এ সময় তাকে কাবু করতে পিছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরা হলে তাতে তার মৃত্যু হয়।
এক তুর্কি গোয়েন্দা সূত্র এবং সৌদি রাজসভা সদস্য ও গোয়েন্দা সংস্থার সাতে সংশ্লিষ্ট এক উচ্চপদস্থ আরবের বরাত দিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিন সালমানের প্রধান সহকারী সৌদ আল-কাহতানি বন্দী খাশোজ্জির সাথে স্কাইপের মাধ্যমে কথা বলেন। আল-কাহতানি খাশোগিকে অপমানসূচক কথা বললে খাশোগি আল-কাহতানির সাথে ভদ্রতা বজায় রাখেন। একপর্যায়ে আল-কাহতানি খাশোগিকে হত্যার নির্দেশ দেন।
শেষ পর্যন্ত তুর্কি সরকার তাদের তদন্তে উঠে আসা তথ্য উপস্থাপন করে। হত্যাকাণ্ডের অডিও ও ভিডিও প্রমাণ তাদের কাছে আছে বলে তুর্কিরা দাবি করে। তাদের ভাষ্য মতে, খাশোগি দূতাবাসের ঢোকার পর সৌদি আততায়ীরা তাকে আটক করার চেষ্টা করে। এ সময় তার মুখের উপর প্লাস্টিকের ব্যাগ চাপানো হয়। অডিও-তে শোনা যায়, খাশোগি বলছেন তিনি ক্লস্ট্রোফোবিক, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে । এটাই তার শেষ কথা। এ সময় তার গলায় রশি বেঁধে শ্বাসরুদ্ধও করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় ।
খাশোগির লাশের সন্ধানে তুর্কি গোয়েন্দারা অনুসন্ধানকাজ বিস্তৃত করেন। সৌদি কর্মকর্তাদের গতিবিধি অনুযায়ী বেলগ্রাদ জঙ্গল বা ইয়ালোভা প্রদেশের এক খামারে লাশ ফেলানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতের বাসা থেকে খাশোগির ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়।
হুরিয়েৎ তার এক কলামে দাবি করে, তুর্কি কর্তৃপক্ষের হাতে দ্বিতীয় একটি অডিওসহ আরো তথ্যপ্রমাণ আছে। এতে দেখা যাচ্ছে, সৌদিরা খাশোগিকে কিভাবে মারা যায়, তার পরিকল্পনা করছে।
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরে পুলিশের চোখে ধোঁকা দেয়ার জন্য আততায়ীদের একজন মুস্তাফা আল-মাদানি খাশোগির পোশাক, নকল দাড়ি, চশমা, ঘড়ি পরে দূতাবাসের পিছনের দরজা থেকে বেরিয়ে যান। আল-মাদানি বয়স, উচ্চতা ও স্বাস্থ্যে খাশোগির অনুরূপ হওয়ায় তিনি এই ছদ্মবেশ ধরতে সমর্থ হয়। ছদ্মবেশধারী আল-মাদানি ইস্তাম্বুলের নীল মসজিদে যান। সেখানে এক গণশৌচাগারে গিয়ে তিনি ছদ্মবেশ ত্যাগ করে স্বাভাবিক পোশাকে বেরিয়ে আসেন।
খাশোগি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, এ তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর পরই প্রশ্ন ওঠে- এই হত্যাকাণ্ড কি পূর্বপরিকল্পিত? এর মূল হোতাই বা কে? আততায়ীদের সৌদি আরব থেকে তুরস্কে নিয়ে আসা এবং খাশোগিকে জীবিত রাখার কোনো চেষ্টা না করায় মনে করা হচ্ছে, এটি পূর্বপরিকল্পিত । পাশাপাশি নকল খাশোগির ব্যবস্থা করে পুলিশকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টাকেও তুর্কি কর্মকর্তা তাদের সন্দেহের পক্ষে জোর প্রমাণ হিসেবে দাবি করেন।
হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে প্রথমেই সবার মুখে বিন সালমানের নাম আসে। আল-ওয়াক্ত বলেছে, সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা উপপ্রধান ও ইয়েমেন অভিযানের আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র আহমাদ আসিরিকে এই পরিকল্পনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী আততায়ী দলের পনেরজনের সাতজনই যুবরাজের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী সদস্য। এমনকি হত্যাকারীরা যে ব্যক্তিগত বিমানে ভ্রমণ করেছিলেন, ওই ‘স্কাই প্রাইম এভিয়েশন’-ও রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আসার পর থেকে যুবরাজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সব কিছু ফাঁস হওয়ার পর সৌদি আরব দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। প্রথমেই আল-কাহতানি ও আসিরিকে পদচ্যুত করা হয়। পরে এগারো জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে পাঁচজন মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিত হয়। বাকি তিনজন ২৪ বছরের কারাদণ্ড লাভ করে। তবে আল-কাহতানি, আসিরি ও আল-ওতাইবি বিনা অভিযোগে মুক্তি লাভ করেন। অবশ্য বিন সালমানকে কোনো ধরনের বিচারের আওতায় আনা হয়নি।
খাশোগি হত্যাকাণ্ড বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করায় আন্তর্জাতিক মহল এর সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের ব্যাপারটি নিয়ে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। বিশেষত জাতিসঙ্ঘ, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র তদন্তে নানা ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে। কিন্তু সৌদি আরব অভ্যন্তরীণভাবে মামলার বিচারকাজ চালিয়ে যে রায় দেয় তা কারোরই মনোপূত হয়নি। বিশেষত বিন সালমানকে সম্পূর্ণ রেহাই দেয়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেছেন না কেউ। চেঙ্গিজ নিজে ও খাশোগির ছেলেরাসহ তুরস্ক রায়ের ব্যাপারে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। অন্য দিকে বিন সালমানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন দাবার ঘুঁটি জো বাইডেনের ঘরে। তিনি মুখে মুখে সৌদিদের বিপক্ষে অনেক কথা বললেও কাজে এখনও তেমন কোনো কিছু করেননি। তাই খাশোগি হত্যার বিচার আসলেই পূর্ণতা পাবে কি না তা এখনো অনিশ্চিত।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র দেশটির হর্তাকর্তার হাতে পরিকল্পিত হত্যার মতো এমন জঘন্য একটি অপরাধ ঘটেছে কি না তা নিয়ে তেমন প্রশ্ন নেই। কিন্তু মহাশক্তিধর এমবিএস বিচারের মুখোমুখি হবেন কিনা– সেটা নিয়েই জনমনে যত জল্পনাকল্পনা। আর তার অবসানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আরো কিছু দিন।