মিয়ানমারের কারেন জাতি ও তাদের সংগ্রাম
মিয়ানমারের কারেন জাতি ও তাদের সংগ্রাম - ছবি : সংগৃহীত
'কারেন' দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠী বিশেষ। এরা সিনো-তিব্বতীয় ভাষা-পরিবারের কারেন ভাষা-গোত্রের অন্তর্গত নানা ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাভাষীর মানবগোষ্ঠী মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে থাইল্যাণ্ডের সীমান্ত বরাবর বসবাস করে। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড মিলে এই জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ। দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মিয়ানমারের মূল নরগোষ্ঠ বার্মিজদের সাথে সংগ্রাম করেছে। বর্তমানে তারা মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের উপজাতি (tribe) হিসেবেই পরিচিত। বর্তমানে কারেনদের বেশির ভাগই বসবাস করে মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্তের পার্বত্য এলাকায় এবং মিয়ানমারের ইরাবতী নদীসৃষ্ট ব-দ্বীপ এলাকায় ও থাইল্যান্ডে।
কারেন জাতি সত্তা
জাতিগত সত্তার বিচারে, কারেন গোত্রের ভাষার ভাষাভাষাভাষীর লোককে বোঝায়। তারা মিয়ানমারের রেঙ্গুন বিভাগ, বাগো বিভাগ, মান্দালয় বিভাগ, টানিন্থারয়ি, আয়ারওয়াড্ডি, পূর্ব কারেন প্রদেশ, কায়াহ রাজ্য ও থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই প্রদেশে বসবাস করে।
দৈহিক গড়নের বিচারে তারা মঙ্গোলীয়। পিকিং মানবের উত্তরসূরীরার খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের দিকে হিমালয়য়ের পূর্ব-শাখার উভয় উভয় দিকে এই মানবগোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়েছিল। এরই একটি শাখা মিয়ানমারের অরণ্য সঙ্কুল পার্বত্য এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল।
কারেন নৃগোষ্ঠীর নানা রকমের গোত্রে বিভাজিত। এই গোত্রগুলো হলো- কায়-আহ, গেকো, গেবা, পাডায়ুং, ব্রেস, মানু-মানুস, ইনটালে, ইনবাও, পাকু, শান এবং পাও। এছাড়া গেকো, গেবার এবং পাডায়ুং মতো বড় গোত্রও বেশ কিছু উপগোত্র আছে। এর ভিতর 'পাডায়ুং' গোত্রের নারীরা গলায় পিতলের বলয় ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে সারা বিশ্বে পরিচিত।
কারেন জাতির ইতিহাস ও কারেন বিদ্রোহ
কারেন লোককাহিনী মতে, এদের পূর্বপুরুষরা গোবি মরুঅঞ্চলে বসবাস করত। সেখান থেকে অনেক আগে এরা মিয়ানমারের এসে বসবাস শুরু করে। এরা মূলত মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্ত বরাবর পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করত। গোড়ার দিকে এরা শিকার এবং বন্য ফলমুল খেয়ে জীবন ধারণ করতো। পরে এরা চাষাবাদ ও পশুপালনের মতো কাজে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের মায়ানমারে আসার পর এদের একটি অংশ খ্রিস্ট-ধর্ম গ্রহণ করে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠে।
১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই সব খ্রিস্টান কারেনরা কারেন ন্যাশনাল এসোসিয়েশন্স (কেএনএ) নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান মিয়ানমার দখল করে নেয়। এই সময় কারেনরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল। এই কারণে তারা জাপানিদের আক্রমণের শিকার হয়। এই সময় কারেন ও বার্মাজদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে। ফলে জাপানিদের পাশাপাশি বার্মার স্বাধীনতাকামী দল বার্মা ইন্ডিপেডেন্স আর্মি (বিআইএ) বহু কারেনকে হত্যা করে এবং তাদের বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় প্রাকযুদ্ধ ক্যাবিনেট মন্ত্রী স পে থা (Saw Pe Tha) ও তার পরিবার এই আক্রমণের শিকার হয়। এরপর জাপনি সমরনায়ক কর্নেল সুজুকি কেইজি ও কারেন নেতা সাও থা ডিন-এর মধ্যে এই অত্যাচর বন্ধের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
যুদ্ধের শেষে কারেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠনের জন্য, কারেন নেতারা উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৪৬ সালের আগষ্ট মাসে কারেন নেতা সাও থা ডিন এবং সাও বা উ গাই লণ্ডনে যান। কিন্তু ব্রিটিশরা কারেনদের দাবি অগ্রাহ্য করে। তবে বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটিশরা কারেনদের বিষয়ে বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের শেষে যখন ব্রিটিশরা বার্মা ছেড়ে চলে যায়, তখন ব্রিটিশরা কারেনদের পক্ষে কিছু করে যায়নি।
১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে বার্মার স্বাধীনতার বিষয়ে লন্ডনে সভা হয়। পরবর্তী সময়ে প্যাংলোং-এ যখন বার্মা সরকার প্রধান হিসাবে অং সান এবং শান, কচিন ও চিন প্রদেশের নেতাদের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন কারেনদের অধিকারের দাবিকে প্রায় অগ্রাহ্য করা হয়। এই সময় কারেন নেতারা শুধু পর্যবেক্ষক হিসাবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) প্রতিষ্ঠত হয়। এই সময় কারেন ব্যাপ্টিষ্ট ও বৌদ্ধ সংগঠন, কারেন কেন্দ্রীয় সংগঠন কারেন সেন্ট্রাল অরগ্যানাইজেশন (কেসিও), কারেন যুব সংগঠন (কারেন ইয়ুথ অরগ্যানাইজেশন- কেওয়াইও) থেকে প্রায় ৭০০ প্রতিনিধি নিয়ে কারেন কংগ্রেসের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা হয়েছিল রেঙ্গুনের ভিন্টোন মেমোরিয়াল হলে। এই সভা আহুত হয়েছিল মূলত একটি পৃথক কারেন রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য। এর সাথে অন্যান্য বিষয় ছিল— বার্মা জাতীয় সংসদে কারেনদের আসন সংখ্যা ২৫ ভাগ বৃদ্ধি করা, নতুন করে ভাষাগত জাতীয়তাভিত্তিক লোক গণনা এবং বার্মা সেনাবাহিনীতে নিয়মিতভাবে কারেন গোষ্ঠী লোক অন্তর্ভুক্ত করা। এই সকল দাবি-দাওয়া ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করলে, ব্রিটিশ সরকার তিন মাস কোনোই উত্তর দেয়নি।
এরপর কেএনইউর প্রেসিডেন্ট সাও বা য়ু গভর্নর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৪৭ সালে বার্মা আইনসভার নির্বাচনে অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লিগ (এএফপিএল) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই সময় এই দলের সামরিক নেতা অং সান মিয়ানমারের অস্থায়ী সরকারের প্রধান ছিলেন। এই দলের মাধ্যমেই তিনি মিয়ানমারের পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দেন। ১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই বার্মার স্বাধীনতা-চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র ছয় মাস আগে আততায়ীর গুলিতে অং সান ও তার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীসহ নিহত হন। এরপর এই দলের নেতৃত্বে আসেন য়ু নু । এই বছরের জুলাই মাসেই তৈরি হয়েছিল কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স অর্গ্যানাইজেশন (কেএনডিও)।
১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে বার্মার স্বাধীনতাবিষয়ক একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তিতে য়ু নু-এর সাথে ব্রিটিশ প্রধনমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটেল স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিটি নু-এ্যাটেল চুক্তি নামে পরিচিত।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মাসে বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করে, য়ু নু বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু এই বছরের শেষের দিকে বার্মার সেনাবাহিনীর ভিতর বিভাজন শুরু হয়। এই সময় প্রধান দুই সেনানায়ক নে উইন ও বো যেয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। প্রধানমন্ত্রী য়ু নু- বার্মার সেনাবাহিনীর সেকেন্ড-ইন কমান্ডের দায়িত্ব অর্পণ করেন নে উইন-কে।
এরপর বার্মা সেনাবাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪৯ সালের ৩১ জানুয়ারি তারিখে, নে উইননের নেতৃত্বে Sitwundan (Socialist militia battalions) নামে একটি সেনাদল গঠিত হয়। এরপর সশস্ত্র বাহিনীর (Tatmadaw) চিফ অফ স্টাফ-এর দায়িত্বরত কারেন সেনাপতি জেনারেল স্মিথ ডুন (General Smith Dun)-কে অপসারণ ও বন্দী করা হয়। নতুন চিফ অফ স্টাফ-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন নে উইন। এ সময় কারেন সৈন্য ও সাধারণ মানুষদের ওপর বার্মিজ সেনারা বিমাতাসূলভ আচরণ শুরু করে। ফলে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে গঠিত কারেনদের প্রতিরক্ষামূলক সংগঠন KNDO উজ্জীবিত হয়ে উঠে। কারেন রাইফেল, মিলিটারি পুলিশ ইউনিয়ন এবং KNDO সম্মিলিতভাবে বার্মার কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে এই সম্মিলিত বাহিনী দ্রুত রেঙ্গুনের নয় মাইলের ভিতরে চলে আসে। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের শেষ নাগাদ ১১২ দিন তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে রাখতে সক্ষম হয়। পরে এই বাহিনী এই অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়। এরপর সামরিক রসদ ও খাদ্য সরবরাহ না থাকায়, তারা দক্ষিণ-পূর্ব বার্মায় সরে আসে।
এরপর রেঙ্গুনের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ২০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। বর্তমানে এদের এই সম্মিলিত বাহিনীটি Karen National Liberation Army (KNLA) নামে পরিচিত। ১৯৮০ সালেরর দিকে এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২০,০০০। কিন্তু বার্মা বাহিনীর ধারাবাহিক আক্রমণে এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৪,০০০-এ। এই সময়ের ভিতর বার্মা সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৪ লাখ।
১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে KNLA-এর বৌদ্ধ সৈনিকরা আলাদা হয়ে যায়। এদের এই নতুন দলটির নামকরণ করা হয় Democratic Karen Buddhist Army (DKBA)। এরপর এরা বার্মা সেনা-শাসিত সরকারের সাথে যুদ্ধ-বিরতী চুক্তি করে। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে, বার্মা সেনাবাহিনী DKBA -এর সহায়তায় KNLA-এর শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত ম্যানের্প্লাউ (কারেন রাজ্যের সদর দফতর) দখল করে নেয়। এই শহরে ছিল কারেন জাতীয় সংগঠন KNU-এর কেন্দ্রীয় অফিস। ম্যানের্প্লাউ-এর পতনের পর, KNU-এর সদর দফতর বার্মা-থাইল্যান্ডের সীমান্তে অবস্থিত মু আয়ে পু (Mu Aye Pu) -তে সরিয়ে নেয়া হয়। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের বিবিসি-র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই সংঘতের ফলে প্রায় ২ লক্ষ কারেন গৃহচ্যুত হয়েছে। এর ভিতর থাইল্যান্ডের লা টাক প্রদেশে বার্মার কারেন উদ্বাস্তু বসবাস করে।
২০১০ সাল পর্যন্ত বার্মিজ সেনাবাহিনী বিভিন্ন কারেন গ্রামে হানা দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, গৃহদাহ ইত্যাদির মাধ্যমে কারেনদের নিশ্চিহ্ন করার কাজ চালয়ে যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, গুগল, ইউটিউব