যেভাবে চলছে ইন্দোনেশিয়ার ‘মুহাম্মাদিয়া’
যেভাবে চলছে ইন্দোনেশিয়ার ‘মুহাম্মাদিয়া’ - ছবি সংগৃহীত
‘মুহাম্মাদিয়া’ ইন্দোনেশিয়াভিত্তিক একটি বেসরকারি ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন। এটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে মুহাম্মদ সা:-এর অনুসারী। ইন্দোনেশিয়ার তৎকালীন শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় কার্যক্রমের গভীরে প্রোথিত বিভিন্ন শিরক, বিদয়াত ও কুসংস্কার থেকে মুসলমানদেরকে উদ্ধার করে কুরআন-সুন্নাহর নিখুঁত অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সঠিক ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক জ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে অসংখ্য প্রাইমারি ও মিডিয়াম স্কুল এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ‘মুহাম্মাদিয়া’ ইন্দোনেশিয়াব্যাপী এক সফল ও সর্বজনীন শিক্ষাবিপ্লব সাধনে সক্ষম হয়েছে। স্বাস্থ্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে অসংখ্য চ্যারিটিমূলক ক্লিনিক ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক অসহায় মানুষকে ফ্রি স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এনে তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করেছে। এ সব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে ও অনুসারীদের সংখ্যার বিচারে ইন্দোনেশিয়ার এ ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনটি ‘নাহদাতুল উলামা’র পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইন্দোনেশিয়া ছিল ডাচ কলোনির অন্তর্ভুক্ত। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর যাবত ওলন্দাজ বা ডাচরা ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের ওপর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে জুলুম অব্যাহত রাখে। এ সময় সরকারের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে মিশনারিরা মুসলিম জনসাধারণকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ অপতৎপরতা রুখে দেয়ার পাশাপাশি মুসলিম জনসাধারণের ঈমান-আকিদা রক্ষার উদ্দেশ্যে মধ্য জাভায় অবস্থিত ণড়মুধশধৎঃধ নামক স্থানে ‘আহমাদ দাহলান’ নামক একজন আল্লাহভীরু আলেম ১৩৩০ হিজরির ৮ জিলহাজ মোতাবেক ১৯১২ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষা-সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন ‘মুহাম্মাদিয়া’। এ বিষয়ে প্রফেসর ড. এম এ মান্নান বলেন, ‘১৯১২ সালে হাজী দাহলান এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দীর্ঘ দিন মক্কায় ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি দেখেন, খ্রিষ্টান মিশনারিরা বহু মুসলমানকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছে। এটা দেখে তিনি ব্যথিত হন এবং আমাদের নবী মুহাম্মদ সা:-এর নামে ‘মুহাম্মাদিয়া’ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।’ (নয়া দিগন্ত, ৪ অক্টোবর ২০১৯)
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে- সাধারণ মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে আহমাদ দাহলান নিজের বাড়িতেই ‘ইবতিদায়িয়্যাহ দ্বীনীয়্যাহ ইসলামিয়্যাহ’ নামক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে কুরআনের পাঠদান শুরু করেন। একপর্যায়ে সূরা মাউনের দরসটির পুনরাবৃত্তি করছিলেন। জনৈক ছাত্র তাকে পুনরাবৃত্তির কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি তার কাছে ওই সূরার শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ নিজেদের জীবনে কতটুকু বাস্তবায়িত করেছে- জানতে চান। উত্তরে ছাত্রটি কুরআন পাঠ ও সালাতের মধ্যে সূরা মাউন তিলাওয়াতের বিষয় উল্লেখ্য করে। পাল্টা প্রশ্নে দাহলান সূরা মাউনের দুটি আয়াত (অর্থাৎ ‘এরা হলো তারা যারা ইয়াতিমদের গলা ধাক্কা দেয় এবং যারা মিসকিনদের আহার প্রদানে উদ্বুদ্ধ করে না।’) উল্লেখপূর্বক আয়াতদ্বয়ের শিক্ষা ও নির্দেশনার ওপর কিভাবে আমল করা হয়- জানতে চান। ছাত্রটি তখন সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়। এ ঘটনার পরই আহমাদ দাহলান মানুষের বাস্তব জীবনের পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গনে কুরআনের শিক্ষা ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘মুহাম্মাদিয়া’ সংগঠন।
‘কে এইচ আহমাদ দাহলান’ ১৮৬৮ সালে এক ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আহমাদ দাহলান বাবা-মা উভয়ের দিক থেকে উচ্চবংশীয় ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য ছিলেন। তিনি আহমাদ ইবনে তাইমিয়া, জামাল উদ্দীন আফগানী, মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব নজদী ও মিসরের প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার মুহাম্মাদ আবদুহুর ভাবশিষ্য ও ধর্মীয় চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন।
তিনি আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায়ও বুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৮৯০ ও ১৯০২ সালে দু’বার হজ সম্পাদন করেছিলেন। হজ উপলক্ষে মক্কায় গমন করে সেখানকার বড় বড় শায়খদের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন। মক্কা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর স্বধর্ম ও স্বজাতির করুণ অবস্থা অবলোকন করে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত হন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণপূর্বক দেশের মানুষকে কুরআন-সুন্নাহর সঠিক শিক্ষার আলোকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুহাম্মাদিয়া’। এ মহান মানুষটি ১৯২৩ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
‘মুহাম্মাদিয়া’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে পথহারা মানুষকে কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত শিক্ষা তথা আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকারের চেতনায় গড়ে তোলা, যারা হবেন সোনালি যুগের প্রকৃত মুসলমানদের ন্যায় শিরক-বিদয়াতমুক্ত খাঁটি আমল ও আকিদার অধিকারী। উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে মুহাম্মাদিয়ার আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশনের ৩ নং চ্যাপ্টারে বলা হয়েছে- ‘The purpose and objective of Muhammadiyah is to uphold the Islamic religion so as to realize the true Islamic society’.
আহমাদ দাহলানের মৃত্যুর সময় (১৯২৩ সাল) দুই হাজার ৬২২ জন পুরুষ এবং ৭২৪ জন মহিলা ‘মুহাম্মাদিয়া’র সদস্য ছিলেন। ১৯২৮ সালে প্রায় ১০হাজার, ১৯২৯ সালে প্রায় ১৭ হাজার, ১৯৩১ সালে প্রায় ২৪ হাজার ইন্দোনেশীয় নারী-পুরুষ এ সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং ইন্দোনেশিয়াব্যাপী ‘মুহাম্মাদিয়া’র শাখা ও সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২.৯ মিলিয়ন এবং ‘নাহদাতুল উলামা’র পরেই এটি ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামিক সংগঠন হিসেবে পরিগণিত। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় মুহাম্মাদিয়ার কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবস্থিত।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মুহাম্মাদিয়া’ মূলত সুন্নী ধারার অনুসারী। তারা একমাত্র কুরআন-সুন্নাহকে ইসলামী আইনের মূলভিত্তি হিসেবে আকিদা পোষণ এবং ধর্মের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক আপস ও শিথিলতাকে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। নৈতিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষের আকিদাকে নিখুঁত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করাই ‘মুহাম্মাদিয়া’ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তারা বিভ্রান্ত ও বিকৃত সুফিবাদেরও বিরোধী।
নারী শিক্ষার ব্যাপারে মুহাম্মাদিয়া উদার ও আন্তরিক। তৃণমূল পর্যায় থেকে নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারেও মুহাম্মাদিয়া অঙ্গীকারাবদ্ধ। সামাজিক, আর্থিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে নারীর উন্নয়নে তাদের অনেকগুলো মহিলা সংগঠন রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মহিলা ও কর্মজীবী নারীদের ক্ষেত্রে ‘আয়েশিয়্যাহ’ এবং ছাত্রীদের ক্ষেত্রে ‘নাশিয়াতুল আয়েশিয়্যাহ’।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক কার্যক্রম ও ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলনকে সামনে রেখেই ‘মুহাম্মাদিয়া’-এর জন্ম। দরিদ্র, রোগাক্রান্ত ও শিক্ষাবঞ্চিত মানুষকে সহযোগিতার জন্য আহমাদ দাহলান ‘মুহাম্মাদিয়া’-এর প্রতিষ্ঠাকালেই এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম হাতে নেন। ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছে। বর্ণিত হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে মুহাম্মাদিয়ার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল, হেলথ ক্লিনিক, নার্সিং হোম, ইয়াতিম পালন ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং মা ও শিশু হাসপাতালের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫৭।
শিক্ষা বিস্তারে মুহাম্মাদিয়ার অবদান ব্যাপক। তাদের প্রোফাইলে প্রকাশিত (২০১৫) তথ্যের আলোকে দেখা যায়, মুহাম্মাদিয়া প্রতিষ্ঠিত মক্তব বা কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা প্রায় চার হাজার ৬২৩, প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার ৬০৪, জুনিয়র হাইস্কুলের সংখ্যা এক হাজার ৭৭২, সিনিয়র হাইস্কুলের সংখ্যা ৬৮৭, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ২৭৮ এবং কলেজ ও ইউনিভার্সিটির সংখ্যা প্রায় ১৭২। প্রতিবন্ধীদের জন্যও তাদের পরিচালিত বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। মুহাম্মাদিয়া পরিচালিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে জার্কাতা, আচেছ, মালাং, যোগজাকার্তা প্রভৃতি স্থানে।
আহমাদ দাহলান জনগণের মাঝে পবিত্র কুরআনের সঠিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে সাম্র্রাজ্যবাদ কর্তৃক সাধারণ ইন্দোনেশিয়ানদেরকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার হীন ষড়যন্ত্র রুখে দেন। তিনি আধুনিক শিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেন। আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে ধর্মীয় বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঘরে ঘরে ইসলামী শিক্ষা পৌঁছে দেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় জুলুমের শিকার মুসলিম জনসাধারণের ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষায় সফল হন। মুসলিম সমাজে ইসলামের নামে প্রচলিত বিভিন্ন আকিদাগত বিভ্রান্তি নিরসনের ক্ষেত্রেও মুহাম্মাদিয়ার অবদান অপরিসীম।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সয মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে মুহাম্মাদিয়া বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়। এর সুফল মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পেতে থাকে। উল্লেখযোগ্য কিছু কার্যক্রম হচ্ছে- হাসপাতাল, পলিক্লিনিক, নার্সিং ইনস্টিটিউট, স্পেশালাইজড হসপিটাল যেমন- চক্ষু হাসপাতাল ইত্যাদি। তা ছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে অসংখ্য চড়ড়ৎ যড়ঁংব প্রতিষ্ঠা করা হয়। যা ছিল মুহাম্মাদিয়ার এক যুগান্তকারী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে মুহাম্মাদিয়া বিপুল সংখ্যক দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে চিকিৎসার আওতায় আনতে সক্ষম হয়। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মুহাম্মাদিয়ার পদক্ষেপগুলো মানবকল্যাণে নিয়োজিত বিশ্বের অন্যান্য সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য এক অনন্য ও আদর্শ উদাহরণ।
এ বিষয়ে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ প্রফেসর এম এ মান্নান বলেন, ‘হোটেলে যাওয়ার আগে আমাকে তাদের ইসলামিক হসপিটালটি দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব করা হলো। আমরা গেলাম। বলতে কি, আজো সেই মুহাম্মাদিয়ার পরিচালিত ‘ইসলামিক হসপিটাল অব জাকার্তা’ গোটা ইন্দোনেশিয়ায় সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। তখনই হাসপাতালটি ছিল ৫০০ শয্যার। স্টেট অব দ্য আর্ট টেকনোলজিতে সজ্জিত। আমাকে বিভিন্ন বিভাগ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখানো হচ্ছে। আমার অবাক হওয়ার পালা তখনো বাকি ছিল। যখনই কোনো রুমে প্রবেশ করি দেখি, সেখানে লেখা রয়েছে- এটা ওয়াকফ সম্পত্তি, অমুক ব্যক্তি দান করেছেন। ইংরেজি ও ইন্দোনেশিয় ভাষায় লেখা। বিভিন্ন ব্যক্তির দানের ওয়াকফ থেকে বিশাল এই হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে প্রবেশের পর আমার মনে ভিন্ন এক ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। সেখানে লেখা আছে ‘আমরা শুধু চেষ্টা করি, কিন্তু আমাদের সবাইকে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যেতে হবে।’ এমন এক মহিমান্বিত পরিবেশ সবাইকে আবেগাপ্লুত করবে। ‘আমরা মৃত্যুকে ঠেকাতে পারব না। আমরা শুধু চেষ্টা করছি যেন তোমার দুঃখ কিছুটা লাঘব করা যায়।’ (নয়া দিগন্ত, ৪ অক্টোবর ২০১৯)
১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য জাকার্তা পোস্ট’-এ মুহাম্মাদিয়ার তৎকালীন চেয়ারম্যান দ্বীন সামসুদ্দীনের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এতে তিনি মিয়ানমার সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বিষয়ে বলেন, ‘মানবাধিকারের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের সব সমস্যার যথাযথ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া সরকারকে অবশ্যই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকার যদি রোহিঙ্গাদের যথাযথ সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়, তা হলে ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন (মুহাম্মাদিয়া) তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে।’
ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী অরাজনৈতিক সংগঠন মুহাম্মাদিয়া সালাফি মতাদর্শের অনুসারী। ফিকহ, আধ্যাত্মিকতা, অর্থনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তারা নির্দিষ্ট কোনো মাজহাব বা ইমামের অনুসরণ না করে সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতেই সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তারা ‘সুফিবাদ’কে কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী বাতিল ও বিদয়াতি মতবাদ হিসেবে গণ্য করে থাকে। এ ছাড়া তারা কঠোরভাবে নিজেদেরকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখে।
বিপরীতে ইন্দোনেশিয়ার সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন ‘নাহদাতুল উলামা’ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত। তারা ফিকহের ক্ষেত্রে শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী হলেও হানাফি, মালেকি ও হাম্বলি মাজহাবকেও স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। তারা সুফিবাদকে ইসলামসম্মত মনে এবং এ ক্ষেত্রে ইমাম গাজ্জালি রহ: ও জুনায়েদ আল বাগদাদি রহ:-এর মতাদর্শকে অনুসরণ করেন। সংগঠনটি সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার National Awakening Party বা PKB জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে আসছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে ‘পিকেবি’ জোট জয়লাভ করলে ‘নাহদাতুল উলামা’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ‘উস্তাদ আব্দুর রহমান ওয়াহিদ’ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বর্তমানেও তারা ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ‘জোকো উইদোদো’র কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হয়ে বিভিন্ন সরকারি নীতি নির্ধারণে গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
মুহাম্মাদিয়া দরিদ্র লোকদের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের বিভিন্ন স্বেচ্ছামূলক দান যেমন- জাকাত, ওয়াকফ, ওসিয়ত ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে অসংখ্য সমবায় সমিতি গড়ে তোলার মাধ্যমে ইসলামিক মাইক্রো-ফাইন্যান্সের এক সফল নমুনা বা মডেল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। মুহাম্মাদিয়া কর্তৃক ইসলামিক মাইক্রো-ফাইন্যান্সের প্রায়োগিক সফলতার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে ড. এম এ মান্নান বলেছেন, ‘আর এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে (তারা) ইসলামের স্বেচ্ছাসেবক খাতগুলোর সম্পদ কাজে লাগান। তাদের সাথে কথা বলে জানলাম, তারা অসংখ্য সমবায় সমিতি করেছে। তখন আমি সেগুলোর সাথে কথা বলি। ওইসব সমবায় ঠিক ইসলামী নিয়মনীতি মেনেই কাজ করছে। এগুলোকে সমন্বিত করে ব্যাংকিং রূপ দেয়া যেতে পারে। ... এর জের ধরে ১০ বছর পর ১৯৯২ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামী ব্যাংক- ব্যাংক মুয়ামালাত প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুহাম্মাদিয়ার অনুসরণে বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন যদি তাদের শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী বঞ্চিতদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে। বিশেষত বিভিন্ন বিদেশী এনজিও যারা সাধারণ মানুষকে সহায়তার নামে মানবতাবিরোধী সুদী ঋণের যাতাকলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট করে চলছে, নিঃসন্দেহে তারা এ অমানবিক অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পাবে। আর এ জন্য দেশের মসজিদ-মাদরাসাগুলোকে শুধু নামাজ ও ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অতি দ্রুত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। এ কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, যদি যথাযথ পরিকল্পনার আলোকে ইসলামিক মাইক্রো-ফাইন্যান্সের সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয় তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এ ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে এবং এর মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল জাতি বিনির্মাণের গৌরবজনক অধ্যায় সূচিত হবে। মুহাম্মাদিয়ার অনন্য ও অসাধারণ কার্যক্রম সম্পর্কে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এম এ মান্নানের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য উল্লেøখপূর্বক লেখার ইতি টানছি- ‘ওদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।...আমি ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর ইন্দোনেশিয়া গেছি। সেখানে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে অংশ নিয়েছি।, মতামত দিয়েছি। শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলে হয়তো আরো যাওয়া হতো। এর জন্য আমি গৌরব বোধ করি। এখনো আমি মুহাম্মাদিয়ার এক্সটার্নাল অ্যাডভাইজার। ইসলামের স্বেচ্ছাসেবক খাতের বিপুল শক্তি সম্পর্কে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় মুহাম্মাদিয়ার কাছ থেকে।’ (নয়া দিগন্ত, ৪ অক্টোবর ২০১৯)
লেখক : প্রিন্সিপাল, সিএসবি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড