তুরস্কের মিশন পিকেকে
তুরস্কের মিশন পিকেকে - ছবি সংগৃহীত
ইরাকি ভূখণ্ডের এক কিলোমিটার অভ্যন্তরে গারা পর্বতে ১০ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক যে সামরিক অভিযান চালিয়েছিল কয়েকটি প্রেক্ষাপটে তা এখনো ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়ে রয়েছে।
কয়েকটি লক্ষ্য অর্জনের জন্যই এই মিশন পরিচালনা করা হয়েছিল। একটি লক্ষ্য ছিল ইরাকের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আবেগতাড়িত অবস্থান থেকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টিকে (পিকেকে) নির্মূল করা। আরেকটি লক্ষ্য ছিল, পিকেকে তাদের যোদ্ধাদের ইরাকের উত্তরাঞ্চল থেকে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে স্থানান্তর করার জন্যে যে করিডোরটি ব্যবহার করত তার নিয়ন্ত্রণ তুরস্ক নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়া। তৃতীয় লক্ষ্য ছিল, তুরস্কের পিকেকের হাতে আটক এক ডজনেরও বেশি তুর্কি জিম্মিকে উদ্ধার করা। এই জিম্মিদেরকে পিকেকে তুরস্কের কারাগারে বন্দী, তাদের সন্ত্রাসীদের মুক্ত করতে দর কষাকষির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল।
এই জিম্মি বা পণবন্দীদের ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে পিকেকে অপহরণ করেছিল এবং তখন থেকেই তারা তাদেরকে আটক করে রেখেছে। অবশ্য কয়েকজন পণবন্দীকে তাদের পরিবারের কাছে চিঠি লেখার অনুমতি দেয়। পণবন্দীরা তাদেরকে উদ্ধার করতে তুর্কি সরকারের কাছে ‘কিছু একটা’ করার আবেদন জানায়। পণবন্দীদের পরিবারের সদস্যরা তুরস্কের পার্লামেন্ট ভবনের করিডোরে অবস্থান গ্রহণ করে। কয়েকটি বিরোধী দল পণবন্দীদের মা-বাবাকে স্বাগত জানায়। তাদের অভিযোগ শোনে এবং পার্লামেন্ট সরকারের মন্ত্রীদের কাছে এই সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। কিন্তু এমন প্রচেষ্টার পরও এ সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।
গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে তুরস্ক জানতে পারে, তুরস্কের পণবন্দীদের গারা পর্বতের একটি গুহায় স্থানান্তর করা হয়েছে এবং গুহাটিকে পিকেকে একটি সামরিক সদর দফতরে রূপান্তরিত করতে যাচ্ছে। এই খবর পাওয়ার পরই তুরস্ক সেখানে সামরিক অভিযান চালায়। ট্যাংকার এয়ারক্রাফটসহ ৪১টি যুদ্ধবিমান নিয়ে বড় ধরনের ওই অভিযান তুরস্ক পরিচালনা করে। ওই অভিযানে আগাম সতর্কতাদানকারী বিমান, হেলিকপ্টার এবং সশস্ত্র ও যন্ত্রবিহীন ড্রোনও ব্যবহার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান এই অভিযানের ব্যাপারে খুবই আস্থাশীল ছিলেন। এই অভিযান সফল হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে অভিযানের কয়েকদিন আগে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, শিগগির ভালো খবর দিতে পারবেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে অভিযান শুরু হয়। কয়েক ঘণ্টা ব্যাপক বোমা হামলা চালানোর পর তুরস্কের সেনাবাহিনী এই উপসংহারে উপনীত হয় যে, ওই এলাকাটি স্থল অভিযান চালানোর জন্য নিরাপদ। তাই তারা গুহার চতুর্দিকে হেলিকপ্টার থেকে কমান্ডোদের নিচে নামিয়ে দেয়। কিন্তু পিকেকে এই অভিযানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অভিযান চালাতে গিয়ে তুর্কি সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন, একজন লেফটেন্যান্ট এবং একজন সার্জন নিহত এবং তিনজন সেনা আহত হন।
বহু বিশ্লেষক দাবি করেছেন, তুরস্কের সেনাবাহিনীকে ওই পর্যায়ে গিয়ে পরিস্থিতির পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত ছিল। তাদের নিজেদেরকেই এই প্রশ্ন করেছেন। পণবন্দীরা এখনো বেঁচে থাকলে পিকেকের সাথে আমাদের তাদেরকে মুক্ত করার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যাপারে আলোচনা করা প্রয়োজন। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তাদেরকে যুদ্ধাবস্থায় মুক্ত করার জন্য কি আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত হবে না? আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল, সরকার একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর সেনাবাহিনী ওই গুহায় প্রবেশ করে পণবন্দীদের লাশগুলো খুঁজে বের করে আনতে না পারা পর্যন্ত সঙ্ঘাত অব্যাহত থাকবে।
নিহত একজন পণবন্দীর বাবা জানান, তিনি বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডের পিকেকের একজন সমর্থকের কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েছেন। তাতে দাবি করা হয়, পিকেকের হাতে তার ছেলে নিহত হয়নি; তুর্কি বাহিনীর বোমা বর্ষণেই তার ছেলে নিহত হয়েছে। কিন্তু তিনি বলেন, তার ছেলের লাশ তাকে দেখানো হয়েছে। তিনি দেখেছেন, প্রকৃতপক্ষে তাকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি লাশের বোধগম্য ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সরকার এখনো প্রকাশ করেনি।
১৩ জন নিরস্ত্র পণবন্দীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করায় আজ গোটা তুর্কি জাতি ক্ষুব্ধ। ওই ক্ষোভ এখনো পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি। অতীতেও কিছুটা ছাড় দিয়ে বা জিম্মিদের মুক্ত করে আনার ঘটনা ঘটেছে। গারা অভিযানের এক সপ্তাহের মধ্যে সামান্য ভিন্নধর্মী ঘটনাও ঘটেছে। আঙ্কারা নাইজেরিয়ার সন্ত্রাসীদের সাথে আলোচনা করেছে। ওই সন্ত্রাসীরা পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে ১৫ জন তুর্কি জেলেকে অপহরণ করেছিল।
সন্ত্রাসবাদ তুরস্কের সম্পদ ধ্বংস করছে। সন্ত্রাসী হামলার দ্বারা গত ৩৫ বছরে ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) ডেপুটি চেয়ারম্যান নুমান কুরতুলমাসের ধারণা, পিকেকের সন্ত্রাসের কারণে তুরস্কের দুই ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতির ওই পরিসংখ্যান সম্ভবত অবশ্যই তুর্কি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কুর্দি সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটির অবসান ঘটাতে অন্য পন্থা অবলম্বনে প্রভাবিত করবে।
২০১৫ সালে এরদোগান ‘কুর্দি (গণতান্ত্রিক) উদ্বোধন’ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্র্যাট পার্টি ২০১৫ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৮১ আসনে জয়লাভ করে এবং পার্লামেন্ট তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর এরদোগান তার উদ্যোগ থেকে সরে আসেন এবং ‘কুর্দি উদ্বোধন’ চিরতরে ভুলে যান। তুরস্ক শেষ পর্যন্ত যদি দেরিতে হলেও, সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক এবং বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে সংস্কার শুরু হওয়ার কথা বলেছিল- তা বাস্তবায়ন করে, তাহলে কুর্দি, তুর্কি এবং সিরকাসিয়ানসহ দেশের সব নৃতাত্ত্বিক গ্রুপ উপকৃত হবে। তখন বর্তমান তুরস্কে যে সামাজিক উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়ছে তা হ্রাস পেতে পারে এবং দেশটি একেপির শাসনের আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারে।
লেখক : তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন একে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ‘আরব নিউজ’ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার