বিখ্যাত বায়তুল হিকমা গ্রন্থাগার
বিখ্যাত বায়তুল হিকমা গ্রন্থাগার - ছবি সংগৃহীত
বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কালকে মধ্যযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কখন থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কখন এটি শেষ হয়, সর্বোপরি এর পরিব্যাপ্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইউরোপীয় ইতিহাসের আলোকে মধ্যযুগ বিবেচনা করা হয় ৪৭৬ থেকে ১৪৯২ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর সময়কালকে। এ সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের পতন, আধুনিক ইউরোপের নবযাত্রা, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নতুন বিশ্ব আবিষ্কার, ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগের সূচনাসহ ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব কারণে এ সময়কালটিকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়। যথা- মধ্যযুগীয় সময়, অন্ধকারের যুগ এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের যুগ ইত্যাদি।
অপর দিকে এ সময়টিতেই ইসলামের আবির্ভাব, ইসলামী সোনালি যুগের প্রবর্তন ও সমাপ্তি, বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতন, ক্রুসেডের যুদ্ধ ও এর প্রভাবসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
দীর্ঘ সময়কালে মুসলমানরা বিশ্বে এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেন। ইসলামের ইতিহাসের এ দীর্ঘ সময়কাল সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে সব যুগ সমান না হলেও সামগ্রিকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কাল হতে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টি ও বিকাশের জন্য ‘সোনালী অধ্যায়’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আল কুরআনে বারবার জ্ঞান চর্চার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে মুসলমানরা আন্তরিকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবদ্দশায় তাঁর সাহাবি ও অনুসারীদের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের বিরাট কর্মচাঞ্চল্য পরিচালিত হয়। তাঁর সময়ে সাহাবিদের শিক্ষাদানের জন্য মসজিদে নববীকেন্দ্রিক যে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে সেটাই প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। বস্তুত ইসলামের প্রাথমিক কাল থেকে শুরু করে উমাইয়া শাসনকাল (৭৫০ খ্রি.) পর্যন্ত মসজিদই ছিল জ্ঞান চর্চার বৃহত্তম বিদ্যাঙ্গন। বস্তুত ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হিসেবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদকে জ্ঞান চর্চার অঙ্গন বানিয়েছিলেন। গোটা উমাইয়া শাসনকাল পর্যন্ত মসজিদের এ ভূমিকা অব্যাহত ছিল। নবউদ্দীপনায় বলীয়ান হয়ে মুসলমানরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ভাষায় রচিত মনীষী, বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারকদের গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করত তা আরবি ভাষায় ভাষান্তর করেন। বিশেষ করে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো সংগ্রহ করত তা আরবি ভাষায় ভাষান্তরিত করা হয়। সেগুলোই পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম গবেষক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসকদের আবির্ভাবের পথ তৈরি করে দিয়েছিল। অন্য দিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই প্রবহমান ধারায় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ পাঠাগার। এর মধ্যে বাগদাদ, কায়রো, বোখারা, সমরখন্দ, নিশাপুর, মসুল, মার্ভ, বসরা, ইস্পাহান, শিরাজনগর, কায়রো, কর্ডোভা, সেভিল, দামেস্কে, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি নগরীতে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ইসলামের ইতিহাসে আব্বাসী যুগকে (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগ বলা হয়। নিঃসন্দেহে এ যুগ মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ। আব্বাসী শাসকগণ এশিয়া ও ইউরোপের বিশাল অংশ নিয়ে সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এ সময়ে জ্ঞান চর্চা ও শিক্ষা-দীক্ষা চরম উৎকর্ষ লাভ করে। আব্বাসী খলিফা আল মানসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) ৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদ নগরীকে নতুন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। এর পর থেকে প্রভাবশালী আব্বাসী খলিফাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বপ্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ, অনুবাদকরণ ও গবেষণায় এক অত্যুজ্জ্বল তীর্থভূমির মর্যাদা লাভ করেছিল এ বাগদাদ। আল মানসুরের বিদ্যানুরাগ ও জ্ঞান চর্চার পরিপোষকতায় মুসলিম সমাজে পুস্তকপ্রীতি আশাতীত রূপে বৃদ্ধি পায়। ‘বাইতুল হিকমা’ বা House of Wisdom ছিল সেই সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বৃহদাকার গ্রন্থাগার। আব্বাসী খলিফা হারুনুর রশিদ (শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) ‘বাইতুল হিকমাহ্’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার সুযোগ্যপুত্র খলিফা আল মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)-এর সময় এটি উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে। নবম শতকের মধ্যভাবে ‘বাইতুল হিকমাহ’ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রন্থভাণ্ডার। এ বিশাল গ্রন্থকেন্দ্র ছিল একাধারে গ্রন্থাগার, অনুবাদকেন্দ্র, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং মানমন্দির। এটিকে ইসলামী স্বর্ণযুগের প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ব্যক্তিগতভাবে খলিফা আল মামুন ছিলেন বহু মানবিকগুণে গুণান্বিত একজন বিদগ্ধ শাসক। জ্ঞানের আদান-প্রদানের জন্য আল মামুন অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিকে বাইতুল হিকমাহতে নিয়ে আসেন। বায়তুল হিকমায় ফার্সি, গ্রিক, মিসরীয়, কালদীয়, ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থ সংগৃহীত হতো। তার উজির ইয়াহিয়া বার্মাকী বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের বাগদাদে আমন্ত্রণ করেছিলেন। আরবদের ‘অগাস্টাস’ খ্যাত এ বায়তুল হিকমাহ্ একাধারে গবেষণাগার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরি হিসেবে পূর্ণাঙ্গ জৌলুসপ্রাপ্ত হয়। খলিফা আল মামুন বাগদাদের এ গ্রন্থাগারটিকে বৈশ্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলেছিলেন। তাতে সে যুগেই প্রায় ৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল। বীজ গণিতের জন্মদাতা মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারেজমি (৭৮০-৮৫০ খ্রি.) সেই বিরাট গ্রন্থাগারের একজন লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। তিনি ভারতবিষয়ক একটি বই লিখেছিলেন- যার নাম কিতাবুল হিন্দ। গণিত শাস্ত্রে শূন্যের মূল্য অপরিসীম। এই শূন্য [০] আবিষ্কার তার বলে দাবি করা হয়। ‘হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা বইটি তার বিরাট অবদানের একটি উত্তম নিদর্শন। এ সময়কালটিতে বায়তুল হিকমায় বিদেশী গ্রন্থের আরবি অনুবাদের ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়। খলিফা আল মামুন হহুদি, পারসি, খ্রিষ্টান, মুসলিম নির্বিশেষে পণ্ডিতদেরকে তার অনুবাদে নিযুক্ত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকর্মে স্থপতি ও প্রকৌশলী বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ কাজ করতেন। তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সরকারি দিনপঞ্জির হিসাব রাখতেন এবং সরকারি কর্মী হিসেবেও কাজ করতেন। তারা একই সাথে চিকিৎসক ও পরামর্শদাতাও ছিলেন। খলিফা আল মামুনের কাছে সৌজন্যস্বরূপ আসত জ্ঞানের অমূল্য সব সংগ্রহ প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। তিনি সহল বিল হারুন নামক এক পারসিক ডাক্তারকে নিযুক্ত করলেন মাজুসী সভ্যতার মূল্যবান বই পুস্তকগুলো অনুবাদ করার জন্য। মামুনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে দরবারের সবার ভেতরই অনুরূপ প্রেরণা দেখা দিলো। এ যুগে যেসব বই-পুস্তক অনূদিত হয়েছিল তা গ্রিক, ফারসি, কালভি, কিবতি ও শামি ভাষায় লিপিবদ্ধ ছিল। এই লাইব্রেরিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব অনুষের পুস্তকসমূহ সংগ্রহ করা হয়। এখানে প্রায় ছয় লাখেরও বেশি পুস্তক সংগৃহীত হয়।
বায়তুল হিকমাহ্ ‘খিজানাতুল হিকমাহ’ নামেও পরিচিত ছিল। এটি ছিল বাগদাদের সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানমন্দির। এ গ্রন্থাগারের ভূমিকা প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারকে ছাড়িয়ে যায়। এখানে বিজ্ঞানীরা দিনরাত নিরলস গবেষণা, পর্যবেক্ষণ এবং লেখার কাজে ব্যাপৃত থাকতেন। ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ তথা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সব প্রান্ত থেকেই জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটতো এ ‘হাউজ অফ উইজডমে’ জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যে। এর গ্রন্থাগারিক ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী ও বিজ্ঞানীগণ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন :- সহল ইবনে হারুন, হুনাইন ইবনে ইসহাক, মুসা আল-খাওয়ারিজমি প্রমুখ।
খলিফা আল মামুনের উত্তরাধিকারি আল মুতাসিম (শাসনকাল ৮৩৩-৮৪২ খ্রি.) ও তার পুত্র আল ওয়াসিকের সময়কাল পর্যন্ত বাইতুল হিকমাহ্ সগৌরবে জ্ঞানের আলো বিতরণের কাজ চালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের আমলে (শাসনকাল ৮৪৭-৮৬১ খ্রি.) এর অবনতি শুরু হয়। ১২৫৮ সালে মোঙ্গলবার শাসক হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করে শরহটিকে ধ্বংস করেন। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় লাইব্রেরি গবেষণা কেন্দ্র। গুঁড়িয়ে দেয়া হয় মসজিদ ও দৃষ্টিনন্দন সব ভবন। এ ধ্বংসলীলায় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান বায়তুল হিকমাহ্ও।