বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র : একটি পর্যালোচনা
বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র : একটি পর্যালোচনা - ছবি : সংগৃহীত
সাংবাদিক নুরুল কবীর ইতিহাস নিয়ে একবার চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন, 'ইতিহাস অন্ধ। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হয়।' ইতিহাসের এই পথ দেখাতে যেয়ে খোদ ইতিহাসের মধ্যেই আমরা দিশাহারা হয়ে পড়ি। চলমান ইতিহাসের মধ্যেই আমরা কত অসামঞ্জস্যতা দেখতে পাই, আর দূরের ইতিহাস তো অনেক দূরে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পথ দেখানো ভয়ানক কঠিন। কিন্তু এই কঠিন কাজটাই অত্যন্ত সাহস নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় ১৮৮৬ সালে তার 'কৃষ্ণচরিত্র' লেখার মধ্যে দিয়ে করেছিলেন।
ভারতের বেশির ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতার হিসাবে মান্য করেন। তাদের এই মান্যতা শ্রদ্ধার্ঘ্য। অনেকে আবার কৃষ্ণকে ভগবান হিসেবে বিবেচনা করেন। কেউ কেউ পৌরাণিক চরিত্র হিসেবে কৃষ্ণকে দেখে থাকেন। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক কৃষ্ণ অনেক রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে সেখানে। এতসব রূপের কারণে ইতিহাসে, পুরাণে, বঙ্কিমের সময়ে শ্রী কৃষ্ণকে নিয়ে লোকমুখে নানাধরনের গল্প, কূটতর্ক, প্রচলিত হয়ে আসছিল।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় তার কৃষ্ণচরিত্র লেখাতে মূলত সেসব তর্কের অবসান ঘটিয়ে কৃষ্ণের যথাযথ একটা চিত্র আঁকতে চেয়েছিলেন। যেমন তিনি লিখেছেন, 'কৃষ্ণসম্বন্ধনীয় যে সকল পাপোপাখ্যান জনসমাজে প্রচলিত আছে, তাহা সকলই অমূলক বলিয়া জানিতে পারিয়াছি এবং উপন্যাসকারকৃত কৃষ্ণসম্বন্ধীয় উপন্যাস সকল বাদ দিলে যাহা বাকি থাকে, তাহা অতি বিশুদ্ধ, পরমপবিত্র, অতিশয় মহৎ, ইহাও জানিতে পারিয়াছি। জানিয়াছি ঈদৃশ সর্বগুণান্বিত, সর্বপাপসংস্পর্শশূন্য, আদর্শ চরিত্র আর কোথাও নাই। কোন দেশীয় ইতিহাসেও না, কোন কাব্যেও না।'
এখানে 'পাপোপাখ্যান' শব্দটা লক্ষণীয়। যাকে ঈশ্বরের অবতার বা ঈশ্বরতুল্য করা হয়, তার সম্পর্কে পাপোখ্যান রচনা অত্যন্ত আপত্তিজনক ঘটনা। এই পাপমোচনের জন্যে বঙ্কিমচন্দ্র তাই যে কৃষ্ণকে আবিষ্কার করেছেন, ওই কৃষ্ণ সব গুণে গুণান্বিত, সকল পাপের উর্ধ্বে এবং এমন আদর্শ চরিত্র যে ইতিহাস বা সাহিত্য কোথাও এমন চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়নি। কিন্তু কৃষ্ণ চরিত্রের কালিমা তুলতে যেয়ে উনি কৃষ্ণকে এমন সাফাই করেছেন যে কৃষ্ণচরিত্রের বাদবাকি রংগুলোও মুছে ফেলেছেন। এই সাফাইয়ের ফলে কৃষ্ণ সম্পর্কে পাঠকের সন্দেহ আরো বাড়িয়ে তুলেছেন।
এই সন্দেহ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এড়িয়ে যেতে পারেননি। তাই বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রের ওপর আলোচনা করে তিনিও আলাদা করে কৃষ্ণচরিত্র লিখেছেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র লেখার ওপর নিরপেক্ষ আলোচনার পাশাপাশি বেশ প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু কৃষ্ণের প্রতি অতিপক্ষপাতিত্ব করতে যেয়ে যে ভুলটা বঙ্কিমচন্দ্র করেছিলেন, সেটাও রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ তার 'কৃষ্ণচরিত্র' প্রবন্ধে লিখেছেন- 'কৃষ্ণচরিত্রের রীতিমতো ইতিহাস সমালোচনা এই প্রথম। ইতিপূর্বে কেহ ইহার সূত্রপাত করিয়া যায় নাই, এইজন্য ভাঙ্গিবার এবং গড়িবার ভার উভয়ই বঙ্কিমকে লইতে হইয়াছে।... মহাভারতকেই বঙ্কিম প্রধানত আশ্রয় করিয়াছেন ... বঙ্কিম যাহাকে [অর্থাৎ মহাভারতের মূল লেখক ব্যাস] মহাভারতের প্রথম স্তরের কবি বলেন তিনি কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করিতেন না, এ কথা বঙ্কিম স্বীকার করিয়াছেন।... কিন্তু বঙ্কিম কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করিতেন... উত্তরে কেহ বলিতে পারেন যে, বঙ্কিম যদিও কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করিতেন তথাপি তিনি বারংবার বলিয়াছেন যে, ঈশ্বর যখন অবতাররূপে নরলোকে অবতীর্ণ হন তখন তিনি সম্পূর্ণ মানুষ-ভাবেই প্রকাশ পাইতে থাকেন, কোনোপ্রকার অলৌকিক কান্ড-দ্বারা আপনাকে দেবতা বলিয়া প্রচার করেন না। অতএব বঙ্কিম দেবতা- কৃষ্ণকে নহে, মানুষ-কৃষ্ণকেই মহাভারত হইতে আবিষ্কার করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। কিন্তু যে মানুষকে বঙ্কিম খুঁজিতেছিলেন তাহার কোথাও কোনো অসম্পূর্ণতা নাই, তাহার সমস্ত চিত্তবৃত্তি সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপ্রাপ্ত।'
বঙ্কিম তার লেখায় বারবার বলেছেন, কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব প্রতিপন্ন করা তার বইয়ের উদ্দেশ্য নয়। কৃষ্ণের মানবচরিত্র সমালোচনা করাই তার উদ্দেশ্য। এখন কথা হলো কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব প্রতিপন্ন করা যদি বঙ্কিমের উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে, তাহলে কৃষ্ণের যেসব গুণকীর্তন উনি করেছেন ওইসব এক ঈশ্বর ছাড়া আর কোথাও পাওয়া সম্ভব না। বঙ্কিম আসলে মানুষকৃষ্ণকে খুঁজতে যেয়ে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরকৃষ্ণকেই খুঁজেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার সুবিধামতো কৃষ্ণকে একবার ঈশ্বর আরেকবার অবতাররূপে উপস্থিত করেছেন। দ্বিতীয় বিষয়, বঙ্কিমের মতে কৃষ্ণ কখনোই একাধিক বিয়ে করেন নাই। তার একজনই স্ত্রী আর উনি হলেন রুক্সিণী। এই কথার পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্র এটাও বলছেন প্রয়োজনে পুরুষের বহুবিবাহ অধর্মের কিছু নয়। কৃষ্ণের যদি একজন স্ত্রীই থেকে থাকে তাহলে বহু বিয়ের কথা আসছে কেন? তার মানে কি এই না যে বঙ্কিম নিজেও প্রচ্ছন্নভাবে কৃষ্ণের অনেক স্ত্রী থাকা নিয়ে ইতস্তত ছিলেন? সবচেয়ে বড় কথা, কৃষ্ণের সাথে যে নামটা যুগের পর যুগ ধরে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়েছিল ওই রাধা বঙ্কিমের লেখা থেকে একেবারে উধাও হয়ে গেছে। অথচ রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী আজও বিখ্যাত হয়ে আছে। সম্ভবত এই কারণে বঙ্কিম মহাভারতের বাইরে অন্য কৃষ্ণকে বর্জন করেছেন। ফলে বঙ্কিমের কৃষ্ণ একপেশে কৃষ্ণ হয়ে গেছে।
শুধু কৃষ্ণকে একপেশে করেননি, দ্রৌপদীকেও একপেশে করা হয়েছে। দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামীর গল্প বঙ্কিমের কাছে একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার মতে, অর্জুন ছাড়া দ্রৌপদীর আর কোনো স্বামী ছিল না।
এই যে ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক ঘটনার কিছু অংশ গ্রহণ এবং কিছু বর্জনের মধ্যে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র যেভাবে তার মতো করে কৃষ্ণ বা দ্রৌপদীকে সাজিয়েছেন, এতে করে বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রের সুদীর্ঘ লেখাটার বিশ্বাসযোগ্যতার চেয়ে অনেক ধরনের প্রশ্ন ও সন্দেহ উঁকি দিতে থাকে। অথচ এই কৃষ্ণচরিত বঙ্কিমচন্দ্রের প্রচুর গবেষণার ফসল। যথেষ্ট যুক্তি ও তর্ক উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে, দেশী-বিদেশী কৃষ্ণচরিত্রের পর্যালোচনার মধ্যে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণকে সর্বোচ্চ আসনে বসাতে চেয়েছেন। আসলে পক্ষপাতমূলক লেখা সবসময়ে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যায়। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা, বিশেষ করে সেসব লেখা যদি ধর্মসংশ্লিষ্ট হয়, ওসব ক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও, একপেশে হয়ে গেলে সেসব লেখা নিয়ে সন্দেহ জাগেই।
রবীন্দ্রনাথ তাই যথাযথই বলেছেন, 'অতএব বঙ্কিম যে-সকল স্থলে কৃষ্ণচরিত্র হইতে অতিপ্রাকৃত অমানুষিক অংশ বর্জন করিয়াছেন সে স্থলে কোনো ঐতিহাসিকের মনে বিরুদ্ধ তর্ক উদয় হইতে পারে না। কিন্তু যেখানে তিনি মহাভারতের একাংশের সহিত অংসগত বলিয়া কিছু পরিত্যাগ করিয়াছেন সেখানে পাঠকের মন নিঃসংশয় হইতে পারে না।'
আমরাও তাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের কৃষ্ণচরিত্র নিয়ে সংশয়মুক্ত হতে পারি না।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব