আমার আমি হয়ে ওঠা
ছবি : প্রতীকী - ছবি : সংগৃহীত
* পাকিস্তান আমলের একটি পুরোনো ট্রাঙ্ক ও আটপৌরে কালশিটে দাগ পড়া পুরোনো ব্যাগ নিয়ে ১৯৮৬ সালে জানুয়ারির শরীর হিম করা শীতের সকালে আব্বা যখন আমাকে হালুয়াঘাট বাস্ট্যান্ডে ঢাকাগামী বাসে উঠিয়ে দেয় আমার তখন একটুও খারাপ লাগেনি! এই নিত্য অভাব অনটন, ঝগড়াঝাঁটি, একে অপরের পিছনে লেগে থাকা গ্রাম্যজীবন আর আধপেটা থাকার রুটিনমাফিক চলার কাহিনীকে জয় করার নেশা ততদিনে পেয়ে বসেছে আমাকে!
* পুরো গ্রামে আমি যখন প্রথম বিভাগ নিয়ে মাধ্যমিক পাস করি, তখন আমার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমাকে বুকে জড়িয়ে নেন আনন্দের আতিশয্যে! যে স্কুলের ফার্স্ট বয়ও কোনো কোনো বছর ফেল করে ফেলে সেখানে এমন ফলাফল বিস্ময়কর বৈকি! উচ্চমাধ্যমিকে কলেজে ভর্তি হওয়ার অর্থকড়ি ছিল না ছয় সন্তানের জনক আমার আব্বার কাছে। এখানেই সমাপ্ত হতে পারত আমার শিক্ষাজীবন। কিন্তু স্কুলের হেড স্যারের সহায়তায় প্রায় বিনা বেতনেই হালুয়াঘাট ডিগ্রি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিকের বৈতরণী পাড় করি আমি। লেখাপড়ার প্রতি আমার ছিল দুর্বার আগ্রহ। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতেও মেধাবৃত্তি পেয়েছিলাম। পুরোনা রঙচটা ট্রাঙ্কে মায়ের হাতের মুড়ি-চিড়ার নাড়ু, বোনের বানানো আমের আচার, কাঁথা-বালিশ আর কয়েকটা বহুল ব্যবহারে জর্জরিত কাপড় চোপড়ই ছিল আমার সম্বল। বাসের ভাড়া ও অন্যান্য অতিরিক্ত খরচ বহন করার মতো টাকা ছিল না বলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেউ আমার সাথী হয়নি। মাঠঘাট, প্রান্তর পেড়িয়ে বাসটা আমায় নিয়ে ছুটে চলেছে স্বপ্ন পূরণের কল্পলোকে। আর হৃদয়ে এঁকে নিয়েছিলাম পিছনে ফেলে আসা পাহাড়ঘেরা নিস্তব্ধ সবুজ গ্রামের ছবি।
* কলেজের এক পরিচিত বড় ভাই ভালো ছাত্র ছিলাম বলে বেশ কদর করতেন আমাকে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়তেন, থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আল বেরুণী হলে। তার সাহায্য সহযোগিতায় আমি শুধুমাত্র ঢাবি ও জাবিতেই ভর্তি পরীক্ষা দিতে পেরেছিলাম এবং জাবিতে পদার্থবিদ্যা বিভাগে সুযোগ পেয়ে গেলাম। গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আমাদের দারিদ্র্যপীড়িত, অশিক্ষিত গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া আমিই প্রথম ছাত্র ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় কী ও সেখানে ভর্তির নিয়ম কেমন তখন অব্দি আমার গ্রামের কেউ জানতো না।
* আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হলো। আধুনিক থাকার হল ভবন, বাথরুম, কমনরুম, টিভি রুম, অনেকগুলো দৈনিক পত্রিকা, সন্ধ্যার পর ঝকঝকে বিদ্যুতের আলোয় পড়াশুনা করা, চমৎকার সিরামিক ইটের দ্বিতল একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি এসবকিছুই আমি এর আগে কখনো দেখিনি। সবই আমার জন্য নতুন। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে কেরোসিন তেল শেষ হওয়ার ভয় হতে আমি মুক্তি পেলাম। আমার অনেক সীমাবদ্ধতাই কেটে গেল। অন্য সহপাঠীদের সাথে আমি আমার বিস্তর পার্থক্যও খুঁজে পেলাম। পড়াশুনার বাইরে আমার আর কোন গুণই নেই। না কাপড়চোপড়ে স্মার্ট, না কথাবার্তায়। আমার মনে হতো জগতের সব মানুষই বুঝি ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
* ওই ভুল প্রথম দিনেই ভেঙে গেল। আমার অবশ্য এতকিছু ভাবার অবকাশ ছিল না। সবসময় চিন্তা করতাম কিভাবে আমার দুপুর আর রাতের দুই টাকা করে চার টাকা ডাইনিং খরচ যোগাড় হবে। আমি সকালে কখনো নাস্তাই করতাম না টাকার অভাবে। ক্লাস করতাম, একটু পর পর পানি পান করে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতাম আর অপেক্ষায় থাকতাম কখন দুপুর ১২.৩০ বাজবে, ডাইনিং খুলবে আর পেট ভরে ভাত-ডাল খাবো। এভাবে আমি অভ্যস্ত হয়ে যাই কয়েক দিনের মধ্যেই। বিকেলবেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক ও ডেইরি গেটে, ক্যাফেটেরিয়া, মুক্তমঞ্চে যে প্রাণবন্ত আড্ডা ও অনুষ্ঠান চলত, তাতে আমি উপস্থিত থাকতাম না বললেই চলে। এতে বন্ধুরা অসামাজিক ভাবতো আমাকে। এসব স্থানে উপস্থিত হওয়ার মতো মন বা আর্থিক সামর্থ্য কোনোটাই ছিল না আমার। সবসময় দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের হতচ্ছাড়া মুখগুলো মাথার ওপর ভেসে থাকতো।
* তবে আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার একটা গুণই আছে সেটা হচ্ছে পড়াশুনা করা। আসলে অন্যসব সীমাবদ্ধতা আমাকে পড়ার টেবিলে বসে থাকতে বাধ্য করেছে। আমি প্রথমবর্ষে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে যাই। সবাই আমার ফলাফল দেখে অবাক হয়, বিভাগে রাতারাতি পরিচিত হয়ে যাই। এরপর আমি ঢাকায় ভালো মাইনের একটা টিউশনি পাই। আমার অর্থকষ্ট ও ক্ষুধার জ্বালা দূর হয়। পড়াশুনাটাও চলতে থাকে সমানতালে। তত দিনে শিখে গেছি, এখানে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগই নেই এটাই আমার উপরে ওঠার জিয়নকাঠি। শুধুমাত্র দুই ঈদে বাড়িতে যেতাম খরচ বাচাঁনোর জন্য। চিঠি লিখতাম নিয়মিত আব্বা-আম্মা ও বোনের কাছে। টিউশনির বেতন হতে কিছু টাকা বাঁচিয়ে বাড়িতে পাঠাতাম অন্তত আমার ছোট ভাই বোন দুটি যেন ঠিকমতো পড়াশুনা করে।
* একদিন সকালে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার আমার হলে পিয়ন পাঠিয়ে আমাকে তার চেম্বারে যেতে বললেন। আমি কাল বিলম্ব না করে সাথে সাথেই চলে যাই। ওই সময়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা কম থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রায় সবাই সবাইকে চিনত, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধটাও ভালো ছিল। স্যার বিএসসি ফাইনালের ফলাফলে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার খবরটা আমাকে জানালেন। আমি আবেগে কেঁদে ফেলি! সারা বছর আমার কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দেখে স্যার বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এর ওপর একটি প্রজেক্টে আমাকে সঙ্গী করে নেন, পরে এই বিষয়ের উপর থিসিস সহকারে এমএসসি পাস করি।
* মাস্টার্স পাসের পর আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমি আমার ডিপার্টমেন্টে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। বছরখানেকের মধ্যেই আমি জাপানের কিউটো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পছন্দের বিষয় অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়েই পিএইচডি করার সুযোগ পাই। এসময় আমি বাংলা বিভাগের এক প্রফেসারের মেয়েকে বিয়ে করে জীবনসঙ্গী হিসেব পাই। আমার অর্জিত সাফল্যে আমার গ্রামের মানুষ খুব গর্ববোধ করে।
* ১৯৯৪ সালের জুন মাসে সপরিবারে জাপান চলে আসি। পিএইচডি শেষ করে আমি কিউটো বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা শুরু করি। আমার পাঠানো অর্থে গ্রামে আমাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা আসে, পিতৃপুরুষের বয়ে বেড়ানো অভাব দূর হয়। বড় ভাইদের বাজারে ব্যবসা ও ছোট ভাইবোনদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেই। গ্রামের পড়াশুনা করতে ইচ্ছুক ছেলে-মেয়েদেরকে সাহায্যের উদ্যোগ নিই। আমি সবসময় চেয়েছি সুশিক্ষার আলোকে আলোকিত হোক গ্রামের মানুষ। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির মুক্তি নেই।
* মধ্য পঞ্চাশের আমি সারাজীবন আমার সফলতাই দেখে এসেছি। আমার স্ত্রী অতিশয় সজ্জন নারী। আমার খুবই মেধাবী দুই মেয়ে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েশন করছে। এত কিছুর পরও দেশের জন্য মনটা হাহাকার করে উঠে আমার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য সূচকে অনেক উন্নতি করলেও অনেক অপূর্ণতা রয়ে গেছে আমাদের। যুগোপযোগী শিক্ষার অভাব ও শিক্ষাক্ষেত্রে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ বিশ্ব থেকে আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণায় অমনোযোগ টেকসই জাতি গঠনের অন্তরায়। রাস্তায় অসংখ্য ছিন্নমূল শিশু ও বৃদ্ধ মানুষকে হাত পেতে ভিক্ষা করতে দেখে আমি পীড়িত হই। বিস্তর দুর্নীতি, নির্বিচারে পরিবেশ দূষণ ও অপরিকল্পিত নগরায়ন আমাদের অস্তিত্বকেই হুমকির মূখে ফেলেছে। এত প্রতিকূলতার পরও দেশ এগিয়ে যাবে এমন আশায় আমি বুক বাঁধি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নির্মল পরিবেশে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে সেই স্বপ্নই দেখি অহর্নিশ।
(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)