যুক্তরাষ্ট্রকে কোন দিকে নিয়ে যাবেন বাইডেন?
বাইডেন - ছবি সংগৃহীত
আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ১০০ দিনের হানিমুনকাল ফুরিয়ে আসছে। বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের আগে ও পরে তার প্রশাসনের সম্ভাব্য নীতি ও পদক্ষেপ নিয়ে দেশটির ভেতরে বাইরে বিপুল আলোচনা ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে পরিচালিত নিউ পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ অনুসারে, বিদেশনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ আমেরিকান বাইডেনের ওপর আস্থা রেখেছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম বছরে দায়িত্ব পালনকালে তার পক্ষে এই সমর্থন ছিল ৪৬ শতাংশ।
গত ৩ মার্চ বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন নতুন মার্কিন প্রশাসনের বৈদেশিকনীতি পদক্ষেপ কী হবে তার সারমর্ম তুলে ধরেছেন। জো বাইডেন ’৮০ বা ’৯০ এর দশকের আমেরিকাকে ফিরিয়ে আনার যে কথা বলে আসছিলেন, তার ধারণাগত রূপরেখা তুলে ধরেছেন ব্লিংকেন। বাইডেনের নেতৃত্ব আমেরিকায় ট্রাম্পের মতো আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। ৫ মেয়াদে ৩০ বছর তিনি ছিলেন সিনেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ওবামা প্রশাসনের ৮ বছরের শাসনকালে অতিসক্রিয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জো বাইডেন। আমেরিকান ডিপ স্টেট বা ক্ষমতা বলয়ের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এক ব্যক্তি মনে করা হয় তাকে।
এসব কারণে এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ক্ষমতা গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটা চ্যালেঞ্জ বাইডেনকে জয় করতে দেখা গেছে ঠাণ্ডা মাথায়। বাইডেনের পররাষ্ট্র কৌশলেও এর প্রভাব থাকবে বলে ধারণা করা হয়। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ও প্রাথমিক কার্যক্রমে এক ধরনের গভীরতা এবং আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি ডকট্রিন বা মতবাদের প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে বলে মনে হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন তার বক্তব্যে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে আটটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। সবশেষে রাষ্ট্রভিত্তিক চ্যালেঞ্জগুলোও তিনি উল্লেখ করেছেন যার মধ্যে ইরান, রাশিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইথিওপিয়া ও ইরাকের পাশাপাশি উল্লেখ রয়েছে চীনের। বলা হয়েছে, আমেরিকার কাক্সিক্ষত বিশ্বব্যবস্থার সামনে চীন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এটিও বলা হয়েছে, যেখানে প্রয়োজন হবে সে ক্ষেত্রে চীনের সাথে আমেরিকার হবে প্রতিযোগিতা, যেখানে সুযোগ থাকবে সেখানে হবে সহযোগিতা আর যেখানে অনিবার্য হয়ে উঠবে, সেখানে হবে সঙ্ঘাত। এই নীতিনির্ধারণী বক্তব্যে কোনো একক দেশের সাথে সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোকপাত করা হয়েছে চীনকে ঘিরে।
আমেরিকার পররাষ্ট্র সম্পর্কের রূপরেখার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার দিকে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ঐতিহ্যগত মিত্রদের সাথে মিলিতভাবে কাজ করবে। লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্লিংকেন বাইডেনের যে আটটি বিদেশনীতি অগ্রাধিকারের কথা উল্লেখ করেছেন যার মধ্যে রয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারী বিস্তারের ইতি ঘটানো, দেশে ও বিদেশে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা; গণতন্ত্রকে পুনঃজাগরিত করা; অভিবাসন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা; জোটগুলোকে পুনর্গঠন করা; জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবেলা করা; প্রযুক্তিতে মার্কিন নেতৃত্বের সুরক্ষা বিধান করা; আর চীনকে মোকাবেলা করা।
ব্লিংকেন ‘ব্যয়বহুল সামরিক হস্তক্ষেপ’ এড়াতে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর একটি নতুন অধ্যায় তৈরির প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছেন। ব্লিংকেন বারবার রাষ্ট্রপতি বাইডেনের বৈদেশিক নীতিকে দেশীয় নীতির সাথে যুক্ত করার ইচ্ছার ওপর জোর দিয়েছেন। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই সব আমেরিকান টিকা দেয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী টিকা দেয়ার প্রচেষ্টায় অর্থায়নের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
ব্লিংকেন তার বক্তব্যের শেষ অংশে বেইজিংকে মোকাবেলা করার কথা বলে উল্লেখ করেন যে, চীন এই শতাব্দীর মার্কিন ‘বৃহত্তম ভূ-রাজনৈতিক পরীক্ষা’। তিনি চীনকে ‘স্থিতিশীল এবং উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জ করার জন্য অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তিসম্পন্ন একমাত্র দেশ’ বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ব্লিংকেনের একই সুরে চীনকে বর্ণনা করে ‘অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলগত গাইডেন্স’ প্রকাশ করেছে। তবে ব্লিংকেনের বক্তব্য বা অন্তর্বর্তীকালীন গাইডেন্স রিপোর্টে চীন সম্পর্কে একবারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা হয়নি।
বাইডেন প্রশাসন চীনকে সংজ্ঞায়িত করতে যে পদ ব্যবহার করেছে সেটি চীনা নীতির বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের চিন্তাধারার উত্তরাধিকার বলে মনে হতে পারে। তবে নতুন প্রশাসন চীনকে মোকাবেলা করার জন্য সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বন করবে বলে মনে হয় না। নতুন প্রশাসন তার পূর্বসূরির থেকে আলাদা কোন ক্ষেত্রে, সেটি ‘শর্তসাপেক্ষে চীনের সাথে সহযোগিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ এবং প্রকাশ্যে চীনের সাথে সর্বাত্মক , দ্বন্দ্বে জড়ানোর ব্যাপারে অনীহা’ থেকে স্পষ্ট হয়েছে।
চীনের সরকারি মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসের মতে, ট্রাম্প প্রশাসন চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী ও অহঙ্কারী ছিল এবং চীনের সাথে তার যোগাযোগের উপায় ছিল চীনকে যতটা সম্ভব ব্ল্যাকমেইল করা। বাইডেন প্রশাসন স্পষ্টতই বুঝতে পারছে যে ট্রাম্পের পথটি কার্যকর হয়নি। তারা চীনের সাথে একটি সিস্টেমেটিক খেলায় জড়িত হওয়ার চেষ্টা করতে চলেছে যাতে মিত্রদের ওপর আরো নির্ভর করে চীনকে লক্ষ করে আন্তর্জাতিক মেরুকরণ শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা থাকতে পারে।
চীনের প্রতি এ পদ্ধতি তিনটি বার্তা প্রকাশ করে। প্রথমত, রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের পরে, ওয়াশিংটন চীন-মার্কিন সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার জন্য তার অভ্যন্তরীণ একত্রকরণ সম্পন্ন করেছে। চীনকে একটি ‘কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে দেখার ব্যাপারে তাদের অবস্থানকে একীভূত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাইডেন প্রশাসন বুঝতে পেরেছে যে, চীনকে পরাস্ত করা বাস্তবসম্মত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে মোকাবেলা করার জন্য এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যাতে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে তার সুবিধা বজায় রাখতে পারে। তৃতীয়ত, বর্তমান সরকার তার জোট পদ্ধতি শক্তিশালীকরণসহ মার্কিন শক্তি অক্ষ তৈরির বিষয়ে আরো বেশি জোর দিচ্ছে।
এ কথা ঠিক, আলোচনার মাধ্যমে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা উপশমের জন্য জায়গা খুব সঙ্কীর্ণ বলে মনে হচ্ছে, তবে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের সম্ভাবনাও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি দীর্ঘমেয়াদি খেলায় জড়িত হবে, যেখানে সব ডোমেইনের ওপর চাপ দেয়া হবে। যে পক্ষ শক্তি গঠনের ক্ষেত্রে আরো বেশি অর্জন করবে, সে পক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যতের প্রবণতাকে প্রভাবিত করতে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়াবে।
বাইডেন প্রশাসন কার্যত তার পূর্বসূরির অবিচ্ছিন্নভাবে ‘চীনকে চূর্ণ’ করার প্রয়াসকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছে এবং চীনকে চাপ দেয়ার বিষয়ে তার কৌশলটি পুনর্গঠন করেছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চালু করা বাণিজ্য যুদ্ধের চাপকে সহ্য করা এবং নিজস্ব শক্তি বাড়ানোর চীনা প্রচেষ্টা থেকে এসে থাকতে পারে। জাতীয় শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে চীনের সম্প্রসারণ অনুধাবন করে এবং চীনকে মোকাবেলায় মিত্রদের শক্তিশালী করার ওয়াশিংটনের পরিকল্পনাকে হতাশ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন রাউন্ড সংজ্ঞায়িত করার জন্য বেইজিং নতুন কৌশল নিতে পারে।
মার্কিন নতুন প্রশাসনের মহা উচ্চাভিলাষ এবং বড় বড় আলোচনা সত্ত্বেও, এই ধরনের লক্ষ্য অর্জনের বিষয় কোনোভাবেই নিশ্চিত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করার পদ্ধতিটি পুরনো এবং বর্তমানে এ ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক গতি তৈরি করা কঠিন। মার্কিন মিত্রদের দিয়ে চীনকে মোকাবেলা করার মতো অবস্থানে ওয়াশিংটন কতটা রয়েছে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনকে শক্তিশালীভাবে মোকাবেলা করার প্রয়োজন অনুভব তার মিত্রদের ততটা করছে বলে মনে হয় না।
ভারত ছিল এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত মিত্র। প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা জোট ‘কোয়াড’ গঠনের মাধ্যমে চীনের চার পাশে বেইজিংকে নিয়ন্ত্রণ করার এক আমেরিকান উদ্যোগ ছিল এটি। দিল্লি এখন কোয়াডের চেয়েও পুরনো ব্রিকসের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে মনে হয়। ভারত ২০২১ সালে ‘ব্রিকস’ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ হচ্ছে। আর ব্রিকস ২০২১ শীর্ষ সম্মেলনের হোস্টিংয়ে ভারতকে সমর্থন জানিয়েছে চীন। এর মাধ্যমে সঙ্গতভাবে ভারতের সাথে চীন, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ব্রাজিলের সম্পর্ক গতি লাভ করবে; ব্রিকস ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ ও ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এর সাথে দিল্লির সম্পৃক্ততা বাড়বে।
চীন জানিয়েছে যে, তারা ব্রিকসের উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচ সদস্যের গ্রুপের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে নয়াদিল্লির সাথে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভারত ২০২১ সালের জন্য ব্রিকসের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলার সময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেছেন, ‘আমরা এই বছরের বৈঠকে ভারতের ব্রিকস সম্মেলনের স্বাগতিক হওয়াকে সমর্থন করি এবং সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ ও সংলাপ জোরদার করতে আর ব্রিকসের অধীনে সহযোগিতার সম্প্রসারণ ও এর মাধ্যমে বৃহত্তর অগ্রগতির জন্য কাজ করব। এর সাথে সাথে চীন অন্য সদস্যদের সাথেও কাজ করবে যা কোভিড-১৯ কে পরাস্ত করতে বিশ্বকে সহায়তা করবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরায় চালু করতে সহায়ক হবে এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে।’
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত মিত্র দেশ হলো, ইসরাইল, সৌদি আরব ও তুরস্ক। ইরান ইস্যুকে কেন্দ্র করে সব মিত্রের সাথে এক ধরনের অবিশ্বস্ততা তৈরি হয়েছে ওয়াশিংটনের। ন্যাটোমিত্র হওয়া সত্ত্বেও আঙ্কারার প্রবল সন্দেহ হলো কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পিকেকেকে দিয়ে তুরস্কের ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কোনো কিছু করতে চাইছে ওয়াশিংটন। ২০১৬ সালের এরদোগানের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র্রের ইন্ধন ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। এ সময় বাইডেন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তুরস্কে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শাসন পরিবর্তনে সচেষ্ট হবেন বলে উল্লেখ করেছিলেন বাইডেন। এখন পর্যন্ত এরদোগানের সাথে ফোনালাপ করেননি বাইডেন। বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে নীরব বার্তা দিতে চাইছেন তিনি।
সব কিছু মিলিয়ে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র্রের সম্পর্কে এক ধরনের অবিশ্বাসের ছায়া রয়েছে। একই অবস্থা মার্কিন-সৌদি সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। মোহাম্মদ বিন সালমানকে পরোক্ষভাবে খাশোগি হত্যার জন্য দায়ী করে গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশ এবং ইয়েমেনের আনসারুল্লাহকে ‘সন্ত্রাসী’ তালিকা থেকে বাদ দেয়ার উদ্যোগ আর ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে আসার কথাবার্তা সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র্র সম্পর্ককে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে বাইডেনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। ইসরাইলের নির্বাচনে আবার নেতানিয়াহু সরকার গঠন করলে নতুন করে টানাপড়েন দেখা দিতে পারে। সব মিলিয়ে যেসব পরিকল্পনার কথা ব্লিংকেন বলছেন, তার গতি কত দূর কোনমুখী হয়ে দাঁড়ায়, মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
গ্লোবাল টাইমসে বলা হয়েছে, আমেরিকার নতুন নীতির পরিপ্রেক্ষিতে চীনকে তার সংস্কার এবং এগিয়ে যাবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে আর নির্ধারিত সূচি অনুসারে তার ১৪তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০২১-২৫) এগিয়ে নিতে হবে। চীনকে কাজ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তেজনা লাঘব করার জন্য। এটি করার মাধ্যমে, চীন কৌশলগতভাবে স্বাচ্ছন্দ্যযুক্ত মানসিক সেট তৈরি এবং ইন্টারঅ্যাক্ট করার জন্য আরো বেশি সুযোগ পাবে। মার্কিন প্রবণতার বিরুদ্ধে গিয়ে এই জাতীয় কৌশলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চীন নিয়ন্ত্রণের কৌশলকে দুর্বল করা বেইজিংয়ের জন্য সহজ।
চীনা নীতিনির্ধারকদের পর্যবেক্ষণ হলো, এখন সময় এসেছে যে, চীনা জনগণের তাদের নিজস্ব কাজ আরো ভালো করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। চীনকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্য দিকে চীন কিভাবে নিজের বিকাশ করবে সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করছে। এটি স্পষ্ট, যার নকশা নির্ভুল ও আরো ভালোভাবে প্রয়োগ করা যাবে তার পক্ষে জয় আসবে।
আমেরিকান সামাজিক বাস্তবতার প্রভাবও অনিবার্যভাবে বৈদেশিক নীতিতে পড়বে। আমেরিকান সমাজে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ হচ্ছে। ডেমোক্র্যাট, কৃষ্ণাঙ্গ, সাদা, লাতিনো, সংখ্যালঘু, মুসলমান, বামপন্থী প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৃহৎ জোট বাইডেনকে সমর্থন করেছিল, তবে সমাজের একটি শক্তিশালী সাদা-অধ্যুষিত অংশ তার শক্তি সুসংহত করেছে এবং ভবিষ্যতে আরো সক্রিয় ভূমিকার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটি করবেন কিভাবে, সেটি হবে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথমত, বাইডেন প্রশাসনকে আমেরিকার রাজনীতিকে স্বাভাবিক করতে হবে। অন্য কথায়, বাইডেনকে ঐতিহ্যবাহী আমেরিকান সামাজিক কাঠামো আর সহিষ্ণু আমেরিকান সমাজ ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন একটি উচ্চ ধরনের রাজনৈতিক এবং মেরুকৃত আমেরিকান সমাজ তৈরি হয়ে আছে। সমাজ যত বেশি রাজনীতিকায়িত হয়, তত বেশি দাবি ওঠে এবং ঘরোয়া রাজনৈতিক আবহাওয়া তত সংবেদনশীল হয়।
ব্লিংকেনের বক্তব্যেও স্পষ্ট যে, এখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারকে আগের তুলনায় ঘরোয়া রাজনীতিতে আরো বেশি শক্তি ব্যয় করতে হবে। এটি এই কারণে যে, আমেরিকান সমাজের বিভিন্ন অংশকে নানা উদ্যোগে সম্মত করা সরকারের পক্ষে আরো কঠিন হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয়ত, বাইডেন প্রশাসনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আবার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে এবং এর ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের জোটে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে বাইডেন সরকারের পক্ষে এটি এত সহজ হবে না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের ফিরিয়ে আনতে অতিরিক্ত প্রচেষ্টা চালানো দরকার এই কারণে যে, যুক্তরাষ্ট্রকে তার মিত্রদের বোঝাতে হবে- সে তাদের আর ছেড়ে যাবে না এবং তাদের একটি অভিন্ন হুমকি রয়েছে।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী আমেরিকান মিত্ররা তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং হুমকির সংজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে আলাদাভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। বিশ্বের বর্তমান উন্নতি সম্পর্কে ‘প্রথম বিশ্ব’ এর সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্য নেই। তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং হুমকির সংজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকারগুলো পরিবর্তন হতে শুরু করে। বর্তমান সমস্যাগুলো তাদের বহুমুখী নীতির পরিবর্তে বিভিন্ন নীতি অনুসরণ এবং জাতীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নেতৃত্ব দেয়।
বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এটি স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাঠামো নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং বৈশ্বিক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আর যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অংশীদারদের স্বার্থকে আগের মতো প্রতিনিধিত্ব করে না। এই সংস্থাগুলোতে সময়ের সাথে সাথে মার্কিন আপেক্ষিক প্রভাব হ্রাস পেয়েছে, আর চীনের মতো চ্যালেঞ্জকারী রাষ্ট্রগুলোর শক্তি ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সব মিলিয়ে, যদি বাইডেন প্রশাসন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর হয় তবুও এই পরিবর্তিত অবস্থার অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তার পুরনো হেজিমোনিক অবস্থানটি ফেরানো খুব কঠিন হবে।
অনেক রাষ্ট্র ইতোমধ্যে মার্কিন প্রভাবকে নমনীয় ও ভারসাম্যপূর্ণ করতে শুরু করেছে; চীন এবং রাশিয়ার মতো কিছু বৈশ্বিক শক্তি তাদের কঠোর শক্তি ব্যবহার করে আমেরিকান আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রায় প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। ইরান, ভারত ও তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোও নিজ নিজ এলাকায় স্বতন্ত্রভাবে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে আমেরিকার প্রত্যাবর্তন বেশ কঠিন হতে পারে বাইডেনের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি নিয়মতান্ত্রিক খেলায় ফিরে আসতে সক্ষমও হয়, তবুও মাঠের বাস্তব পরিস্থিতি একই না-ও থাকতে পারে এবং খেলার নিয়মগুলোও পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।
mrkmmb@gmail.com