মেরাজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য
মেরাজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য - ছবি সংগৃহীত
আল্লাহ তায়ালা মহাক্ষমতার অধিকারী। তিনি তাঁর অপার ক্ষমতা বলে গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ, জমিন, চন্দ্র, সূর্য, গাছ-পালা, নদ-নদী ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন। হজরত আদম আ:-কে পিতা-মাতা ছাড়া, হজরত ঈসা আ:-কে পিতা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন। সমগ্র পৃথিবীর ক্ষমতাধর নমরুদ, বখতে নাসার, শাদ্দাদ প্রমুখকে, জগদ্বিখ্যাত ধনী কারুন, আদ, সামুদ ইত্যাদি জাতিকে ধ্বংস করেছেন। মহানবী সা:-এর মেরাজও আল্লাহ তায়ালার অপার কুদরতের একটি মহানিদর্শন। অনুরূপ মেরাজ মুমিনের বিশ্বাসের অগ্নিপরীক্ষা। আল্লাহ তায়ালা এই মেরাজের মাধ্যমে মুমিনকে পরীক্ষা করেছেন যে, তারা এই আশ্চর্য ঘটনাটি বিশ্বাস করে কি না। এই ঘটনাটি আশ্চর্য বলেই আল্লাহ তায়ালা ‘সুবহানা’ শব্দ দিয়ে বর্ণনা করেছেন।
ইসরা ও মেরাজের মধ্যে পার্থক্য : ইসরা অর্থ- নৈশভ্রমণ, রাত্রিকালীন ভ্রমণ। আর মেরাজ অর্থ- সিঁড়ি, ঊর্ধ্বলোকে গমন, সোপান, মই। মেরাজ তথা ঊর্ধ্বলোকে গমনের কথা হাদিস দ্বারা আর ইসরা তথা নৈশভ্রমণের কথা কুরআন মজিদ দ্বারা প্রমাণিত।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- তিনি পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাহকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত; যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সূরা বনি ইসরাঈল-১)
মেরাজ সঙ্ঘটিত হওয়ার সময় : মেরাজ কখন সঙ্ঘটিত হয় এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। হজরত মুসা ইবন ওকবা রা: থেকে বর্ণিত আছে যে, মেরাজের ঘটনা হিজরতের ছয় মাস পূর্বে সঙ্ঘটিত হয়। ইমাম নববী ও কুরতুবির মতে মেরাজের ঘটনা মহানবী সা:-এর নবুওয়তপ্রাপ্তির পাঁচ বছর পরে ঘটেছে। ইবন ইসহাক বলেন, মেরাজের ঘটনা তখন ঘটেছিল, যখন ইসলাম আরবের সমস্ত গোত্রে ছড়িয়ে পড়ে ছিল। হরবি বলেন, ইসরা ও মেরাজের ঘটনা রবিউস সানি মাসের ২৭ তারিখ রাতে হিজরতের এক বছর পূর্বে ঘটেছিল (মায়ারিফুল কুরআন, আর রাহিকুল মাখতুম)।
ঊর্ধ্ব গমন : বায়তুল মাকদাসে দু’রাকাআত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামাজ আদায় করার পর সিঁড়ি আনা হয়, যাতে নিচ থেকে উপরে যাওয়ার জন্য ধাপ বানানো ছিল। তিনি সিঁড়ির সাহায্যে প্রথমে প্রথম আকাশে, অতঃপর অবশিষ্ট আকাশসমূহে গমন করেন। এ সিঁড়িটি কী এবং কিরূপ ছিল, তার প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তায়ালাই জানেন। প্রত্যেক আকাশে সেখানকার ফেরেশতারা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান এবং প্রত্যেক আকাশে অবস্থানরত পয়গম্বরগণের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। প্রথম আকাশে হজরত আদম আ:-কে, দ্বিতীয় আকাশে হজরত ইয়াহিয়া ও ঈসা আ:-কে তৃতীয় আকাশে হজরত ইউসুফ আ:-কে, চতুর্থ আকাশে হজরত ইদ্রিস আ:-কে, পঞ্চম আকাশে হজরত হারুন আ:-কে, ষষ্ঠ আকাশে হজরত মুসা আ:-কে এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইব্রাহিম আ:-কে দেখতে পান।
আল্লাহর নিকট গমন : তিনি আল্লাহর তায়ালার এত কাছাকাছি পৌঁছেন যে, উভয়ের মধ্যে দু’টি ধনুক বা তারও কম ব্যবধান ছিল। (সূরা আন-নাজম ৮-১০)। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যা কিছু দেয়ার তা দেন, যা ইচ্ছা প্রত্যাদেশ করেন এবং পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন। ফেরার পথে হজরত মুসা আ:-এর সাথে দেখা হলে তিনি জিজ্ঞেস করেন আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কী কাজের আদেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের আদেশ করেছেন। হজরত মুসা আ:-বলেন, আপনার উম্মত এত নামাজ আদায় করতে পারবে না। আপনি কমিয়ে আনুন। অত:পর কয়েকবার গিয়ে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করেন। আরো দান করেন সূরা বাকারার শেষ দু’আয়াত এবং শিরকমুক্ত ব্যক্তির জন্য ক্ষমার ঘোষণা।
আল্লাহ তায়ালাকে দেখেছেন কি না : ইমাম ইবন তাইমিয়া বলেন, মহানবী সা: আল্লাহ তায়ালাকে চোখে দেখার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কোনো সাহাবিও এ কথা বর্ণনা করেননি। সূরা আন নজমে যাকে দেখার কথা বলা হয়েছে তিনি হলেন হজরত জিবরাঈল আ:। মহানবী সা: দ্বিতীয়বার সিদরাতুল মুনাতাহার কাছে তাঁকে আসল আকৃতিতে দেখেছেন। হজরত জিবরাঈল আ:-কে তার আসল চেহারায় রাসূল সা: দু’বার দেখেছেন। একবার পৃথিবীতে, আরেকবার সিদরাতুল মুনাতাহার নিকট। (যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড, পৃ-৫৭)
মেরাজ কি সশরীরে হয়েছে না আত্মিক হয়েছে : মহানবী সা:-এর মেরাজ সশরীরে হয়েছে। তাঁর দেহ ও আত্মা উভয়ই মেরাজে গমন করেছে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা প্রিয়নবী সা:-এর মেরাজ গমনকে তাঁর এক বিশেষ মুজিজা হিসেবে গুরুত্বসহকারে কুরআন মজিদে বর্ণনা করেছেন। যদি মেরাজ গমন কেবল আত্মিক ও রুহানিভাবে হতো, তবে তা তার মুজিজা হতো না। কেননা মুজিজা কখনো গাইরে নবী থেকে প্রকাশ পেতে পারে না। অথচ বেহেশত, দোজখ, আরশ, কুরসি পর্যন্ত কোনো কোনো আউলিয়াও আত্মিকভাবে সফর করতে পারেন। অবশ্য কোনো অলি সশরীরে তথায় গমন করতে পারেন না। সুতরাং মেরাজ গমনকে সশরীরে সংঘটিত হয়েছে বলে স্বীকার করলেই তা মুজিজা হিসেবে গণ্য হয়। কুরআন মজিদে বর্ণিত আয়াতের শব্দের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, মহানবী সা:-এর মেরাজ গমন সশরীরেই সঙ্ঘটিত হয়েছিল। যেমন- সমস্ত দুর্বলতার থেকে পবিত্র ওই আল্লাহ, যিনি নিজের (সর্বশ্রেষ্ঠ) ‘আবদ’কে অর্থাৎ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। এখানে বিশ^নবীর নাম মোবারকের স্থলে আল্লাহর বিশেষ আবদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মহানবীর একটি বিশেষণ। ‘আবদ’ শব্দের অর্থ হলো বান্দা, এই আবদ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ইবাদত থেকে। ইবাদত অর্থ বন্দেগি। যেকোনো বিশেষণের দ্বারা দু’টি জিনিস বুঝা যায়। একটি হলো বিশেষ্য আর একটি হলো বিশেষ্যের গুণ। সুতরাং আবদ শব্দের অর্থ হবে ওই ব্যক্তি যে ইবাদত করে, আর যার ওপর ইবাদতের দায়িত্ব নেই এবং যে ইবাদত করে না এমন ব্যক্তিকে আবদ বলা যায় না।
এখন আমাদের দেখতে হবে, ইবাদতের দায়িত্ব কি একা আত্মার ওপর অর্পিত হয়, না একা শরীরের ওপর, নাকি আত্মা ও শরীর উভয়ের সমষ্টির ওপর? এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, আত্মিক বা রুহানি জগতে যেখানে কেবল আত্মাই ছিল, দেহ ছিল না, ফলে সেখানে মানুষের ওপর কোনো প্রকার ইবাদতের দায়িত্ব ছিল না। আবার দৈহিক জগতে দেহ থেকে রুহ বের হওয়ার পর ওই রুহবিহীন দেহের ওপরও কোনো প্রকার ইবাদতের হুকুম আসে না। অতএব, এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, রুহবিহীন দেহ আবদ নয় এবং দেহবিহীন রুহও আবদ নয়। বরং আবদ হতে হলে রুহ ও দেহ দু’টিই সম্মিলিতভাবে থাকতে হয়। কাজেই মেরাজের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা যখন আপন ‘আবদ’কেই নিয়ে গেছেন বলে উল্লেখ আছে, তখন প্রমাণিত হয়েছে যে, রুহ ও দেহ উভয়কেই নিয়ে গেছেন।
মুমিনের বিশ্বাসের অগ্নিপরীক্ষা : মিরাজের ঘটনা থেকে মুমিন খুঁজে পায় সঠিক পথের দিশা, লাভ করে আল্লাহর অপার অনুগ্রহ ও দ্বীনের অবিচলতা। আমাদের প্রিয়নবী সা: যে আল্লাহ তায়ালার নিকট কত দামি ও মর্যাদার অধিকারী এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। তাঁকে এমন মর্যাদা দান করা হয়েছে যা অন্য কোনো নবীকে দান করা হয়নি। এ ঘটনার ফলে মুমিনের ঈমান মজবুত হয় এবং হৃদয়ে বিশ^নবী সা:-এর ভালোবাসা সুগভীর হয়। বিশ্বনবী সা:-এর মেরাজের ঘটনায় মানবজাতির জন্য রয়েছে আল্লাহর মহিমা ও কুদরতের অপূর্ব নিদর্শন এবং মুমিনের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। এক রাতের মধ্যে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ, যার দূরত্ব চল্লিশ দিনের রাস্তা, সেখান থেকে সাত আসমান ভেদ করে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ, আল্লাহ তায়ালার সাথে কথোপকথন, জান্নাত ও জাহান্নাম দেখা অদ্ভুদ বিষয়। তা মুমিনদেরকে ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়।
তাফসিরে কাশশাফ গ্রন্থকার বলেন, মেরাজের ঘটনাটি মহানবী সা: সর্বপ্রথম স্বীয় ফুফু উম্মেহানি বিনতে আবু তালেবকে বললে তিনি বলেন, আপনি কুরাইশদের কাছে এ বিষয়টি বলবেন না। রাসূল সা:-বলেন, অবশ্যই আমি বলব। অতঃপর মসজিদে হারামে গিয়ে আবু জেহেলকে তা বলেন। আবু জেহেল ডেকে বলে হে কুরাইশগণ! অতঃপর তারা একত্রিত হলে সে হাসতে লাগল এবং মিরাজের ঘটনা বলে উপহাস করতে থাকে। (নিবরাস-২৯৩ পৃষ্ঠা) হজরত আবু বকর ছিদ্দিক রা: যখন মেরাজের ঘটনা শুনতে পান তখন সোজা প্রিয় নবী সা:-এর নিকট গমন করে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি কুরাইশদের কাছে এ রাতে বায়তুল মাকদাসে যাওয়ার কথা বলেছেন?
তিনি বলেন, হ্যাঁ! হজরত আবু বকর রা: বলেন, তাহলে আপনি তাদের মসজিদটির বর্ণনা দিন। হজরত হাসান রা: বলেন, তখন রাসূল সা:-এর সামনে বায়তুল মাকদাস তুলে ধরা হলে তিনি দেখে দেখে বর্ণনা দিতে থাকলে আবু বকর সিদ্দিক রা: বলেন- আপনি সত্য বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল। এভাবে রাসূল সা: মসজিদটির পূর্ণ বর্ণনা দিতে থাকেন, আর আবু বকর রা: সাথে সাথে বলতে থাকেন- আপনি সত্য বলেছেন। অবশেষে রাসূল সা: আবু বকর রা:-কে বলেন হে আবু বকর ‘তুমি সিদ্দিক’। সেদিন হতে আবু বকর রা: সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত হন। (সীরাতুন্ নবী সা: ইবনে হিশাম)
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী