পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন : মরিয়া বিজেপির সর্বগ্রাসী কৌশল
মোদি ও মমতা - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানভা নির্বাচন চলতি মাসেই শুরু হচ্ছে। এবারের নির্বাচন আট ধাপে হবে। ২৭ মার্চ ভোট গ্রহণ শুরু হবে, চলবে এপ্রিল পর্যন্ত। ২ মে ফল প্রকাশ হবে। কয়েক ধাপে নির্বাচন হওয়ার ঘটনা এবারেই প্রথম। তৃণমূল সুপ্রিমো ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দাবি করেছেন, 'যে সব জেলায় তৃণমূলের প্রভাব বেশি, ওই সব জেলায় দুই থেকে তিন পর্বে ভোট করা হচ্ছে।'
নির্বাচনকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস, বামদল ও ফুরফুরা শরীফের পীরজাদার দল আইএসএফ (ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট)- মিলে সংযুক্ত মোর্চা গঠিত হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিজেপির শীর্ষ নেতা অমিত শাহ বেশ কয়েকবার কলকাতা সফর করেছেন। ৭ মার্চ বিগ্রেড প্যারেড ময়দানে নরেন্দ্র মোদি সমাবেশ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, 'লোকসভা নির্বাচনে দিদির দল হাফ হয়েছিল, এবার বিধানসভা নির্বাচনে সাফ হয়ে যাবে।’
এবারের নির্বাচনের মূল লড়াই বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যেই হবে। কংগ্রেস ও বাম দল এই নির্বাচনে থাকলেও উত্তাপ ছড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল সিপিএম- ফরোয়ার্ড ব্লক। কংগ্রেসও অনেক দিন শাসন করেছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, 'দল দুটি শক্তিশালী না থাকায় মানে শক্ত বিরোধী অবস্থান নিশ্চিত করতে না পারায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপির প্রবেশ ঘটেছে।'
২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে ভারত রাষ্ট্রের বিস্তৃতি। এর মধ্যে বর্তমানে ১৭টিতে ক্ষমতায় আছে বিজেপি। এবার পশ্চিমবঙ্গকে হাতে নিতে হেন কাজ নেই বিজেপি করছে না। এর পিছনে রাজনৈতিক শক্তিমত্তা প্রদর্শনের চেয়ে বিজেপির আদর্শিক দিকটাও মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
অন্যদিকে, ২০২১ সালে পশ্চিম্বঙ্গ ছাড়াও তামিলনাড়ু, কেরালা, পণ্ডিচেরি ও আসামে বিধানসভা নির্বাচন হবে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যতটা তৎপর অন্য রাজ্যে ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয় আছে। এর পিছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। চার রাজ্যের মধ্যে একমাত্র আসাম ছাড়া বাকি তিনটিতে বিজেপি এখনো সেইভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আসাম বিজেপির দখলেই আছে। কংগ্রেসকে হটিয়ে এই প্রদেশে এখন বিজেপি বেশ শক্তিশালী।
তামিলনাড়ুতে বিজেপির জোটসঙ্গী এডিএম ক্ষমতায় আছে। অন্য দুই রাজ্যের মধ্যে পণ্ডিচেরি এখনো কংগ্রেসের দখলেই আছে। কেরালায় বাম ও কংগ্রেসই প্রধান দুই শক্তি। সম্প্রতি শেষ হওয়া কেরালার স্থানীয় নির্বাচনেও বিজেপি ভালো করেনি। বুঝতে বাকি থাকে না এই রাজ্যগুলোতে কেন বিজেপি এতটা নীরব।
বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ জয়ের সম্ভাবনা প্রবল না হলেও একেবারে যে নেই তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। সর্বশেষ ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩টি আসন পেয়েছিল। এর আগে এখানে বিজেপির আসন ছিল শূন্য। জানিয়ে রাখি,পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় মোট আসন ২৯৪টি। পরিসংখ্যান দেখে মনে হতেই পারে এমন অবস্থা নিয়ে কিভাবে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বধের স্বপ্ন দেখে?
মূলত, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আশাবাদী করে তুলেছে। এই নির্বাচনে বিজেপি ৪০-৪১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ৪২ আসনের মধ্যে ১৮টি আসন দখল করেছিল। এর আগের নির্বাচনে বিজেপির আসন ছিল মাত্র ২টি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি গোটা রাজ্যে মেরে-কেটে ৩০ শতাংশ বুথে পোলিং এজেন্ট বসাতে পেরেছিল। এরপরও ১৮টি আসন তাদের দখলে আসে।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ বলে দেয় পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির পদ্ম ফুল ফুটতে শুরু করেছে। এই পদ্ম ফুল ফোটা কি কমে যাবে? তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ২ মে পর্যন্ত। এই দিন বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হবে।
এখানে মনে করিয়ে দেই, ভারতের সরকারব্যবস্থা 'আধা যুক্তরাষ্ট্রীয়'। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল একাধিক রাজ্য সরকার নিয়ে গঠিত। ভারতের কেন্দ্রীয় পার্লামেট দুই কক্ষবিশিষ্ট। এক. উচ্চকক্ষ-রাজ্যসভা, দুই. নিম্নকক্ষ- লোকসভা। প্রাদেশিক পরিষদেরও দু'টি ভাগ রয়েছে। এক. বিধান পরিষদ, দুই. বিধানসভা।
এখন লোকসভা নির্বাচনে ভালো করলেই কোনো দল বিধানসভা নির্বাচনেও ভালো করবে এমন কোনো কথা নেই। শাসক দল বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে ভালো করে পরে একই জায়গায় বিধানসভা নির্বাচনে খারাপ করেছে এমন নজিরও আছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিজেপি আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কোন কোন নেতা প্রচার অভিযানে অংশ নিবেন তার তালিকাও করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি সভা করবেন অমিত শাহ। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সভা করেছেন। কোচবিহার ও ঠাকুরনগরের জনসভায় বলেছেন, 'বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসলে সীমান্ত দিয়ে মানুষ তো দূরে থাক, একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না দেখে নেবেন।'
এখানে তিনি যে বাংলাদেশকে উল্লেখ করেছেন তা স্পষ্ট৷ কিন্তু অমিত শাহের বক্তব্যের কিছু দিন আগেই পশ্চিমবঙ্গের পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লিখিত জবাবে জানায় '২০১৬ সাল থেকে পরের পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের ঘটনা বিপুল হারে কমেছে।' অমিত শাহ যে উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে উস্তাদ এটা জানা কথা। সামনে হয়তো এমন আরো কথা শোনা যাবে। তিনি কখনো বাউল, কখনো কৃষকের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন করে আলোচনায় সরগরম থাকছেন।
অমিত শাহের বাইরে প্রচারণায় অংশ নেবেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগত প্রকাশ নাড্ডা, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথ। থাকবেন স্মৃতি ইরানি। কেন্দ্রীয় এই নেত্রী ভালো বাংলা বলতে পারেন। মা বাঙালি। বাংলায় থেকেছেন। ভালো বক্তা। বিজেপি তাকে দিয়ে অনেক সমাবেশ করবেন। ইতোমধ্যে অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। ফাটাকেস্ট মুভি খ্যাত এই অভিনেতার পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তা রয়েছে৷ অনেক বিশ্লেষক বলছেন, সৌরভ গাঙ্গুলি বিজেপিতে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় বিজেপি মিঠুনকে বেছে নিয়েছে।
রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও সাথে শুভেন্দু অধিকারী প্রচারণায় সক্রিয় থাকবেন। শুভেন্দু তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। জানিয়ে রাখি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন শুভেন্দু। নন্দীগ্রাম আসনে এবার মমতার বিপরীতে লড়বেন এই শুভেন্দু। আর এই নন্দীগ্রামে রাসায়নিক সার কারখানা স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ ইস্যুতে আন্দোলন করেই মমতা জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণাত্মক প্রচার চালানো হবে। দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিজেপির আইটি প্রধান অমিত মালবীয়। এলএইডি প্রচারযানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, যোগী ও মোদি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বড় ভরসা। ইতোমধ্যে মোদি বিগ্রেড প্যারেড ময়দানে সমাবেশ করেছেন। প্রচার আয়োজন দেখে বুঝতে বাকি থাকে না বিজেপি কোনো কিছুতেই ফাঁক রাখতে চান না।
আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি না জিতলেও এই দল একটি কাজ ভালোভাবেই এগিয়ে নিয়েছে। তা হলো মোদির হিন্দুত্ববাদের বীজ বপণ। বিজেপি নেতারা বলেন, হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামপ্রসাদের জন্যই পশ্চিমবঙ্গের সৃষ্টি। এই শ্যামপ্রসাদ ফজলুল হক মন্ত্রিসভার ডেপুটি ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন।
তিনি দেশভাগের পক্ষে কাজ করেছেন। আবার হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো যেন পূর্ব পাকিস্তানে না যায় সে ব্যাপারেও সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু এত দিনেও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে শক্ত ভিত তৈরি করতে পারেনি। তাই বলাই যায়, বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যান ধারণার প্রচার ও প্রসার এই অঞ্চলে নতুন গতি পাবে। অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথের মতো নেতারা কথায় কথায় যে উগ্র বাক্য বর্ষণ করেন তা এই অঞ্চলে পদ্ম ফুলের সুবাস হয়ে ছড়িয়ে পড়লে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।