বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ফাঁদ
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ফাঁদ - ছবি সংগৃহীত
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যৌথভাবে পরিচিত ‘ব্রিটন উডস ইনস্টিটিউশনস’ বা সংক্ষেপে বিডব্লিউআই নামে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রিটন উডসে ১৯৪৪ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বের ৪৩টি দেশের এক বৈঠকের সিদ্ধান্তসূত্রে এই প্রতিষ্ঠান দুটি গঠিত হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতির পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্প্রসারণ। সেই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিষ্ঠান দুটো কতটুকু সফল বা ব্যর্থ, তা নিয়ে আছে নানামাত্রিক আলোচনা-সমালোচনা। তবে সময়ের সাথে এই ব্রিটন উডস ইনস্টিটিউশনসগুলোর বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর আকার ধারণ করছে। বললে ভুল হবে না- বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিরুদ্ধে যথার্থ কারণেই আজকাল সমালোচনার শেষ নেই। এর মধ্যে বড় ধরনের একটি সমালোচনা দীর্ঘদিন থেকেই চলে আসছে এর প্রশাসনিক কাঠামোর রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈষম্যকে কেন্দ্র করে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ভোটিং প্রধানত নির্ভর করে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির আকার ও উন্মুক্ততার ওপর। অধিকতর গরিব যেসব দেশ যখন মাঝে মধ্যে এই ব্যাংক ও তহবিল থেকে ঋণ সহায়তা পায়, কাঠামোগতভাবে সেসব দেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ‘আন্ডার-রিপ্রেজেন্টেড’। এর সরল অর্থ সিন্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এসব গরিব দেশের যথাযথ প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নেই।
সমালোচনার মুখে আইএমএফের ২০১৬ সালের ‘ভোটিং রিফর্ম’-এর মাধ্যমে ভোট ক্ষমতা কোনো না কোনোভাবে কিছুটা চীনের অনুকূলে সরে এলেও, ভোট ক্ষমতার বণ্টন ব্যাপকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ দেশগুলো ও জাপানের অনুকূলে ভারসাম্যহীনই থেকে যায়। সবিশেষ লক্ষণীয়, বিশ্বব্যাংকের বেলায় অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী বোর্ডে কম আয়ের দেশগুলোর আরো বেশি প্রতিনিধিত্বের দাবিসহ সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো ঐতিহাসিকভাবে দাবি করে আসছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সংস্কারের মাধ্যমে ‘ডাবল-মেজোরিটি ভোটিং’ ব্যবস্থার সূচনা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন শেয়ার মালিক ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ঐকমত্য। তা হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর ভূমিকা পালনের সুযোগ পাবে।
ব্রিটন উডস ইনস্টিটিউটশনসগুলোর নির্বাহী বোর্ডে নিম্ন ও মধ্য-আয়ের দেশগুলোর আন্ডার-রিপ্রেজেন্টেশন (নিম্নমাত্রার প্রতিনিধিত্ব) পরিস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ-দেশগুলোর মধ্যকার ঐতিহাসিক ‘জেন্টলম্যান’স ‘অ্যাগ্রিমেন্ট’ আরো অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে শুরু থেকেই এই তহবিল ও ব্যাংককে কার্যত দেখা হচ্ছে যথাক্রমে ইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সুশীল সমাজ দীর্ঘকাল থেকে এর স্বচ্ছ ব্যবস্থা দাবি করে আসছে। তাদের দাবি মতে, এর বর্তমান স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার বদলে নিয়ে আসতে হবে একটি মেধাভিত্তিক স্বচ্ছ ব্যবস্থা। তা সত্ত্বেও, ২০১৯ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ড্যাভিড মালপাস বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। এর মাধ্যমে দেখা গেছে, সুশীল সমাজের বিরোধিতা সত্ত্বেও উল্লিখিত জেন্টলম্যানস অ্যাগ্রিমেন্ট এখানে যথারীতি সক্রিয় রয়েছে। জাতিসঙ্ঘের সব সংস্থা চলে ‘এক দেশ এক ভোট’ ব্যবস্থায়। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফে তেমনটি চলে না। এগুলোতে ভেটিং ক্ষমতা নির্ভর করে একটি দেশের অর্থনীতির আকার ও এসব প্রতিষ্ঠানে এর কন্ট্রিবিউশনের ওপর। আর এর মাধ্যমেই এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা বাসা বেঁধেছে। এর পরিণাম কী দাঁড়ায়, আমরা বাস্তবে তা প্রত্যক্ষ করছি। এর বহু উদাহরণ আমাদের সামনে।
১৯৯৪ সালে জাম্বিয়া ঘোষণা করে, দেশটি এর জন্য প্রয়োজনীয় আরো ৯ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে না। এর কাছে যথাযথ তহবিল নেই, এমন কোনো কারণে দেশটি এ ঘোষণা দেয়নি। বরং এর কারণ, বিশ্বব্যাংক/আইএমএফ শূন্য শতাংশ জিডিপির দেশে বেতন খাতে খরচের ওপর একটা ঊর্ধ্ব-সীমারেখা বেঁধে দিয়েছে।
আর্জেন্টিনা একসময় ছিল বিশ্বব্যাংক/আইএমএফের একান্ত অনুগত ছাত্রের মতো। দেশটির সামরিক স্বৈরশাসকদের ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়েছে বিশ্বব্যাংক/আইএমএফের ঋণের ওপর। বেসরকারীকরণের ফলে দেশটির লাখ লাখ লোককে বঞ্চিত হতে হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা থেকে। অন্যান্য জনকল্যাণ সুযোগেরও অবনতি ঘটে। এর ফলে দেশটিতে ২০০১ সালে ব্যাপক জনদাঙ্গা সৃষ্টি হয়। দেশটি বেসরকারি ব্যাংকের কাছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়। ২০০২ সালে দেশটির জিডিপি ১১ শতাংশ কমে যায়। বেকারত্বের হার পৌঁছে ২০ শতাংশে। মানুষকে খাবারের খোঁজ করতে দেখা গেছে আবর্জনার স্তূপে। যখন দেখা গেল, দেশটি সব ঋণদাতাদের ক্ষেত্রেই ঋণখেলাপিতে পরিণত হওয়ার হুমকিতে পড়েছে, তখন আইএমএফ পরামর্শ দিলো সরকারি ব্যয় আরো কমিয়ে আনতে হবে। আবার প্রবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে তখন, যখন দেশটি আইএমএফের পরামর্শ বাতিল করে কিছু কিছু সেবা আবার জাতীয়করণ করে।
অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের ১৮৪টি সদস্য দেশের মধ্যে ১০৯টি দেশে এর অফিস রয়েছে। এর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজার। আইএমএফের মতো এরও একটি ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ (এসএপি) রয়েছে। এটি বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ঋণ দেয়। কৃষির আধুনিকায়নের কর্মসূচিতেও এটি তহবিল সরবরাহ করে। তা সত্ত্বেও এই ব্যাংকের ‘আর্টিকলস অব অ্যাগ্রিমেন্ট’-এ বলা হয়েছে, এর প্রধান লক্ষ্য : ‘বিদেশী বেসরকারি বিনিয়োগের উন্নয়ন।’ গত ৬০ বছর সময়ে বিশ্বব্যাংক অর্থসহায়তা দিয়েছে ৫৫০টি বাঁধে, যার অর্থের পরিমাণ আট হাজার ৬০ কোটি ডলার। কিন্তু এসব বাঁধের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি মানুষ। আর এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে ইকোলজি তথা পরিবেশ ও জীবজগতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। ‘ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যামস’ জানতে পেরেছে, থাইল্যান্ডে চধশ গঁহ উধস এর ফলে এর উজানে মাছ ধরা পড়ার পরিমাণ ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে গেছে।
২০১৩ সালে বিশটিরও বেশি দেশের সুশীল সমাজের গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে ‘ওয়েল চেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল’ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টে ড. জিম ইয়ং কিমের কাছে লেখা এক চিঠিতে ফসিল জ্বালানি প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন বন্ধের আহ্বান জানায়। এসব প্রকল্পের সবচেয়ে বড় উপকারভোগী হচ্ছে ডিক চেনির হেলিবার্টন। ডিক চেনি ২০০০-২০০৮ সময়ে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
বিশ্বব্যাংক ২০০০ সালের জুনে ‘চাদ-ক্যামেরুন পাইপলাইন’-এ ৩৭০ কোটি ডলারের তহবিল জোগান দেয়। এই বাঁধ সমাজ কিংবা পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, সে ব্যাপারে কোনো ব্যাপক সমীক্ষা না চালিয়েই এই প্রকল্পে অর্থ জোগান দেয়া হয়। ‘ফ্রেন্ডস অব আর্থ’ মনে করে ৬০০ মাইল দীর্ঘ এই পাইপলাইন থেকে প্রতিদিন দুই হাজার গ্যালন তেল নানা ছিদ্রপথে বের হয়ে পরিবেশের সাথে মিশে পরিবেশের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আমেরিকান ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে তেলের কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়েছে। এসব কোম্পানিকে কর দেয়া থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
১৯৮০ সাল থেকে ১৫০টি দেশে সব ঋণসঙ্কট মোকাবেলা করেআইএমএফ ফরমুলায়। ল্যাটিন আমেরিকায় বেশির ভাগ সামরিক সরকারের জায়গায় আসে গণতান্ত্রিক সরকার। সেসব দেশে জাতীয় অর্থনীতি চলতে শুরু করে বিশ্বব্যাংকের প্রাইভেটাইজেশন অ্যাজেন্ডার আওতায়। বিশ্বব্যাংক/আইএসএফের প্ররোচনায় ১৯৯০ সালে পেরুর প্রেসিডেন্ট অ্যালবার্টো ফুজিমুরা গ্রহণ করেন নব্য উদারবাদী সংস্কার। এর ফলে এক দিনে জ্বালানির দাম বেড়ে যায় ৩১ গুণ, রুটির দাম ১২ গুণ। এসব সংস্কারের ফলে চিলি ও আর্জেন্টিনায় স্বৈরশাসকের সময়ের তুলনায় গণতান্ত্রিক শাসন সময়ের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যায়।
১৯৮০ সালে রুয়ান্ডায় আইএমএফের প্ররোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের খাদ্যশস্য রফতানি শুরু হয়, অবসান ঘটে দেশটির খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার। একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে ভারত, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, মরক্কো ও ফিলিপাইনে।
১৯৯২ সালে নব্য উদারবাদ নীতি গ্রহণের ফলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপক এলাকায় নিদারুণ দারিদ্র্য দেখা দেয়। ১৯৯৫ সালে ডব্লিউটিও দৃঢ়ভাবে কার্যকর করে ‘রাইটস টু ব্যাংকস অ্যান্ড মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনস’। তখন সরকারি ঋণ ব্যাপক বেড়ে যায়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ে। বেসরকারি সম্পদ অনেক বেড়ে যায়। জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে।
ইরাকের ছিল বিশ্বের ১১ শতাংশ তেলের সঞ্চিতি। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৫ গুণ। আরব উপদ্বীপ থেকে শুরু করে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত গোটা এলাকা ছিল বিশ্বের ৭০ শতাংশ গ্যাস ও তেলের সঞ্চিতি। তেরো বছরের কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা অনুপ্রবেশ করে ২০০৩ সালে। এ সময় কার্যত ধ্বংস করে দেয়া হয় দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সব অবকাঠামো। লোকক্ষয় ঘটে ১০ লাখেরও বেশি। বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করা হয়েছে অর্থনীতিকে আরো ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিতে।
নাইন-ইলেভেনকে ব্যবহার করা হয়েছে বৈশ্বিক মুক্তবাজারকে অধিকতর বৈধ করে তোলার কাজে। এর মাধ্যমে ১৯৭০-এর দশকের স্থিতিশীল মূল্যব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের পথ খোলা হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে ফ্যাসিবাদ, উপজাতীয় দ্বন্ধ, সামাজিক বিভেদ এবং লঙ্ঘন করা হয়েছে মানবাধিকার ও নারী-অধিকার। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক অঞ্চলে দেখা দেয় অতিমাত্রিক মূল্যস্ফীতিও চাকরিচ্যুতি। স্বাস্থ্যসেবার অবনতি ও রোগ শোক বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক মন্দা বিস্তৃত হয় পূর্ব-ইউরোপেও। ১৯৯৭ সালের এশীয় সঙ্কটের সময়ে লুণ্ঠনপরায়রণ ফাটকাবাজি ধারণা এশিয়ান টাইগার হিসেবে বিবেচিত ইন্দোনেশিয়া, থাউল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়াকে বানানো হয় বলির পাঁঠা।
দক্ষিণ কোরিয়ায় আইএমএফের হস্তক্ষেপের পর ২০০ কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়, প্রতিদিন চাকরি হারায় চার হাজার করে লোক। ইন্দোনেশিয়ার মিষ্টি দোকানে প্রতিদিনের মজুরি ৪০ ডলার থেকে নামে ২০ ডলারে। ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক খাদ্যদাঙ্গা। চীনে সাড়ে তিন কোটি মানুষের চাকরি লে-অফ ঘোষণা করা হয়। পাশ্চাত্যে থেচার ও রিগ্যানের রাষ্ট্র আর কল্যাণ রাষ্ট্র থাকতে পারেনি। পুরো প্রজন্মই শিকার হয় চাকরি হারানোর প্রবণতার। ইউনিয়নগুলো চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়, বীমা সুবিধা সঙ্কোচন করা হয়। ১৯৮০সাল থেকে ‘থার্ড ওয়ার্ল্ডাইজেশনে’র মাধ্যমে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরির দিকে ঠেলে দেয়া হয়। বিভিন্ন শ্রেণী ও নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে বাড়িয়ে তোলা হয় বিভাজন।
একইভাবে বিশ্বব্যাংক/আইএমএফের প্ররোচিত মুক্তবাজার অপরাধের আন্তর্জাতিকীকরণ করে। প্রাইভেটাইজেশনের আবরণে সক্রিয় হয় সিন্ডিকেশন। জাতিসঙ্ঘের ‘ট্র্যানজিশনাল ক্রিমিনাল অরগ্যানাইজেশনস’ (টিসিও)-এর নিজস্ব সম্পদের পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন, যা ৩০০ কোটি মানুষের বসবাসের মাঝারি-আয়ের দেশগুলোর আয়ের সমান। সংগঠিত অপরাধীদের আয়ের পরিমাণ ‘ফরচুন ৫০০’ কোম্পানির আয়কেও ছাড়িয়ে যায়।
সম্পদ ঘনীভূত হওয়ার পরিস্থিতি পাল্টানোতেও আইএমএফ/বিশ্বব্যাংক নীতিচর্চার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা যেমনি বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে দারিদ্র্র্যসীমার মানুষের সংখ্যাও। ২০০৬ সালে বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ছিল ৭৯৩ জন, যাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন। এক বছরেই এই বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৬ জন। তখন এশিয়ায় সর্বোচ্চ সংখ্যক বিলিয়নিয়ার ছিল ভারতে, ৩০ জন। এদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৯১০০ কোটি ডলার। চীনের ছিল ২০ জন, যাদেও মোট সম্পদের পরিমাণ ২৯৪০ কোটি ডলার। ২০১৪ সালে এসে বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৪৫ জন, যাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এর আগের বছরে এর পরিমাণ ছি ৫.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। ভারতে তখন বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা উন্নীত হয় ৫৬ জনেএবং চীনে ১৫২ জনে এবং রাশিয়ায় ১১১ জন।
এ সময়ে বিশ্বের শাসক শ্রেণীর সম্পদের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি গরিব দেশের আয়ের মাত্রা কমেছে সব পুঁজিবাদী দেশে। অন্য এক হিসাব মতে, ৮৫ জন শীর্ষ ধনীর সম্পদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের সম্পদের সমান। সম্পদের এই প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ইকুয়িটি মার্কেটের স্পেকুলেশন, রিয়েল এস্টেট ও কমোডিটি ট্রেডিংয়ের কারণে। কারিগরি উদ্ভাবন, বিনিয়োগ ও শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টি কিংবা কোনো সেবাসূত্রে এই সম্পদ বাড়েনি।
এভাবে বিশ্বে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কতভাবে যে গরিব দেশ ও বিশ্ব গরিব জনগোষ্ঠীর গরিবতা আর দুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি গোটা বিশ্বে সম্পদ বৈষম্য বাড়িয়ে চলেছে, তার শত শত উদাহরণ তুলে ধরা যাবে।
বর্তমান ধারায় এই ব্রিটন উডস প্রতিষ্ঠান দুটোতে যে ভোটিং কাঠামো কার্যকর রয়েছে এবং এগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলো ‘আন্ডার-রিপ্রেজেন্টেড’ অবস্থার অবসান ছাড়া এই প্রবণতা ঠেকানো অসম্ভব। এর মাধমে এ ব্যাংক ও তহবিলে যে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তা অন্যান্য ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা বাড়িয়ে তুলছে। প্রতিষ্ঠান দুটি যে ধরনের অর্থনৈতিক নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে তা নিয়ে আছে বিতর্ক- এসব নীতি-শর্ত প্রায়শই এরা জুড়ে দেয় কিংবা পরামর্শের আকারে কার্যকর করে ঋণ, প্রকল্প, করিগরিগরি সহায়তা কিংবা অর্থ-সহায়তা অনুমোদনের বেলায়। এগুলো কার্যত ঋণগ্রহীতা দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায়, তাদের নীতি-সিদ্ধান্তগ্রহণের সক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলে এবং তাদের জাতীয় উন্নয়ন কৌশলকে নিঃশেষ করে দেয়। বিশেষ করে এটি বেশি সত্য আইএমএফের বেলায়, যেখানে আইএমএফ হয়ে দাঁড়ায় ঋণদাতা হিসেবে ঋণগ্রহীতা দেশের শেষ ভরসার স্থল। এসবের দ্রুত অবসান হওয়া দরকার।
ঐতিহাসিকভাবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কাঠামোগত সাযুজ্য কারণ কর্মসূচির মাধ্যমে নানা ধরনের শর্ত আরোপ করে। আইএমএফ ঋণপ্রার্থী দেশের কাছে চায় একটি ‘লেটার অব ইনটেন্ট’। ঋণের জন্য এটি অনুমোদন করিয়ে নিতে হয় আইএমএফের কাছ থেকে। এই চিঠিতে থাকে পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ড, পরিমাণগত কর্মসাফল্যের মাপকাঠি ও কাঠামোগত বেঞ্চমার্ক। এসবের সমালোচনার মুখে আইএমএফ ২০১৮ সালে প্রোগ্রাম ডিজাইন অ্যান্ড কন্ডিশনালিটি পর্যালোচনা করে। সেখানে দেখা যায় কাঠামোগত শর্তের সংখ্যা আরা বেড়ে গেছে। ব্যাংকটির ক্ষেত্রে শর্তাবলি এখন সরাসরি তোলা হয় এর ডিপিএফ-এর মাধ্যমে, যেখানে উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ ও মঞ্জুরি দেয়া হয় সেসব দেশকে, যেগুলো মেনে নেয় ফাঞ্জিবল ফিন্যান্স পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ‘প্রায়র অ্যাকশনস’।
বেলজিয়ামভিত্তিক ‘সিএসও ইউরোডেড’ গবেষণা মতে ২০১৭ সালে বিশ্ব্যাংক জারি করে ৪৩৪টি প্রায়র অ্যাকশন। আনুষ্ঠানিক শর্তাদি ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠান দুটি ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমেও আরোপ করে আরো নানা শর্ত। এসব শর্তের বেড়াজাল থেকে ঋণগ্রহীতা দেশগুলোকে বের করে না আনতে পারলে এদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সোনার হরিণ হয়েই থাকবে।
০৪.০৩.২১