হিজড়াদের নিয়ে কিছু কথা
হিজড়াদের নিয়ে কিছু কথা - ছবি সংগৃহীত
হিজড়া বাংলাদেশের বহুলালোচিত এক জনগোষ্ঠী। আবহমানকাল ধরে তারা অবহেলিত, অনাদৃত ও ভাগ্যবিড়ম্বিত। সমাজের সদস্যদের মনের অন্ধকার ও ব্যাধিগ্রস্ত মানসিকতার কারণে এ জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন ভাবে। তাচ্ছিল্য, উপহাস ও সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা যৌনব্যবসা, ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। অনেক সময় পথচারীদের উত্ত্যক্ত করে জোরপূর্বক টাকা আদায় করে এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে।
সমাজসেবা অধিদফতর বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার বললেও বেসরকারি হিসাব মতে, আড়াই লাখ। ‘হিজড়া’ বলতে সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃলিঙ্গ, উভলিঙ্গ, তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরিত নারী-পুরুষদেরকে বোঝানো হয়। তারা পূর্ণাঙ্গ পুরুষ নয় আবার পূর্ণাঙ্গ মহিলাও নয়। দৈহিক বা জিনগত পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী জন্মগতভাবে কোনো অবস্থানের ব্যক্তিরাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’। আরবিতে হিজড়াদের বলা হয় ‘খুনছা’। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে, ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সমাজে তারা হিজড়া হিসেবে পরিচিত। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত কৃতবীর্যের পুত্র অর্জুনও ছিলেন হিজড়া যার অপর নাম বৃহন্নলা। যেকোনো দেশে যেকোনো পরিবারে হিজড়া সন্তানের জন্ম হতে পারে। অনাদর ও অবহেলায় বড় হলে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে হিজড়াদের দলে ভিড়ে যায়। বিশ্বের ট্রান্সজেন্ডারদের ৪০ শতাংশ বিষণ্নতায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অথচ তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।
পাশ্চাত্যে লিঙ্গ পরিবর্তনের (Gender reassignment) প্রবণতা লক্ষণীয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নারী বা পুরুষ লিঙ্গ বদল করে তার পছন্দের জীবন বেছে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। শারীরিকভাবে অর্ধ নারী বা অর্ধ পুরুষরা হিজড়া কিন্তু অনেকে এমনও আছেন যারা শারীরিকভাবে পুরুষ হলেও মনোজগতে তারা নারী। ফলে, নারীর মতোই তারা জীবন যাপন করতে চান। তারা মনে করেন, কোনো নারী বা পুরুষ যদি তার লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে অতৃপ্ত থাকেন এবং সেটি পাল্টাতে চান তাহলে এতে কারো বাধা দেয়ার অধিকার নেই। ডেনমার্কে এমন ঘটনা ঘটেছে। এইনার ওয়েগনার নামের এক তরুণ নিজেকে নারী ভাবতে শুরু করেন। সেই ভাবনার তীব্রতা এতই প্রবল ছিল যে, লিঙ্গ বদলের জন্য তিনি অপারেশন পর্যন্ত করিয়েছিলেন। লিলি এলবে তরুণী লিঙ্গ পরিবর্তন করেন। এই ঘটনা নিয়ে Danish Girl নামে একটি সিনেমা বানানো হয়। সেই সিনেমায় লিলি তার প্রেমিকের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা তাকে প্রকৃতার্থে নারী হিসেবেই গড়েছেন। নইলে কেন তিনি নিজেকে নারী হিসেবেই দেখতে ভালোবাসবেন? তবে, কোনো কারণে তার শরীরটি নারীর হয়নি।’
‘এড়ফ সধফব সব God made me a woman. But the doctor... The doctor is curing me of the sickness that was my disguise.’ (আফরোজা সোমা, বিবিসি, ২১ মে ২০১৮)। কানাডীয় হলিউড তারকা এলিয়ট পেজ নারী থেকে পুরুষ হয়ে হইচই ফেলে দেন। তার অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৮৫ লাখ। ‘জুনো’ ছবিতে অভিনয় করে অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ‘ইনসেপশন’, ‘দ্য আমব্রেলা একাডেমি’র মতো ছবিতে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। অ্যালেন পেজ একসময় নিজেকে নারী পরিচয় দিতেন। পরে রূপান্তরিত হয়েছেন পুরুষে। নাম ধারণ করেছেন এলিয়ট পেজ। তিনি লিখেছেন, ‘আর কত দিন ‘অন্য কেউ’ হয়ে বাঁচব? এভাবে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। আমি নিজের পরিচয় নিয়ে সামনে এসেছি। আপনাদের অনুপ্রেরণার জন্যই আজ ‘আমি’ হতে পেরেছি (প্রথম আলো, ঢাকা, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০)।
হিজড়া জনগোষ্ঠী নানা অপরাধের সাথে যুক্ত। নবজাতক ও শিশু ছিনতাই করে জিম্মি বানিয়ে অর্থ আদায় তাদের বিশেষ কৌশল। চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে ভাগবাটোয়ারায় খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। ২০১০ সালের ঘটনা। রাজধানীর উত্তরায় বকশিশ না পেয়ে গৃহকর্তার পাঁচ বছরের শিশুকে নিয়ে দৌড় দিয়েছিলেন এক হিজড়া। গৃহকর্তা চিকিৎসক আজগর আলী বাধ্য হয়ে লাইসেন্স করা রিভলবার দিয়ে গুলি ছুড়লে ওই হিজড়াকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। হিজড়ারা ঈদে গৃহকর্তার কাছে চাঁদা দাবি করে, তা না পেয়ে ওই কাজ করে।
রাজধানীসহ সারা দেশেই এলাকা অনুযায়ী, একেক হিজড়ার রাজত্ব চলে, সেই রাজত্বে অন্য হিজড়ারা হানা দেয় না। আর যানবাহনের ভেতর, বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে যাত্রীদের জিম্মি করা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উত্তরার এক বাসিন্দা লিটা আক্ষেপ করে বললেন, ‘বাচ্চা পেটে নিয়ে কষ্ট করলাম, কষ্ট করে বাচ্চা হলো। আর হাসপাতাল থেকে বাচ্চা নিয়ে বাসায় যাওয়ার আগেই বাসায় হানা দিয়ে তিন হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে গেল হিজড়ারা। যাওয়ার সময় একটা কার্ডও দিয়ে গিয়েছিল।’ তিনি জানালেন তার বাচ্চা হওয়ার আগেই তার পাশের বাসায় ঢুকে হিজড়ারা ১০ হাজার টাকা দাবি করেছে। না দিলে বাচ্চা নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। শেষ পর্যন্ত চার হাজার টাকা দিয়ে রেহাই পায় পরিবারটি। তা দেখে আগে থেকেই আতঙ্কিত ও বিরক্ত ছিলেন তিনি। পরে মেয়ের জন্মের পর তাকে এ চাঁদা দিতে হয়। উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরসহ বিভিন্ন এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানালেন, অনেকেই বাচ্চা হওয়ার পরপর হিজড়াদের কল্যাণ সমিতিতে গিয়ে কয়েক হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে রসিদ নিয়ে আসেন। তারপর সেই রসিদ দেখালে অন্য হিজড়ারা আর উৎপাত করে না (মানসুরা হোসাইন, প্রথম আলো, ঢাকা, ২৩ জুন ২০১৯)। এসব কর্মকাণ্ড আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ওরা দাঁড়াবে কোথায়? জীবিকার অবলম্বন কী? এ ব্যাপারে ভাবতে হবে। পথ বের করতে হবে। অন্যথায় সমাজে অস্থিরতা ও অপরাধের বিস্তার ঘটবে।
নপুংসক পুরুষদেরকে খোজা বলা হয়। আগেকার যুগে রাজা বাদশাহদের অন্তঃপুরে প্রহরা ও সেবার কাজে তারা নিয়োজিত থাকত। হিজড়া জনগোষ্ঠী যৌনপ্রতিবন্ধী হলেও তাদের মন আছে, স্বপ্ন আছে, কর্মক্ষমতা আছে; সামাজিক তাচ্ছিল্যে তাদের অনুভূতি আহত হয় এবং হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। ভারত ও পাকিস্তানে তারা সংবাদপাঠিকা, অধ্যক্ষ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে ভারতের জি বাংলা যে ধারাবাহিক চালিয়েছিল ‘ফিরকি’ নামে, সম্প্রতি তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হিজড়া থাকায় দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দেখলেই নাকি ছোট শহর বা মফস্বলের মানুষ অন্য চ্যানেলে চলে যাচ্ছেন, ফলে ‘টিআরপি’ কমছে। আর সে জন্যই এই ধারাবাহিক বন্ধ করা হচ্ছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন এটিতে অভিনয় করা তৃতীয় লিঙ্গের এক অভিনেত্রী সুজি ভৌমিক। তার কথায়, ‘আমি সরাসরি প্রডিউসারের কাছ থেকে জেনেছি যে, সিরিয়ালে যখনই আমাদের গল্প আসছে, যখন আমাদের তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্রগুলো দেখানো হচ্ছে, তখনই নাকি দর্শক অন্য চ্যানেলে চলে যাচ্ছে।’
হিজড়াদেরকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩-১৪ সালে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে ঠিকই। কিন্তু জীবন জীবিকার সংস্থানে তা এখন পর্যন্ত তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। হিজড়াদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বদল হয়নি। এই সমাজে তারা অচ্ছুৎ ও অস্পৃশ্য। তাদের কাগুজে কিছু অধিকার আছে। কিন্তু বাস্তবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে তারা অবহেলিত। হিজড়া জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি সমাজের মূল স্রোতাধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদেরকে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সমাজসেবা অধিদফতরের উদ্যোগে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে পাইলট কর্মসূচি হিসেবে দেশের সাতটি জেলায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করা হয়। সাতটি জেলা হচ্ছে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেট। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪টি জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে; জেলাগুলো হচ্ছে- ঢাকা, গাজীপুর, নেত্রকোনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, সিলেট। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ মোট পাঁচ কোটি ছাপ্পান্ন লাখ টাকা। বিবিসি বাংলাতে সম্প্রতি এক হিজড়াকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করা হয়েছে। যেখানে সে নিজেই জানিয়েছে, তার পার্লারে নারীরা আসতে সঙ্কোচ বোধ করে না বরং তৈরি হয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিবেশ।
২০১৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন হিজড়াদের ১২ জনকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক সম্প্রতি নিজ কার্যালয়ে মারুফ (২২) ও জনি (৩০) নামে দুই হিজড়ার চাকরির ব্যবস্থা করেন। মারুফ এসএসসি পাস করার পর ২০১৯ সালে রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা-ইন ইলেকট্রোমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে। এর মধ্যে কম্পিউটারের ‘অফিস অ্যাপ্লিকেশন’ ওপরও একটি কোর্স করেছে। তারপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করত। সেখানে তার মেয়েলি স্বভাবের কারণে সহকর্মীরা হাসাহাসি করত। এতে নাকি পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। এই অভিযোগে তাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়। উত্তরণ ফাউন্ডেশন হিজড়াদের জন্য বিউটি পার্লার প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। কতিপয় উদ্যোগী আলিম হিজড়াদের ধর্মশিক্ষা ও ধর্মচর্চার ব্যবস্থা করে রীতিমতো বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। আমরা এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। হিজড়াদের আত্মবিশ্বাসী করে খেটে খাওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে পারলে তাদের পক্ষেও সম্মানজনক জীবিকার পথ ও পাথেয় জোগাড় করা সম্ভব। এসব উদ্যোগ ও দৃষ্টান্ত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করবে বলে সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন। পাকিস্তানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য চালু হয়েছে বৃদ্ধ নিবাস। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ পরিণত বয়সে অসহায় হয়ে পড়েন। তাদের চিকিৎসা ও দেখভালের জন্য কোনো নিকটজন থাকে না। সমাজের মূলধারায় তাদের ফিরিয়ে এনে সম্মানজনক জীবিকার ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন।
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রথম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সাদিয়া আখতার পিংকি। তিনি মনে করেন, ‘হিজড়ারাও মানুষ। তাদের হেয় চোখে দেখার কিছু নেই।’ তিনি নিজে তাই সব মানুষের জন্য কাজ করতে চাচ্ছেন। আর এলাকার মানুষ চাইলে আরো বড় দায়িত্ব নিতে চান ভবিষ্যতে। নানা সামাজিক প্রতিকূলতা তাকে পার হতে হয়েছে। এমনকি নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরও তাকে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। পিংকি বলেন, ‘যারা আমাকে কটূক্তি করেছেন তাদের আমি এড়িয়ে চলিনি। তাদের কাছে গিয়ে বলেছি, আমিও তো তোমাদের মতো মানুষ।’ তারা আমার কথা তখন শুনেছেন। আমাকে ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পিংকি বলেন, সবার সাথে মিশে তাদের মন জয় করেছি। শুধু হিজড়া হিসেবে নয়, নির্বাচনে আরো যেসব প্রতিকূলতা পার হয়েছেন সেগুলোও। শুধু হিজড়া নয়, সবার জন্য কাজ করাই আমার লক্ষ্য।’ (ডয়চে ভেলে, ঢাকা, ১৫ অক্টোবর, ২০১৯)
জামালপুরের আরিফ হয়েছেন আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী। আরিফা প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ পুরস্কার পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ৫০ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট নিয়েছেন। জামালপুর ‘সিঁড়ি সমাজকল্যাণ সংস্থা’ এবং ‘সিঁড়ি তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন মহিলা সংস্থা’ নামের দুটি সংগঠনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় ১০০ জন হিজড়া এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডে জড়িত। আরিফার কণ্ঠেও আক্ষেপ, ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে তড়িৎকৌশলে ডিপ্লোমা পাস করার পরও শুধু হিজড়া বলে কোনো চাকরি পাননি তিনি। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি (উপমহাপরিদর্শক) হাবিবুর রহমান বেদে ও হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন ২০১৬ সালে। এ আওতায় হিজড়াদের অংশগ্রহণে ঢাকার আশুলিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় উত্তরণ বিউটি পার্লার, ডেইরি ফার্ম, ট্রেনিং সেন্টার ও বুটিক হাউস, মিনি গার্মেন্টস, টেইলার্স স্থাপন করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশের উত্তরণ ফাউন্ডেশন ও ভারতের হাবিব ফাউন্ডেশনের এক চুক্তি অনুযায়ী, বিশ্বখ্যাত হেয়ার এক্সপার্ট জাভেদ হাবিবের তত্ত্বাবধানে হেয়ার ফ্যাশনে প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। দুজন এ প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরেছেন। তবে হিজড়াদের প্রশ্ন, হাবিবুর রহমানের মতো কতজন হিজড়াদের উন্নয়নে এগিয়ে এসেছেন? হিজড়াদের সুরক্ষায় রাষ্ট্র কতটুকু আন্তরিক? (প্রথম আলো, ঢাকা, ২৩ জুন ২০১৯)
‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা’ নামে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে একটি মাদরাসা গড়ে উঠেছে। ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। বাংলাদেশে হিজড়াদের জন্য এই মাদরাসাই প্রথম কোনো ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে সহিহ কুরআন শিক্ষা, নামাজ প্রশিক্ষণ, দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের তালিমগুলো হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। পরে কুরআন শিক্ষার পাশপাশি তাদের কারিগরি শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পপনা আছে উদ্যোক্তাদের, যাতে তারা সমাজের বোঝা না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। তৃতীয় লিঙ্গের যে কেউ এখানে ভর্তি হতে পারবে। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আজাদ জানান, ‘হিজড়ারা স্কুলে যেতে পারে না, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো অনেক দূরের কথা। তাদের কেউ কোনো কাজও দেয় না। অনন্যোপায় হয়ে যখন তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তখন সবাই তাদের উৎপাত মনে করে। এই দোষ আমাদের নিজের, সমাজের, রাষ্ট্রের।’ মূলত এই চিন্তা থেকেই হিজড়াদের জন্য তিনি মাদরাসা চালুর উদ্যোগ নেন। মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশন তাদের অর্থায়ন করেছে। তারা সরকার বা বেসরকারি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহায়তা চাননি। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি পরিচালিত হবে। একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিই তাদের লক্ষ্য। কেউ সহায়তা করতে চাইলে করতে পারেন। মাদরাসায় এখন ১০ জন শিক্ষক আছেন। এরপরই উত্তরা, বাড্ডা, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কয়েকটি কেন্দ্রে আবদুর রহমান আজাদ ও মাদরাসার অন্য শিক্ষকেরা পবিত্র কুরআন পড়াতে শুরু করেন। এ বিরাট মানবিক উদ্যোগ হিজড়াদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।
বাংলাদেশে হিজড়াদের পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পেতে বিড়ম্বনা ও জটিলতা রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো আইনেই স্পষ্ট কিছু বলা নেই। হিজড়া জনগোষ্ঠী যেন বাবা-মায়ের সম্পত্তির সমান ভাগ পান, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয় মুসলিম শরিয়াহ আইন এবং সংবিধানের আলোকে একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দেন। শরিয়াহ আইনে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। শারীরিক গঠনপদ্ধতি যদি বেশির ভাগ পুরুষের দিকে হয় তাহলে তিনি পুরুষের ভাগ (শতভাগ) পাবেন। আর যদি নারীর দিকে বেশি হয় তা হলে নারীর ভাগ (৫০ ভাগ) পাবেন। অপর দিকে মা অথবা বাবা মারা যাওয়ার সময় সন্তান যদি পুরুষ থাকেন এবং পরবর্তীতে নারীতে রূপান্তরিত হন, সেক্ষেত্রে তিনি পুরুষ হিসেবে সম্পত্তির ভাগ পাবেন। অনুরূপ মা-বাবা মারা যাওয়ার সময় কোনো সন্তান যদি মেয়ে থাকেন এবং পরবর্তীতে পুরুষ হয়ে যান, তাহলে তিনি মেয়ে হিসেবে সম্পত্তির ভাগ পাবেন। ইসলামী শরিয়তে মৃতের মিরাছি সম্পদে ওয়ারিশদের অংশ নির্ধারিত হয় তার মৃত্যুকালে তাদের অবস্থার ওপর। (ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত, ঢাকা, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৮৯) পৈত্রিক সম্পত্তি হিজড়াদের অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা পাপ হিসেবেই বিবেচিত।
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীও মানুষ। তাদের সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে। লৈঙ্গিক বৈকল্যের কারণে কাউকে দূরে ঠেলে দেয়া কোনোক্রমে উচিত হবে না। সমাজের একটি অংশকে অন্ধকারে রেখে আমরা আলোর সন্ধান করতে পারি না। তাদেরকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত ও কর্মমুখী শিক্ষা ও সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে তারাও অবদান রাখতে পারবে এবং মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এখন সহজ হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি এনজিও ও সেবাসংস্থাগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com