শাড়িতে অনন্যা বঙ্গ ললনা
শাড়িতে অনন্যা বঙ্গ ললনা - ছবি সংগৃহীত
মনে মনে একবার বাঙালি নারীর কথা কল্পনা করুন তো। নিশ্চয়ই চোখের সামনে শাড়ি পরা কোন ললনার চিত্রই ভেসে উঠছে, তাই না? একদম তাই, কারণ বাঙালি নারী মানেই শাড়ি।শাড়িতেই তারা সুন্দর। রোগা, মোটা, লম্বা, খাটো সব নারীকেই শাড়িতে দেখতে ভালো লাগে।আমরা যতই আধুনিক হই না কেন তা যেন নিজের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে না হয়।আমরা বাঙালি নারীরা অনেক রকম পোশাকই পরি। তবে এমন কোন বাঙালি নারী পাওয়া যাবে না, যে জীবনে অন্তত একবার নিজেকে শাড়িতে আচ্ছাদিত করেনি।কত রঙের কত ডিজাইনের শাড়ি আছে! নারীর দেহে জড়িয়ে নিলে সব শাড়িই অপূর্ব লাগে। নারীকে সাজায় শাড়ি আবার বলা যায় শাড়িকে সাজায় নারী। আধুনিক শাড়ি পরার ধরন প্রচলন করেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বধূ জ্ঞানদানন্দিনী।তিনি আমাদের যশোরের মেয়ে।আজকে বাঙালি নারীরা যেভাবে শাড়ি পরে সেটা তার কাছ থেকেই এসেছে।বর্তমান যুগেও দক্ষিণ এশিয়ার পুরো অঞ্চলসহ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি।
শাড়ির উৎপত্তির ইতিহাস খুব স্পষ্ট নয়। শাড়ির ধারণার উৎপত্তি সেলাইবিহীন বস্ত্রখণ্ড থেকে।সংস্কৃত শাটি হতেই শাড় শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ এক ফালি কাপড়। পরবর্তীতে বিবর্তনের মাধ্যমে শাডি বা সাত্ত্বিক শব্দ, শাড়ি শব্দে পরিণতি পেয়েছে। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিতে পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাইবিহীন প্রচলিত কাপড় পুরুষদের ক্ষেত্রে ধুতি ও নারীদের ক্ষেত্রে শাড়ি নামেই অভিহিত হতো। মূলত বয়নশিল্পের প্রচলনের পর থেকেই শাড়ির প্রচলন ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। শাড়ি নিয়ে আছে কতশত কবিতা, গান। চৌদ্দ শতকের কল্পকাহিনী, গল্প-গাঁথা ও গীতিকবিতায় শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময় কবি চণ্ডীদাস লিখেছিলেন,
নীল শাড়ি মোহন করি
উচ্ছলিতে দেখি পাশ।
কি আর পরানে সপিনু চরণে
দাস করি মনে আঁশ।
চতুর্দশ শতাব্দীর শেষার্ধে কবি বিদ্যাপতির রচনায় অঞ্চল (আঁচল), কাঁচুলি, শাড়ি শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়,
উরহি অঞ্চল বাঁপি চঞ্চল
আধ পয়োর হেরু
পবন পরাভব সরদ ঘন জনু
বেকত কএল সুমেরু
বাঙালি ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি ছিল প্রাচীন ভারতের প্রচলিত পোশাক।
আবহমান বাংলার ইতিহাসে শাড়ির স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের বাংলাদেশের নারীদের জাতীয় পোশাক শাড়ি।
যুগে যুগে শাড়ি নামক পোশাকটিকে বিচিত্র শব্দে- বর্ণে মহিমান্বিত করেছেন কবি-সাহিত্যিকরা।বাঙালি নারীর সঙ্গে শাড়ি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।শাড়ি শিল্পে বাংলাদেশ বেশ প্রসিদ্ধ।সময়ের সাথে সাথে এই পোশাকটি নিয়ে চলছে নানা নিরীক্ষা। রঙ, উপাদান, নকশা,ডিজাইনে নিত্যনতুন পরিবর্তন আসছে। শাড়ির রকমফেরের শেষ নেই। মসলিন, জামদানী, কাতান, ঢাকাই বেনারসি, সুতি, জর্জেট, মনিপুরী, রাজশাহী সিল্ক, তসর সিল্ক, রেশমি শাড়ি, শিফন, টিস্যু কাতান,টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, পাবনার তাঁতের শাড়ি এবং আরো অনেক রকমের শাড়ি।
মসলিন
ঢাকার ইতিহাসে মসলিনের ইতিহাস অনেক পুরানো, দীর্ঘ এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত। বাংলার ঢাকাইয়া মসলিন এমন সূক্ষ্ম ও মিহি সুতা দিয়ে তৈরি হতো যে, চল্লিশ হাত লম্বা ও দুই হাত চওড়া এক টুকরো মসলিন কাপড় একটি দিয়াশলাইয়ের বাক্সে এঁটে যেতো। আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে নাড়াচাড়াও করা যেতো। চতুর্দশ শতকে পর্যটক ইবনে বতুতা, পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশে আসা চীনা লেখকরা,মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল পর্যন্ত সোনারগাঁওয়ে প্রস্তুতকৃত এই সূক্ষ্ম সূতি বস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ঢাকা জাদুঘরে রক্ষিত মসলিনটির দৈর্ঘ্য ১০ গজ এবং চওড়া ১ গজ যার ওজন মাত্র ৭ তোলা। জনশ্রুতি আছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা মসলিন উৎপাদন বন্ধ করার জন্য মসলিন বয়ানকারী তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে দিতো।
জামদানী
প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানী শাড়ি বাঙালি নারীর সবচেয়ে প্রিয় শাড়ির তালিকায় প্রথমদিকে স্থান করে নিয়েছে। ঢাকাকেই জামদানীর আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়।ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই জামদানীর প্রতি সকল শাড়িপ্রেমী নারীর ভালোবাসা কাজ করে এবং তাদের সংগ্রহে অন্তত একটি হলেও জামদানী শাড়ি থাকে। জামদানীর বয়ন অতুলনীয়। মসলিনের উপর নকশা করে জামদানী শাড়ি তৈরি করা হয়। অনেক প্রকার জামদানী শাড়ি প্রস্তুত হয়। উপাদান অনুযায়ী দুই প্রকারের, হাফ সিল্ক জামদানী এবং ফুল কটন জামদানী। আসলের পাশাপাশি নকল জামদানীতে বাজার ছেয়ে গেছে। আসল জামদানী কিনতে হলে যাচাই-বাছাই করে কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ।আসল জামদানী কিনতে সরাসরি রূপগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ের জামদানী পল্লীতে চলে যেতে পারেন।এখানেই তাঁতে নকশাদার জামদানী শাড়ি বয়ন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী নকশার ও বুননের কারণে ২০১৬ সালে জামদানীকে জিআই (ভূমিজ) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।
কাতান
জামদানীর মতন অদ্বিতীয় এক শাড়ি কাতান। বলা যায়, কাতান বেনারসির আরেকটি ধরন। কয়েক বছর আগেও বিয়ের কনের পোশাক কাতান শাড়ি ছাড়া ভাবাই যেতো না। আজকাল লেহাঙ্গা, ঘাগড়া, চোলি কাতানের জায়গা দখল করলেও বিয়ের উৎসবে যোগদানকারী আত্মীয় নারীরা প্রথম পছন্দের পোশাক হিসেবে কাতানকেই বেছে নেন। বিয়েসহ নানা উৎসবে নারীদের কাছে কাতানের কদর আছে।মিরপুর বেনারসি পল্লীতে নানান রকমের কাতান পেয়ে যাবেন। কাতান কিনতে টাঙ্গাইলে ঘুরে আসতে পারেন। মিরপুরের কাতানের বাইরেও টাঙ্গাইলের তাঁতিরা তৈরি করছে ফুল সিল্ক টাঙ্গাইল কাতান, বালুচরি, গাদোয়ান।পছন্দের রঙের এবং ডিজাইনের কাতান ফরমায়েশ দিয়েও করিয়ে নিতে পারেন।
সুতি শাড়ি
যে কোন ঋতুতেই সুতি শাড়ি খুব আরামদায়ক। সুতি শাড়ি ঐতিহ্যবাহী এবং দারুণ স্টাইলিশ। সব বয়সী নারীদের জন্য মানানসই। যুগে যুগে সুতি শাড়ি তার রঙ এবং ডিজাইন পাল্টে চলছে। সুতি শাড়ির কদর বেড়েই চলেছে।কোটা, ফাইন, তাঁত, টাঙ্গাইলের তাঁত, পাবনার তাঁত,জামদানী সুতি,সুতি প্রিন্ট,মনিপুরী তাঁত, জ্যাকার্ডসহ নানারকম সুতি শাড়ি আছে। কারচুপি, ব্লক, চুমকি, এমব্রয়ডারি, এপ্লিক কাজ, স্ক্রিনপ্রিন্ট, সিল্ক তাঁত, তাঁত, কোটা শাড়িগুলো বেশ গর্জিয়াস হওয়ায় এগুলো যেকোন পার্টিতে অনায়াসে পরা যায়।
মনিপুরী শাড়ি
মনিপুরীরা বুনন শিল্পে খুব দক্ষ।প্রবাদ আছে, মনিপুরী মেয়েরা জন্মসূত্রেই তাঁতি।প্রায় ৯০ শতাংশ মনিপুরী নারী তাঁতের সাথে যুক্ত।ঐতিহ্য ও আধুনিকতার জন্য মনিপুরী শাড়ি ফ্যাশন সচেতন নারীদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। মনিপুরী শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য নকশা। এই শাড়িগুলো উজ্জ্বল বর্ণের সুতায় তৈরি হয়। মনিপুরী শাড়িগুলোর আঁচল, জমিন ও পাড়ে মন্দির প্রতিকৃতি থাকে, পাশাপাশি আঁচল ও জমিনে বিভিন্ন নকশা থাকে। বর্তমানে তাঁতিরা রঙ, বুনন ও নকশায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে।সুতি এবং ইদানীং রাজশাহী সিল্ক সুতায় মনিপুরী শাড়ি দারুণ বাজার পেয়েছে।মনিপুরীদের লোকজ্ঞানে তৈরি এই শাড়িগুলো ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীদের নিজস্ব দোকানে মনিপুরী শাড়ি নামে পাওয়া যায়।
টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি
টাঙ্গাইলের শাড়ির খ্যাতি সূক্ষ্ম বুনটের পাশাপাশি এর বিচিত্র ও আকর্ষণীয় নকশার জন্য। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে বিভিন্ন মোটিফ ও নকশার কাজ করা থাকে, যেমন , ফুল, পাখি, লতাপাতা, ময়ূর, প্রজাপতি ইত্যাদি। টাঙ্গাইলের শাড়ি পরতেও আরাম।
পাবনার তাঁতের শাড়ি
সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলের তাঁতিদের তৈরি করা তাঁতের শাড়িগুলো পাবনা শাড়ি নামে বিখ্যাত। এই শাড়িগুলোর দাম কম এবং নকশা ও কাজ টাঙ্গাইলের শাড়ির তুলনায় কম।স্বল্প মূল্য ও পরতে আরাম পাবনার শাড়ি নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন- মধ্যবিত্তদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।
রাজশাহী সিল্ক
রাজশাহী অঞ্চলের গৌরব ও ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ হলো রাজশাহী সিল্ক শাড়ি। রেশমের মধ্যে সর্বাধিক সূক্ষ্ম তুঁত রেশম দিয়ে তৈরি রাজশাহী সিল্ক শাড়ির জনপ্রিয়তা সিল্ক শাড়িগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।১৯৫২ সালে পাকিস্তানি সরকার রাজশাহীতে সিল্কের উৎপাদন শুরু করে।সকল শ্রেণীর ক্রেতার কথা মাথায় রেখে রাজশাহী সিল্ক শাড়ি বানানো হয়।হাজার টাকা থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকায় রাজশাহী সিল্ক শাড়ি পাওয়া যায়। পরিবেশবান্ধব, সৌন্দর্য, ঐতিহ্য, নমনীয়তা,আরামদায়ক ব্যবহারের জন্য রাজশাহী সিল্ক ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিভিন্ন উৎসব,অনুষ্ঠানে নারীর পছন্দের তালিকায় আছে রাজশাহী সিল্ক শাড়ি।
খাদি, গরদ, তসর, সিল্ক, জর্জেট, শিফনসহ প্রভৃতি শাড়ির প্রতি বাঙালি নারীদের ঝোঁক আছে। খাদি সিল্ক খুব আরামদায়ক হয়। বয়স্ক নারীদের জন্য খাদি সিল্ক দারুণ। আধুনিকতার সাথে মানানসই বাংলার ঐতিহ্যবাহী পিওর সিল্ক শাড়ি। রাজশাহী সিল্কের পাশাপাশি অ্যান্ডি ও মসলিন সিল্কের অনেক চাহিদা আছে।অ্যান্ডি সিল্ককে অনেকে তসরও বলে।সিল্ক, মসলিন বা অ্যান্ডি শাড়িতে এখন গাঢ় রঙের ব্যবহার হচ্ছে।এখন সিল্ক নিয়ে অনেক ফ্যাশন ডিজাইনাররা কাজ করছে। একরঙা সিল্ক কাপড়ে বৈচিত্র্যময় নকশার কারণে বাঙালি নারীর কাছে সিল্ক শাড়ির জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। ফ্যাশন সচেতন নারীদের পছন্দের তালিকায় এখন উঠে এসেছে নেট, টিস্যু, জর্জেট এবং শিফনের মতন শাড়ি।শিফন শাড়ির প্রচলন বেশ পুরনো।
হালকা থেকে শুরু করে ভারি কাজ করা বিভিন্ন ধরনের শিফন শাড়ি বাজারে পাওয়া যায়।জর্জেট শাড়ি সব মহলে সাধারণ ব্যবহার্য শাড়ি হিসেবে সমাদৃত। তবে জর্জেট শাড়ির মান ও আভিজাত্য নির্ভর করে ডিজাইনের উপরে।যেকোন অনুষ্ঠানে চওড়া পারের এককালার জর্জেট বেশ মানিয়ে যায়।
বদলে যাচ্ছে যুগ, বদলাচ্ছে রুচি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ফ্যাশনে আসছে ভিন্নতা।বাঙালি নারীর শাড়ি প্রীতি একইরকম রয়ে গেছে।পোশাকেই রুচির প্রকাশ ঘটে।
শাড়ির প্রকারভেদে মানানসই ব্লাউজ এবং পেটিকোট ব্যবহারে সচেতনতা শাড়ির সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। শাড়ি ছাড়া বাঙালির কোন উৎসব পূর্ণতা পায় না।বিয়ে, বরণ কিংবা বিদায় - সর্বত্রই আছে শাড়ির ছোঁয়া। ঘরোয়া অনুষ্ঠান, অফিসের মিটিং, ঈদ, পুজো, কলেজের ফেস্ট,আত্মীয় বাড়ির নিমন্ত্রণ, বন্ধুদের সহিত সাক্ষাতের প্ল্যান - শাড়িতে নারী ব্যক্তিত্ববান। শিক্ষিকা, বিমানবালা, ব্যাংকার থেকে শুরু করে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নারীরা পোশাক হিসেবে শাড়িকেই বেছে নিচ্ছেন। বলা যায় শাড়িই বাঙালি নারীর নান্দনিক পোশাক।