সাঁতার কেটে কাবা ঘর তাওয়াফ!
সাঁতার কেটে কাবা ঘর তাওয়াফ! - ছবি সংগৃহীত
২০১৩ সালের কোনো এক সময় বাহরাইনের নাগরিক ইবনে আল আওয়াদি মক্কায় গিয়েছিলেন কোনো এক কাজে। তিনি সেখানে কাবা ঘর তাওয়াফ করেন এবং শেষে মক্কা জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
জাদুঘরে রাখা একটি ছবি দেখে ইবনে আওয়াদি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, ছবিতে একটি ছোট্ট বালককে দেখে তিনি বলতে থাকেন এটা আমার বাবা! এটা আমার বাবা!
পরে তিনি কর্তৃপক্ষকে বিস্তারিত জানান! তিনি বলেন, আমি ছোট বেলায় আমার বাবার মুখে শুনেছি, বাবা প্রায়ই বলতেন 'আমি সাঁতার কেটে কাবা ঘর তাওয়াফ করেছি! আমার ভাই (তোমার চাচা) সাক্ষী!'
১৯৪১ সালের ঘটনা, আল আওয়াদি ও তার বড় ভাই তখন সৌদি আরবে পড়াশোনা করেন। একবার সাত দিনের টানা প্রবল বর্ষণে সৌদি আরবের বহু অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হলো। জনজীবন বিপর্যস্ত, রাস্তা ঘাট সব কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
আল আওয়াদি, তার বড় ভাই, দুই বন্ধু এবং তাদের এক শিক্ষক সিদ্ধান্ত নিলেন, চলো হারামের (মক্কা শরিফ মসজিদ) কি অবস্থা তা দেখে আসি!
অতঃপর তারা পাঁচজন গিয়ে পৌছালেন হারাম শরিফে। প্রায় পাঁচ ছয় ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে পুরো চত্বর। তাওয়াফ বন্ধ, কোনো মানুষজন নেই। নিরাপত্তা কর্মীরা সবাই দোতলায় উঠে বসে আছে।
আওয়াদির ভাই, শিক্ষক ও বন্ধুরা ভালো সাঁতার জানতেন না, তাই তারা কোনো রকমে কাবা ঘরের (কালো ঘর) দরোজায় গিয়ে বসে রইল ( ছবিতে দেখা যায়)। কিন্তু বারো বছর বয়সী আল আওয়াদি সাঁতারটা ভালো মতোই শিখেছিলেন, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন 'আমি সাঁতার কেটে তাওয়াফ করবো!'
তার ভাষায়-আমার বড় ভাই আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, অবশ্যই তুমি পারবে!
সাঁতার শুরু করলেন বালক আওয়াদি...এক চক্কর দিতেই নিরাপত্তা কর্মীরা হাঁকডাক শুরু করে তাকে উঠে আসতে বললেন। তিনি কোনো কথাই শুনলেন না, সাঁতার কেটেই চলছেন...
কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী দৌড়ে বন্দুক নিয়ে এলেন, একজন বন্দুক তাক করে তাকে তাৎক্ষণিক উঠে আসতে বললেন। তাদের আশঙ্কা ছিল সে যদি কোনো ক্ষতিকর কিছু করে ফেলে! তারা চিৎকার করে গুলি করার হুমকি দিলেন এবং নিশ্চিত গুলির তাক করলেন। তখন নিরাপত্তাকর্মীদের প্রধান এলেন এবং ঘটনা দেখলেন, তিনিও ওই বালককে উঠে আসতে বললেন।
কিন্তু আওয়াদি কোনো ভ্রুক্ষেপ করলেন না, তিনি ডান হাতের সাহাদাত আঙ্গুল (তর্জনি) উচিয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে তাওয়াফ করতে লাগলেন। তখন নিরাপত্তাকর্মী প্রধান বললেন আল্লাহু আকবর -আল্লাহু আকবর- সে তাওয়াফ করতেছে, তাড়াতাড়ি ক্যামেরা নিয়ে আসো!
তারা ক্যামেরায় কয়েকটি ছবি তুলে রাখলেন। (তখন সেখানে সিসি ক্যামেরা না থাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোনো বিশেষ ঘটনা তারা ছবি তুলে রাখতেন)
তাওয়াফ শেষে তারা সবাই উঠে এলে নিরাপত্তাকর্মী প্রধান তাদের সাথে কথা বলেন এবং এটাও বলেন যে তোমার ভাগ্য ভালো ছিল যে আমাদের কাছে একটা গুলিও ছিল না! তা না হলে তিনবার সর্তক করে তোমাকে গুলি করে দিত, এটাই নির্দেশ ছিল!
আমি মাসুদ আলম ভাগ্যবান যে আল আওয়াদি'র নিজ মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনেছি! ২০১৫ সালের কোনো এক সময় একটি আরবি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে তার সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছিল। আল আওয়াদি ২০১৫ সালে বাহরাইনে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর আগেই সৌদি আরব সরকার তাঁকে সৌদি আরব নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্মান জানায় এবং তাঁর সাঁতার কাঁটার একটি ছবি উপহার দেন।
ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর আল আওয়াদি একদিনেই বাহরাইনে কিংবদন্তী বনে যান, ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন।
যদিও তিনিই একমাত্র এবং প্রথম সাঁতারু তাওয়াফকারী নন, তাঁর পরে ইসলামি পন্ডিত বদর আল'দীন বিন জা'মা (Badr al-Din bin Jama'a) সাঁতার কেটে তাওয়াফ করেছেন এবং প্রত্যেক চক্করেই বা তাওয়াফে কালো পাথরে (হাজরে আসওয়াদ) চুমু দেন!
তবে ইতিহাস থেকে জানা যায়, সর্ব প্থম সাঁতার কেটে কাবা ঘর তাওয়াফ করেছিলেন নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের রা...
...সুতরাং কাবা ঘরের তাওয়াফ বন্ধ থাকা না থাকা, বিভিন্নভাবে তাওয়াফ করা সবই আল্লাহর ইচ্ছা! এতে অতি আবেগপ্রবণ বা অতি মূল্যায়নের কোনো প্রয়োজন নেই।
আল্লাহ আমাদের জ্ঞান অর্জনের তৌফিক দিন।