ইসলামি বিধানে জবান অপব্যবহারের শাস্তি

উসমান বিন আবদুল আলিম | Mar 05, 2021 02:54 pm
ইসলামি বিধানে জবান অপব্যবহারের শাস্তি

ইসলামি বিধানে জবান অপব্যবহারের শাস্তি - ছবি : সংগৃহীত

 

মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে অসংখ্য নিয়ামতরাজি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মানুষের শরীর আল্লাহর দেয়া অগণিত নিয়ামতে ভরপুর। যেমন- চোখ, নাক, জিহ্বা, হাত, পা, মাথা, ব্রেন, কান ইত্যাদি। কুরআন কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গণনা করে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না।’ (সূরা ইবরাহিম-৩৪)

এই অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে জিহ্বা হচ্ছে আল্লাহর দেয়া উল্লেখযোগ্য এবং একটি শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। কেননা, জিহ্বা বা বাকশক্তি আল্লাহ তায়ালার বড় নিয়ামত ও মহা দান। বান্দার বহুবিধ কল্যাণ এতে নিহিত। বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে তিনি এ নিয়ামত বান্দাকে দান করেছেন। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে এসব প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব নয়। জবানের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হলে অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কোনো কিছুই জবানের বিকল্প হতে পারে না।

আবার এই জবান মানুষের জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম। অর্থাৎ এই জবানের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত হয়, আবার এর অপব্যবহার করার কারণে মানুষ জাহান্নামের উপযোগী হয়ে যায়। এরকমই জবান মানুষকে কখনো সম্মানের পাত্র বানায়, আবার কখনো লাঞ্ছনার শিকার হওয়ায়।
অপরপক্ষকে মিথ্যা, গীবত, অপবাদ, গালি-গালাজ, কর্কশ ভাষা; মানুষকে আল্লাহর অসন্তোষ, ক্রোধ ও জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে। এ জন্য শরিয়তে জবানের হিফাজত করাকে খুবই গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করেছেন। জবান হিফাজতের মাধ্যমে মানুষ অনেক ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে রাসূল সা: অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন- ‘যে আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (সহিহ বুখারি-৬০১৮)

একবার রাসূল সা: তাঁর প্রিয় সাহাবি ওকবা ইবনে আমের রা:কে তিনটি ওসিয়ত করলেন। এর প্রথমটি ছিল- ‘তুমি তোমার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো’। (জামে তিরমিজি-২৪০৬)

জবানের অপব্যবহার : ১. গালিগালাজ করা। অধিকাংশ মানুষ নিজেদের ক্ষমতা বা যেকোনো কারণে ছোট-বড়, আলেম-ওলামাসহ অন্যদের গালিগালাজ করাটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। অথচ হাদিসে এসেছে- হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন- ‘দুই ব্যক্তির পরস্পরকে গালি দেয়ার পরিণাম প্রথম গালি প্রদানকারীর ওপর পতিত হয়, যে যাবত না মাজলুম (দ্বিতীয় ব্যক্তি) সীমা লঙ্ঘন করে।’ (মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিজি-১৯৩১)

২. মিথ্যা বলে মানুষকে হাসানো। আল্লাহর রাসূল সা: ইরশাদ করেন- ‘ধ্বংস ওর! যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। ধ্বংস ওর! ধ্বংস ওর জন্য!।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-২০০২১)

৩. অন্যকে লানত করা। কারো মাঝে কথায় কথায় লানত-বদদোয়া দেয়ার বা অভিশপ্ত করার বদঅভ্যাস থাকে। বিশেষভাবে নারীদের মাঝে। অনেক সময় তারা আপনজন এমনকি নিজ সন্তানকেও বদদোয়া দিয়ে চলে। হতে পারে তখন দোয়া কবুলের মুহূর্ত ছিল। ফলে খাল কেটে কুমির আনার মতো অবস্থা হয়। বদদোয়াটা লেগে যায়। এটা খুবই গর্হিত কাজ। জবানের মারাত্মক অপব্যবহার। তাই এ ব্যাপারে আমাদের হুঁশিয়ার থাকা উচিত। রাসূল সা: ইরশাদ করেন- ‘তোমরা একে অপরকে লানত করো না; বলো না- তোমার ওপর আল্লাহর লানত হোক, তোমার ওপর আল্লাহর গজব পড়ুক, তুমি জাহান্নামে যাও।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস-১৯৭৬)

৪. অন্যের গিবত করা : জবানের অপব্যবহারের আরেকটি ক্ষেত্র হলো, গীবত-অপবাদ দেয়া। অথচ কুরআন-হাদিসে এগুলো থেকে শক্তভাবে বারণ করেছে। এগুলো প্রত্যেকটাই কবিরা গুনাহ। পাশাপাশি জবানের অপব্যবহারেরও শামিল।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা একে অপরের গিবত (পরনিন্দা) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দ করে থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তওবা কবুলকারী অসীম দয়ালু।’ (সূরা হুজরাত-১২) রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন- ‘গীবত (পরনিন্দা) যেনার (ব্যভিচার) চেয়ে জঘন্য অপরাধ।’ (বায়হাকি)

৫. মিথ্যা কথা বলা : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন কোনো বান্দা মিথ্যা বলে তখন এর দুর্গন্ধে ফেরেশতারা তার কাছে থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়।’ (তিরমিজি-১৯৭২)

৬. শোনা কথা বলে বেড়ানো। হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম থেকে রিয়াদুস সালিহিন-১৫৪৭)

৭. ভালো-মন্দ বিচার না করেই কোনো কথা বলা। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছেন- ‘বান্দা যখন ভালো-মন্দ বিচার না করেই কোনো কথা বলে, তখন তার কারণে সে নিজেকে জাহান্নামের এত গভীরে নিয়ে যায় যা পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের সমান।’ (বুখারি ও মুসলিম থেকে রিয়াদুস সালিহিন-১৫১৪)

৮. দ্বিমুখীপনা হওয়া: হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন- ‘দ্বিমুখী চরিত্রের লোকেরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি-১৯৭৪)

৯. কথার দ্বারা অন্যকে কষ্ট দেয়া : হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা:-এর সামনে একজন নারী সম্পর্কে বলা হলো, সে খুব নফল নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং অনেক দান-সদকা করে। কিন্তু তার মুখের ভাষা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, সে জাহান্নামি। ওই ব্যক্তি আরেকজন এক নারী সম্পর্কে বলল, যার নফল নামাজ, নফল রোজা ও দান-সদকার ক্ষেত্রে তেমন প্রসিদ্ধি নেই। কখনো হয়তো সামান্য পনিরের টুকরা সদকা করে। তবে সে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। কেউ তার মুখের ভাষায় কষ্ট পায় না। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, সে জান্নাতি। (মুসনাদে আহমদ-৯৩৮৩)

জবানকে অপব্যবহার করার পরিণাম : জবানের অপব্যবহারের কারণে সামাজিক সঙ্ঘাত তো রয়েছে, সাথে সাথে এর কারণে মানুষকে জাহান্নামেও নিক্ষেপ করবে। দীর্ঘ এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত মুআজ রা: রাসূল সা:কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কথার কারণেও কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? তখন রাসূলুল্লাহ সা: মুআজ রা:-এর উরুতে মৃদু আঘাত করে বললেন- ‘হে মুআজ! তুমি এ বিষয়টি বুঝো না! আরে, মানুষকে তো তার জবানের কথাই উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। যে আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী সে যেন ভালো কথা বলে বা অন্তত মন্দ কথা থেকে বিরত থাকে। তোমরা ভালো কথা বলো, লাভবান হবে। মন্দকাজ থেকে বিরত থাকো, নিরাপদ থাকবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস-৭৭৭৪)

বহু ক্ষেত্রে জবানের অপব্যবহার গভীর সম্পর্ককেও তছনছ করে দেয়। নিবিড় বন্ধুত্বের মাঝেও ফাটল ধরায়। দীর্ঘদিনের আত্মীয়তাকে মুহূর্তে শেষ করে দেয়। হৃদয়কে জর্জরিত করে। অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করে, যা কখনো মানুষ ভুলতে পারে না। কারণ, জবানের আঘাতের ঘা শুকায় না। কবি বলেছেন, ‘বর্শার ফলার আঘাতের উপশম হয়। তবে জবানের আঘাতের কোনো উপশম নেই।’ (শরহে জামি)
জবানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা : রাসূল সা: বিনয়কাতর হয়ে আল্লাহর কাছে জবানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন- ‘হে আল্লাহ! আমি আমার কান, চোখ, জবান, হৃদয় এবং লজ্জাস্থানের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় চাই।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৫১; জামে তিরমিজি, হাদিস-৩৪৯২)
সুতরাং আমাদেরও উচিত জবানের সঠিক ব্যবহারের প্রতি সচেতন ও যত্নবান হওয়া এবং এর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা।

লেখক : মোহাদ্দিস ; দারুলউলুম মোহাম্মদপুর কওমি মাদরাসা, চাটমোহর, পাবনা।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us