কোন দিকে যাবে মিয়ানমার
সু চি ও সেনাপ্রধান - ছবি : সংগৃহীত
একটি রাষ্ট্র তখনই ‘রিপাবলিক’ হিসেবে গণ্য হবে যখন সে রাষ্ট্রটির মালিকানা প্রকৃত অর্থেই থাকবে জনগণের হাতে। বিশ্বে রিপাবলিকান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ার আগে রাষ্ট্র ছিল রাজা, মহারাজা এবং সম্রাটদের মালিকাধীন। ১৬৫০ সালের পরে মানবজাতি বুঝতে পারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃত উৎস হলো জনগণ। কাজেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মালিক সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের জনগণ। এর ব্যত্যয় ঘটলে বুঝতে হবে সব বানোয়াট এবং ধোঁকাবাজি।
১৮২৪ সাল থেকে ব্রিটিশ সরকারের কলোনি ছিল বার্মা এবং এটাকে আলাদা দেশ হিসেবে ব্রিটিশরা কোনোদিন স্বীকৃতি দেয় নাই। এটা ব্রিটিশ-ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ভারতেরই একটি প্রদেশ হিসেবে ব্রিটিশ কর্তৃক শাসিত হয়েছে। এই ব্যাপারে ভূরি ভূরি প্রমাণ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের অফিসার বা আমলারাই সম্পূর্ণ ব্রিটিশকালীন সময়টা বার্মা পরিচালনা করেছেন। ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬২ সালে বার্মা সেনাবাহিনীর জেনারেল নেউইন সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বার্মা বা মিয়ানমারের শাসন ব্যবস্থায় সামরিক আধিপত্য দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া তা কমার লক্ষণ এই পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও দেখা যায় নাই। প্রকৃত প্রস্তাবে সামরিক একনায়কত্ব কমানোর প্রচেষ্টা মিয়ানমারের কোনো মহল থেকে সেভাবে হয়নি। এতদিন ধরে মিয়ানমারে যে শান্তি বিরাজ করেছে তা কি কবরের শান্তি না সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাপ্রসূত শান্তি তা বুঝে ওঠা বাইরের লোকের জন্য দুষ্কর ছিল।
মিয়ানমার শাসন করা সংক্রান্ত এই পর্যন্ত দুটি শাসনতন্ত্র গত হয়েছে এখন তৃতীয় শাসনতন্ত্রের অধীনে দেশটি চলছে যা রচিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। এতে রাষ্ট্রগঠনের ‘মৌলিক’ নীতি হিসেবে সাতটি নীতি গ্রহণ করা হয়েছে যা রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই সাতটি মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে সাত নম্বর বা সর্বশেষ নীতি হলো ‘দেশের ডিফেন্স সার্ভিসকে রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া।’ কাজেই সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সুযোগ আগেই করে রাখা হয়েছে। কারণ বর্তমান মিয়ানমারের শাসনতন্ত্রটি একই দেশে একই সাথে দুই প্রকৃতির শাসনের ব্যবস্থা করেছে। একই সরকারের দুটি অংশ- এক অংশ নির্বাচিত এবং অন্য অংশ হলো সেনা সরকার।
সরকারের উভয় অংশ মিয়ানমারের শাসন পরিচালনা করবে। সরকারের দুই ভিন্ন চরিত্রের অংশ যদি একই জনগোষ্ঠীকে শাসন করে সেক্ষেত্রে দেশ শাসনে যে বিভ্রাট দেখা দেবে তা এক শব্দে প্রকাশ করার জ্ঞান কোনো রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের আছে বলে মনে হয় না। উল্লিখিত শাসনতন্ত্র শুধুমাত্র সেনাবাহিনী কর্তৃক রচিত হয়েছে এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছে। এই শাসনতন্ত্র অনুযায়ী দেশটিতে দুইজন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকবে, একজনকে সেনাবাহিনী অনুমোদন দেবে, দ্বিতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন জনগণের নির্বাচিত সদস্যের মধ্য থেকে। ২৫ শতাংশ সংসদ সদস্য সেনাবাহিনী থেকে মনোনয়ন দেয়া হবে। শাসনতন্ত্রে একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের কথাও বলা হয়েছে ওই নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১১ জন সদস্য থাকবেন, তার মধ্যে পাঁচজন মনোনয়ন দেবে সেনাবাহিনী তাদের মধ্য থেকে। এই মনোনয়নের ব্যাপারে সেনাবাহিনী প্রধানের কথায় শেষ কথা বলে গণ্য হবে। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী সংসদের উচ্চ এবং নিম্ন উভয় হাউজে ২৫ শতাংশ সদস্য অবশ্যই সেনাবাহিনী থেকে নিতে হবে।
প্রাদেশিক পরিষদগুলোতেও একইভাবে সেনাবাহিনী থেকে সদস্য মনোনীত করে দেয়া হবে। এইসব পার্লামেন্টের সামরিক সদস্যরা সরাসরি সেনাপ্রধানের সাথে ছাড়া এই ব্যাপারে অন্য কারো সাথে আলোচনা করার অধিকার রাখবে না। আর সেনাবাহিনীর ইউএসডিপি নামে যে দল রয়েছে সে দলের কর্মকর্তাদের সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা করতে পারবে। উল্লিখিত সেনাবাহিনীর অদ্ভুত শর্তগুলো ছাড়াও আরো অনেক সুপার অদ্ভুত শর্তের কথাও জানা যায়। যেমন সেনাবাহিনী যেকোনো সময় রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে, যদি প্রধান সেনাপতি মনে করে জাতীয় নিরাপত্তা সঙ্কটে পড়েছে। এই ‘সঙ্কটের’ কথা সেনাপতি ছাড়া অন্যকারো বুঝে না এলেও চলবে শুধু তিনি বুঝলেই হবে। এই শাসনতন্ত্র যাতে সংশোধন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে সেজন্য আরো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শাসনতন্ত্রেই বলা আছে, এই শাসনতন্ত্রের যেকোনো ধারা, উপধারা বা অন্য কিছু সংশোধন করতে ৭৫ শতাংশের বেশি ভোটের প্রয়োজন হবে। এই শাসনতন্ত্র দু’ভাগে ভাগ করা যায়, (ক) সেনাবাহিনীর অংশে সিভিল অংশ। সেনাবাহিনীর অংশে নাক গলানোর প্রশ্নই ওঠে না। সিভিল অংশকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাকি কাজগুলো করা হয়েছে। সিভিল অংশকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখতে বর্তমানে শাসনতন্ত্রে এরূপ আরো অনেক ধারা সংশোধন করা হয়েছে। এটা ছাড়াও সেনাপ্রধান তিন মন্ত্রীকে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। যে তিন মন্ত্রীকে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে সেনাপ্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রয়েছে তারা হলেন (১) দেশরক্ষা মন্ত্রী, (২) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও (৩) সীমান্তরক্ষা সংক্রান্ত মন্ত্রী।
শাসনতন্ত্রের আরেকটি ধারা সেনাবাহিনীকে প্রায় সার্বভৌম (ঝড়াবৎবরমহ) ক্ষমতার অধিকারী করে দিয়েছে, তা বর্তমান মিয়ানমারের শাসনতন্ত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী যেকোনো ব্যাপারে সরকারের সিভিল অংশের কাছে জবাবদিহিতা মুক্ত থাকবে। ৮ নভেম্বর ২০১৫ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এনএলডি অংশগ্রহণ করেছিল। তখন প্রতিনিধি পরিষদে (নিম্নকক্ষে) ৪৪০ জন সদস্যের মধ্যে এনএলডি ৩৩০টি আসনে জয়লাভ করেছিল এবং উচ্চ পরিষদে ২২৪ জন সদস্যের মধ্যে এনএলডি ১৬৮ আসনে জয়লাভ করেছিল। তখনই সরকার গঠনের ব্যাপারে সুচির সাথে সেনাপ্রধানের মতানৈক্য শুরু হয়েছিল। সু চিকে প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগের ব্যাপারে সেনাবাহিনী তখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পর্দার অন্তরালে এই ইস্যু নিয়ে সেনাবাহিনীর সাথে যথেষ্ট বাগি¦তণ্ডার পরেও, সেনাবাহিনী তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে ফলে সু চি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হতে চরমভাবে ব্যর্থ হন। পরে ‘রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা’ নামে এক উদ্ভট ও হাস্যস্পদ পদ সৃষ্টি করে সু চিকে নবগঠিত সরকারের স্থান করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারের সিনিয়ার আর্মি জেনারেল বা সেনাপ্রধানের আরো পাঁচ বছরের জন্য চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হয়। ২০১৯ সালে এনএলডি শাসনতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন এনে সেনাবাহিনীর অস্বাভাবিক এবং দৃষ্টিকটু ক্ষমতাগুলোর পরিবর্তন করতে জোর উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু অক্লান্ত চেষ্টার পরও শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর প্রবল বিরোধিতার ফলে শাসনতন্ত্রে এক বিন্দু পরিবর্তন আনাও সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডির পক্ষে সম্ভব হয় নাই। এতে নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয় যে মিয়ানমারে ব্যালেটের ক্ষমতার চাইতে বুলেটের ক্ষমতাই বেশি শক্তিশালী।
যখন বর্তমানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল তখন এনএলডি এবং সেনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। যেমন সেনাবাহিনীর দাবি ছিল ভোটকেন্দ্রগুলো আগের মতো ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বহাল থাকবে কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনীর এই অন্যায় এবং ক্ষমতা বহির্ভূত আবদার মানতে রাজি হন নাই এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পূর্বের ভোট কেন্দ্রগুলো নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। এতে ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনী বর্তমানে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার কারণে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনীর সে দাবি প্রত্যাখ্যান করে।
অবশেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর যখন ফলাফল বের হলো দেখা গেল, সু চির দল এনএলডি আগের চেয়েও উভয়কক্ষে বেশি আসন পেয়ে জয়লাভ করেছে, তখন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নাকচ করে দিলেন এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সেনাবাহিনীর পক্ষে গ্রহণ করেছেন বলে ঘোষণা দেন।
সেনাবাহিনীর মতে সু চি সেনামুক্ত সরকার এবং রাজনীতি কায়েমের ব্যাপারে বিরাট পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেই দিকে সু চির দল এগোচ্ছে। এদিকে বর্তমানে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও আগামীতে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যা কলাকৌশল প্রয়োজন সবটাই নিয়েছেন বলে মনে হয়। সেনাপ্রধানের কাছে এটাই স্পষ্ট হয়েছে, বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর জন্য যে প্রস্তুতির প্রয়োজন তা নিতে সু চি এবং তার দল কার্পণ্য করেছে বলে মনে হচ্ছে না।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সু চি পশ্চিমা বিশ্বে বিতর্কিত হলেও, গণতন্ত্রের সংগ্রামে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপিয়ান কমন মার্কেট জোটভুক্ত দেশগুলো এই ব্যাপারে সু চিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে কার্পণ্য করবে বলে মনে হয় না।
এদিকে ইতোমধ্যেই জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত ও কৃস্টিনা শানার বার্জেনার, মিয়ানমার জান্তার উপপ্রধানের সাথে কথা হয়েছে। তিনি বলেন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ চলছে এবং কোনো ধরনের কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানো হলে পরিণতি মারাত্মক হবে। খবরে আরো প্রকাশ হয়েছে ইতোমধ্যেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের ফলে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি থমকে গেছে।
আন্দোলনকারীদের এক অংশ বর্তমান সামরিক জান্তার ওয়েবসাইটগুলোকে লক্ষ্য করে সাইবার যুদ্ধ শুরু করেছে। সামরিক জান্তার বহুসংখ্যক ওয়েবসাইট হ্যাক করে ইতোমধ্যে অকেজো করে দেয়া হয়েছে। রাজপথে ও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী প্রত্যহ সারা দেশব্যাপী বিক্ষোভ জারি রেখেছে। চীন ও রাশিয়া ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে উভয় দেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নীরবতা পালন করবে। ভারত অবশ্য বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কাজেই বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশগুলো যদি মিয়ানমারের চলমান গণতন্ত্র কায়েমের সংগ্রামে সহায়তা করা নিজেদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করে সেক্ষেত্রে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে যদি ভারত এই ব্যাপারে নীরব থাকে তাহলে বিশ্বের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি ভারতের সহমর্মিতার ব্যাপারে সারা বিশ্ব সন্দিহান হয়ে পড়বে। অবশ্য ভারতের সে মূল্যবোধ যে এখনো অক্ষত রয়েছে তা গণতান্ত্রিক বিশ্ব মনে করে।