মুসলিম উম্মাহর পতনের ৫ কারণ
মুসলিম উম্মাহর পতনের ৫ কারণ - ছবি : সংগৃহীত
মুসলিম উম্মাহর পতনের কারণগুলো একটামাত্র বক্তব্যে নির্দেশ করাটা সহজ নয়। আমার মতে এর পাঁচটি মৌলিক কারণ রয়েছে : ১. বস্তুবাদিতা (Materialism), ২. ব্যক্তিস্বাধীনতা (Individualism), ৩. পুঁজিবাদ (Capitalism), ৪. সম্প্রসারণ বাদ (Expansionism) ও ৫. সেক্যুলারবাদ (Secularism)।
ইতিহাস বিচার করলে কারণগুলো পরিষ্কার হয়ে যায় পতন প্রক্রিয়াটাসহ। আল্লাহপাক বলে দিয়েছেন, এই দুনিয়ার ধন-সম্পদ ক্ষণস্থায়ী, তা অর্জন করাটাই জীবনের আসল লক্ষ্য নয়। তিনি আমাদেরকে পরকালমুখী হতে বলেছেন। তাঁর প্রিয় হাবিব সা: স্বয়ং এবং সম্মানিত সাহাবীরাগণও পরকালমূখী জীবন যাপনের সর্বোত্তম উদাহারণ পেশ করেছেন।
ইসলামের প্রথম একটি শতাব্দী অতিবাহিত হতেই জীবনের এই মৌলিক লক্ষ্যটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবুজর গীফারি রা: এই পরিবর্তনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে, হিজরী চতুর্থ দশকেই তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
সম্পদ আহরণ করা, সে লক্ষ্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা করাটা ইসলামে অবৈধ নয়, নিরুৎসাহিতও নয়। কী প্রক্রিয়ায় সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে, কী দৃষ্টিতে তাকে দেখা হচ্ছে এবং কিভাবে তা খরচ হচ্ছে, সেটাই হলো আসল বিচার্য। অনিয়ন্ত্রিত লোভ ও চাহিদা যখন সম্পদ আহরণের পেছনে কাজ করে তখন তা আত্মঘাতী হয়ে দেখা দেয়, এটাই ইসলামের দৃষ্টিভংগী।
কাদেসিয়ার যুদ্ধের (জুলাই, ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) ধারাবাহিকতায় ৬৫৩ পর্যন্ত চলে আসা সংঘাতের মাধ্যমে পারস্য বিজয় হয়। প্রায় একই সময়কালে সংঘটিত অপর বিজয়াভিযান, ইয়ারমুকের যুদ্ধের ( আগষ্ট-৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) ফলে রোমান কালচার সমৃদ্ধ সিরিয়া বা শাম মুসলিম সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। এরপর থেকে রোমান ও পারস্য সম্রাজ্যের সেই জৗলুসপূর্ণ বিলাসী জীবনধারা ইসলামি সমাজে বানের পানির মতো ঢুকে পড়তে থাকে এই দুই জনপদ থেকে আসা ধর্মান্তরিত নওমুসলিমদের মাধ্যমে।
ইসলামের মধ্যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বাসা বাঁধতে থাকে। ধীরে ধীরে সুক্ষ কিন্তু গতীশীল পরিবর্তন ঘটতে থাকে পরবর্তি প্রজন্মের মুসলিম মানসে। বিলাসী জীবন যাপনের প্রবণতা বেড়েছে, কৃচ্ছতাপূর্ণ সাধারণ জীবনটা অসহনীয় ঠেকেছে। চাহিদা ও প্রয়োজনে বেড়ে মনে সম্পদের প্রতি লোভ বাড়িয়েছে।
ব্যক্তিমানসে সম্পদের প্রতি সীমাহীন লোভ (Materialism) ব্যক্তি ও তার মৌলিক অবস্থানস্থল; পরিবারে আপোষকামীতা এনেছে, ফলে সে নীতি নৈতিকতার সাথে আপোষ করে বৃহত্তর লক্ষ্য ভুলে সম্পদের পেছনে ছুটেছে, ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না করেই। এটা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক) এটাই হলো পতন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক সূচনা বিন্দু ।
ব্যক্তিচরিত্রে আপসের এ ধারা সৃষ্টির ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও বংশের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধনকে সঙ্কুচিত করেছে, মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে সমাজে 'Individualism'-এর পথ খুলে দিয়েছে।
কালের বিবর্তনে এরই হাত ধরে নারীর সম্মান, প্রকৃতিগত অবস্থান, তার অধিকার ও মহান দায়িত্ব সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার পরিণতিতে নারী মানসেও জন্ম নিয়েছে রমণীয় ধাঁচের 'Individualism' ('Feminism') আর এটাই জন্ম দিয়েছে 'নারী স্বাধীনতা' নামক শ্লোগাণের আড়ালে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভাঙ্গার সবচেয়ে বড় উপকরণ। ফলে ইসলামের সবচেয়ে বড় বুনিয়াদ; পারিবারিক বন্ধন ভাঙ্গনের পথ ক্রমেই বাড়তে থেকেছে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে।
বস্তুবাদিতার (Materialism) প্রসার, তার পথ ধরে ব্যক্তিস্বাধীনতার ('Individualism') বিস্তার পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধনকে শিথিল করে দেয়ায় পারষ্পরিক দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতার লোপ প্রথমে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্তির মনে এবং পরে গোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনায় পুঁজিবাদকে (Capitalism) উস্কে দেয়।
এই Capitalism-এর হাত ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে Corporate Business Monopoly -এর মতো চিন্তাধারা এবং সম্পদ কুক্ষিগতকরণ, তার উপরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম ও রক্ষার অসুস্থ ও মানবতাবিধ্বংসী প্রতিযোগীতার উদ্ভব ঘটে।
এই প্রতিযোগীতায় টিকে থাকা রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন ও প্রতিষ্ঠা ছাড়া অসম্ভব হলে রাষ্ট্র তখন নিজ সীমার বাইরে অবৈধভাবে শক্তি প্রয়োগে আগ্রাসীরুপ ধারণ করে, শক্তি অর্জন ও প্রদর্শনের অসুস্থ প্রতিযোগীতা, অস্ত্র উৎপাদন, অর্জন ও প্রয়োগ, পরের রাজ্য পদানত করা, এসব হয়ে পড়ে তার একমাত্র নেশা ও লক্ষ্য! রাষ্ট্র ও তার পরিচালকদের মনে জন্ম নেয় Expansionism-এর চেতনা। এভাবেই মুসলিম বিশ্বকে উপনিবেশ করে অমুসলিম দুনিয়া; সূচিত হয়েছিল উপনিবেশবাদ বা Colonialism।
এত কিছুর পরও ইসলামের যে ছিটে ফোঁটা অংশ সমাজ ও রাজনীতিতে টিকে ছিল, তা শেষ করেছে Secularism, এর চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই কামাল পাশা, নাসের, বেনবেল্লারা মুসলিম সমাজ থেকে ইসলামের নাম গন্ধটুকু দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
অনেকে Communism-এর কথা বলবেন। অবশ্যই Communism একটা কারণ মুসলিম মানসে বিভ্রান্ত ও পতনের জন্য। কিন্তু এই Communism এর উৎপত্তিই হতো না যদি Secularism দৃশ্যপটে না আসতো। Secularism-এর হাত ধরে, বলা চলে, Secularism থেকে আরো কট্টরতার দিকে বিচ্যুত হয়েই Communism-এর উদ্ভব ঘটেছে।
ব্যাখাটাকে পুরোপুরি অনুধাবন করতে হলে ফিরে যেতে হবে উমাইয়া বনাম আব্বাসীয় খেলাফত, হাশেমি ও ফাতেমি খেলাফত থেকে শুরু করে তেইশ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া স্পেনের মূর শাসনসহ বিশাল মুসলিম জনপদের প্রতিটি শাসনকাজের গতিধারা পর্যবেক্ষণ শেষে ফরাসি বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থা বিচার করলে।
মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ চিন্তাশীল ব্যক্তিই বিশ্লেষণের এই গভীরে যেতে চান না। কারণ, তলিয়ে দেখতে গেলে আমরা কেবলই নিজেদের কদর্য, ক্লেদাক্ত অতীত দেখে লজ্জিত হই! এভাবে কী নিজেদের অবস্থার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব?