ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি
ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি - ছবি সংগৃহীত
প্রথম বাংলাবিজয়ী মুসলিম সেনাপতির পরিচয় দিতে গিয়ে সরদার আবদুর রহমান তাঁর রচিত ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাংলায় সেন রাজবংশের দীর্ঘকালীন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন তিনি।’ লেখক এই গ্রন্থকে বাংলায় বখতিয়ার খলজির প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ বলেছেন। লেখকের কথায়, “...বিপুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত এই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে পৃথক কোনো গ্রন্থ আজ অবধি রচিত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি- অন্তত বাংলা ভাষায় তো নয়ই।” এই উন্মুক্ত-অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে বখতিয়ার খলজিকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসগ্রন্থ রচিত হয়ে থাকলে তা বাংলাদেশে নিবিষ্ট পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাবে এটি অভাবিত।
লেখক স্বীকার করেছেন, “এটি আদৌ কোনো গবেষণাগ্রন্থ নয়। গ্রন্থটি মূলত সাধারণ পাঠকদের উদ্দেশ করে রচিত।” তবে প্রয়োজনীয় স্থানে তথ্যসূত্রের ব্যবহার এবং গবেষণার নিয়ম অনুসরণ তিনি ঠিকই করেছেন। বলা যায়, তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আকারে একটি মানসম্পন্ন গ্রন্থ উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
বখতিয়ার খলজির বাংলায় আগমনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল আগেই। সেনশাসক বল্লাল সেন কৌলিণ্য প্রথার প্রয়োগ করে সমাজে উচ্চ-নিচ বিভেদের এক দুর্লঙ্ঘ্য দেয়াল নির্মাণ করে ফেলেছিলেন। কদর্য অস্পৃশ্যতায় অপমানিত ও লাঞ্ছিত যখন সমাজের নিচস্তরে, তখন উচ্চশ্রেণির অরুচিকর যৌনতা ও নগ্নতার অভিলাষে সমাজবক্ষে এক নিদারুণ রুদ্ধশ্বাস নীরবতা। উচ্চ-নিচ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় অভিন্নতা থাকলেও উঁচুশ্রেণির ঘৃণা নিম্নশ্রেণির মানুষকে সব সময় করে রেখেছিল সঙ্কুচিত। তারা তাদের অধিকার দূরে থাক, বেঁচে থাকার চেষ্টা করার সাহস পর্যন্ত পায়নি। লক্ষ্মণ সেনের দীর্ঘ শাসন কষ্টের করুণকাল প্রলম্বিত করেছিল মাত্র। এমনই এক প্রেক্ষাপটে আগমন বখতিয়ারের।
বাংলার ইতিহাস রচিত হবে অথচ সেখানে বখতিয়ার খলজির নাম উল্লেখ থাকবে না এমনটি সম্ভব নয়। কারণ বাংলা বিজয়ের নায়ক তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলা প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে পদার্পণ করে। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলা অন্ধকার কুয়াশা পেরিয়ে আলোময় ভোরের সন্ধান পায়। অনেক ঐতিহাসিক গবেষক, কবি-সাহিত্যিক, সমালোচক বখতিয়ার খলজিকে নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন প্রচুর, সরদার আবদুর রহমানের রচনা তারই এক কৃতিত্বময় ধারাবাহিকতা। মিনহাজ-ই-সিরাজ তবকাত-ই নাসিরীর একটি অধ্যায়ে বাংলাবিজয়ী হিসেবে প্রথম তাঁকে উপস্থাপন করেছেন। তবে এ গ্রন্থটি ছিল ফারসি ভাষায়। তবকাত-ই-নাসিরীতে মিনহাজ-ই সিরাজ উল্লেখ করেছেন, “ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলা বিজয়ের পর লাখনাবতীতে রাজধানী স্থাপন করে রাজ্যের শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে মনোনিবেশ করেন। রাজ্যকে তিনি কয়েক অঞ্চলে বিভক্ত করে তাঁর সহযোগীদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এ সময়ে তিনি তাঁর আমীর উমরাহর সহযোগিতায় বাংলার বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, মকতব, মাদরাসা ও সুফি খানকাহ নির্মাণ করেন।” শুরু হয় বাংলার নবযুগে পথ চলা। এ সময় থেকেই বাংলার রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্ম মানবিক হয়ে উঠতে শুরু করে। তাই বখতিয়ার খলজির বাংলায় আগমন চরম আকাক্সিক্ষত একটি পট। নীহাররঞ্জন রায় সুদীর্ঘশ^াস ছেড়ে বলেন, “একটা বৃহৎ গভীর ব্যাপক সামাজিক বিপ্লবের ভূমি পড়েই ছিল কিন্তু কেউ তার সুযোগ গ্রহণ করেনি। মুসলমানরা না এলে কী উপায়ে কী হতো বলার উপায় নেই।” সদরুদ্দীন হাসান নিজামীর তা’জুল মাসীর, গোলাম হোসায়ন সলীমের রিয়াজউস সলাতীন, ইসামীর ফুতুহউস সলাতীন এবং জিয়াউদ্দীন বারানীর তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, আহমদ হাসান দানী, মোহাম্মদ মোহর আলী, স্যার যদুনাথ সরকার, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, আবদুল করিম, আবদুর রহীম, সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অসংখ্য লেখকের লেখায় বখতিয়ারের আলোচনা এসেছে, কিন্তু এককভাবে কোনো রচিত বই-এর সন্ধান পাওয়া যায় না।
বখতিয়ার খলজি নিয়ে বাংলা ভাষায় একক জীবনীগ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব সরদার আবদুর রহমানের। গ্রন্থটিতে বখতিয়ারের জীবনীসহ প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খাণুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ২৭২ পৃষ্ঠা তথা ১৭ ফর্মার গ্রন্থে বারোটি অধ্যায় ও একটি নির্ঘণ্ট এবং ৩৪টি রঙিন ছবি ও মানচিত্র রয়েছে। ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্পীর তুলিতে আঁকা বখতিয়ার, লক্ষ্মণ সেন, সুলতান মুহাম্মদ ঘুরী, কুতুবউদ্দিন আইবকের ছবি। এ ছাড়াও কয়েকটি মানচিত্র, কয়েকটি সমকালীন ভগ্ন মসজিদের ছবি, বিহার, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বখতিয়ার খলজির মুদ্রার আলোকচিত্র। ছবির মধ্যে সর্বাধিক আকর্ষণীয় হলো, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুরে অবস্থিত দেবকোটে বখতিয়ার খলজির মূল সমাধিকাঠামো, কবর ও পরিপাশ্বের দৃশ্যের আলোকচিত্র। এগুলি লেখক স্বচক্ষে পরিদর্শন করেছেন এবং এর বর্ণনা দিয়েছেন।
প্রথম অধ্যায় থেকে সপ্তম অধ্যায় পর্যন্ত বখতিয়ারের পরিচিতি এবং তাঁর অভিযানের বিস্তৃত বর্ণনা বিধৃত হয়েছে। বর্ণনার সুবিধার্থে গৌড়-বঙ্গের পরিচয়, সমকালীন বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট, বাংলায় আগমনের প্রেক্ষাপট, বখতিয়ারের আঠারো যোদ্ধার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা, দেবকোট প্রসঙ্গ, তিব্বত অভিযান ইত্যাদি সবিস্তৃত বর্র্ণনা রয়েছে। অষ্টম অধ্যায়ে বখতিয়ারের মৃত্যুরহস্য ও তাঁর সমাধি নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। নবম অধ্যায়ে একনজরে বখতিয়ার খলজি আলোচনায় বখতিয়ারের সহযোদ্ধাদের পরিচিতি উল্লেখ করা হয়েছে। দশম অধ্যায়ে বখতিয়ার খলজির বিভিন্নমাত্রিক মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবে লেখক চাইলে এখানেই সমাপ্তিরেখা টানতে পারতেন। দশম ও একাদশ অধ্যায়ে তিনি বাংলা ভাষা সাহিত্যে বখতিয়ারের প্রভাব নিরূপণের প্রয়াস চালিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনী, শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন, শফিউদ্দিন সরদারের বখতিয়ারের তলোয়ার উপন্যাসে বখতিয়ারের প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন। এ ছাড়াও আসকার ইবনে শাইখের নাটক অশ্বারোহী, সৈয়দ আলীর নাটক সপ্তদশ অশ্বারোহীর বঙ্গ বিজয়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতা লক্ষ্মণ-মহিমা, কবি গোলাম মোস্তফার কবিতা বঙ্গবিজয়, আল মাহমুদের কবিতা বখতিয়ারের ঘোড়া, আশরাফ আলী খানের কবিতা বখতিয়ার, মুফাখখারুল ইসলামের কবিতা বখতিয়ার খিলজী ইত্যাদি সাহিত্যকর্মে বখতিয়ারের উপস্থিতিকে তিনি তাঁর এই গ্রন্থের আলোচ্যসূচি বানিয়েছেন যা গ্রন্থটিকে একটি নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছে এবং নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে বিভিন্ন তথ্যসূত্রের বিশ্লেষণ এবং বখতিয়ারসম্পৃক্ত বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
বখতিয়ার খলজি একটি জীবন, একটি ইতিহাস। এই জীবনের ওপর নানা কোণ থেকে আলো ফেলেছেন লেখক। বখতিয়ারের পরিচয়ের সাথে সাথে তাকে নিয়ে তথ্যগত ত্রুটিবিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোও আলোচনায় এসেছে এবং সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যথার্থ তথ্য ও সূত্রের যথার্থ ব্যবহারের সাহায্যে সত্য ও যৌক্তিক অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছানোই একজন ইতিহাসবিদের দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে সরদার আবদুর রহমান চেষ্টা করেছেন। সফলতাও পেয়েছেন বলা যায়। পাঠকের কৌতূহলের প্রতিও অনেক বেশি সচেতন থেকে গ্রন্থটি রচনা করেছেন তিনি। বখতিয়ারের জীবনী নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ না থাকলেও বাংলা ভাষায় তাঁকে নিয়ে চর্চা কম হয়নি। তবে যে তা যথেষ্ট ছিলো না। সরদার আবদুর রহমানের গ্রন্থটি এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।