আঁধারে এক টুকরো আলো
আঁধারে এক টুকরো আলো - ছবি : অন্য এক দিগন্ত
ডলি আজ ভীষণ এক বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম। আমি আর পারভীন গিয়েছিলাম ত্রাণসাহায্য চাইতে। ভদ্রলোক অপ্রয়োজনীয় কথা বলে অর্থহীন সময় নষ্ট করছিলেন। একসময় তার কাছে আসা অন্যান্য লোকজনকে বিদায় করে আমাদের কাছে জানতে চাইলেন, আমরা কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছি।
: অদ্ভুত ব্যাপার তো? তারপর তুমি কী বললে?
: প্রাক্তন এমপি তো। এবার মনোনয়ন পায়নি বলে নির্বাচন করতে পারেননি। নমিনেশন দেয়নি তার দল থেকে। যাই হোক, আমাদের বলল সে যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা ডোনেট করে আমরা রিলিফ ওয়ার্কের পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত প্রচারণায় অংশ নেবো কি না। কারণ পরেও তিনি নির্বাচন করতে চান।
: তোমরা কী বললে?
: আমার মেজাজটা তো জানো। ভীষণ ক্ষেপে গেলাম। বললাম, আমরা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য কাজ করছি নিঃস্বার্থভাবে। আমাদের সংগঠন কোনো রাজনৈতিক দলের মুখপত্র নয়। কিছু দিতে চাইলে আপনাকে নিঃস্বার্থভাবেই দিতে হবে। অবশ্য মিডিয়া যদি আমাদের কাছে আসে অবশ্যই আপনার উল্লেখযোগ্য হারে দান করার বিষয়টি তাদের কাছে আমরা প্রকাশ করব। এখন আপনি ভেবে বলুন, কি করবেন। হঠাৎই তিনি ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন। এক লাখ টাকার চেক দিয়ে দিলেন লিখে। সামিরা আর তন্বী মনিরুজ্জামান স্যারকে সাথে নিয়ে চেক ভাঙিয়ে চাল, ডাল, ওষুধ আর কিছু কাপড়-চোপড় কিনে এনেছে সেই টাকায়। আমার একটু কেমন যেন লাগছে ব্যাপারটা ভাবতে।
* মিডিয়ার প্রচারণার জন্যই তিনি এটা করেছেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই টিউলিপ।
* আচ্ছা আমাদের ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পক্ষ থেকে তৈরি একটি স্বেচ্ছাসেবক টিম আমরা। কিন্তু টিম লিডার হিসেবে রেখেছি, তোমার বড় ভাইয়া মনিরুজ্জামান স্যারকে। যিনি মমিনুন্নেসায় সমাজকল্যাণ বিষয়ে পড়াচ্ছেন। এটা নিয়ে আমাদের কারো কারো মধ্যে কিছুটা সংশয় কাজ করছে। না, আমি আমার কথা বলছি না। ফ্র্যাংকলি বলছি, অন্যরা এ ব্যাপারে নানারকম প্রশ্ন তুলছে। মনিস্যার কেন আমাদের স্টুডেন্টস ত্রাণ সংস্থার প্রেসিডেন্ট? ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সিনিয়র নার্স মনোয়ারা এবং মহিলা আইনজীবী সমিতির শিরিন সুলতানা এ বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করছিলেন।
* মনিভাইয়া কেন প্রেসিডেন্ট সেটাতো অন্তত তুমি খুব ভালো করেই জানো। তার উৎসাহে এবং কর্মপ্রচেষ্টায় আমরা এতটা সক্রিয় হতে পেরেছি। তবে কোনো আপত্তি এলে সে ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারি। ভাইয়াকে কনভেনার করার যে মূল উদ্দেশ্য আমাদের তা হলো কোনো সংগঠনের কর্ণধার যদি হয় নারী, সে বিষয়ে সবার ভেতরে এক ধরনের
তাচ্ছিল্য কাজ করে। আর আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটা নিয়ে অনেক ধরনের বিরূপ আলোচনাও হয়।
* নো নো। তোমার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। সমাজের সবাই এক রকম নয়।
* সবাই না হলেও অধিকাংশই এক। কেন নৌকা নিয়ে যখন ত্রাণ পৌঁছে দাও খেয়াল করোনি অন্যান্য ত্রাণ সংগঠনের ছেলেরা তোমাদের দেখে কেমন টিজ করে? কেমন বাঁকা হাসি হাসে? ভাইয়া তো এই দায়িত্ব নিতে চায়নি। তোমরাই তখন তাকে বাধ্য করলে, আর এখন প্রশ্ন তুলছো?
* আমি আগেই বলেছি ডলি, প্রশ্নটা আমার নয়, অন্যদের। আমি বরং একটা প্রস্তাব দিতে চাই। দেখো গ্রহণযোগ্য মনে হয় কি না। মনিভাইয়া আমাদের প্রধান উদ্যোক্তা হবেন। আমাদের অন্যান্য সবার দায়িত্ব ঠিকই থাকবে, তুমি ভাইস প্রেসিডেন্ট না থেকে প্রেসিডেন্ট পদটি গ্রহণ করো। আমরা সবাই এতে একবাক্যে সমর্থন দেবো।
* হাউ ফানি! আমরা কি শুধু সংগঠন করে তার ক্ষমতা ভাগাভাগির প্ল্যানিং করছি? কে কোন পদে আছি সেটা তো মুখ্য বিষয় নয়। দেশ ভাসছে বন্যার পানিতে, আমরা কেন অর্থহীন সময় নষ্ট করছি?
* ভুল বুঝছো ডলি। আমরা বিষয়টি সেভাবে নিইনি। উত্তরা মহিলা মেডিক্যালের তিন্নি, ঢাকা মেডিক্যালের নাইমা, বুয়েটের মিশু সবাই বলেছে, আমরা মেয়েরা যে সংগঠনের সবকিছু তার মূল দায়িত্বে থাকবে একজন মেয়ে, তোমাকে তারা সেখানে দেখতে চায়। আজ সন্ধ্যায় যে মিটিং হবে, তাতে আমাদের প্রস্তাব থাকবে তুমিই হবে স্টুডেন্টস ত্রাণ সংস্থার আহ্বায়ক। প্লিজ আপত্তি করো না ডলি। মেয়েরাও ঐক্যবদ্ধভাবে বিপদ মোকাবেলায় কিছু করতে পারে, আমরা তার প্রমাণ দিতে চাই।
* বেশ, তোমরা যখন বলছো, আমার আর কিইবা বলার আছে! ভাইয়াকে তো এ ব্যাপারে জানাতে হবে।
* ভালো কথা বলেছ। ইতোমধ্যেই মনিস্যারের সাথে আমরা কথা বলেছি। তার কোনো আপত্তি নেই।
* বেশ, তাহলে আর আমার কিছু বলার নেই।
* আচ্ছা আমি তাহলে আসি। সন্ধ্যায় আমাদের দেখা হচ্ছে মিটিংয়ে।
* হ্যাঁ, ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।
* আল্লাহ হাফেজ।
সন্ধ্যার মিটিংয়ে ডলিকে প্রেসিডেন্ট করে স্টুডেন্টস ত্রাণ সংস্থার কিছু উপকমিটি গঠিত হলো। এর মধ্যে বুয়েটে দায়িত্বে থাকল মিশু, ঢাকা মেডিক্যালে নাইমা, উত্তরা মহিলা মেডিক্যালে তিন্নি আর দেশের অন্যান্য এলাকার সাব কমিটিগুলোতে একজন করে মেয়ে মূল দায়িত্বে থাকল। এই সংগঠনের অতিথি সদস্য হিসেবে মহিলা ডাক্তার, আইনজীবী, নার্স এবং কৃষিবিদ মহিলাদেরও রাখা হলো। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রিক মিডিয়া থেকেও চারজন নারী সদস্যকে এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে।
ডলিরা আপাতত বন্যার কারণে ক্লাস এবং পরীক্ষাগুলো স্থগিত থাকায় পুরোদমে তাদের ত্রাণকর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকল। ওদের প্রতিটি কাজ নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হচ্ছিল। এ কারণে কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়নি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সচ্ছল ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ পোশাক, খাদ্য যাই-ই পাচ্ছে তারা তার সমন্বয় ঘটিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে নির্দিষ্ট এলাকায় ইতোমধ্যেই ওরা দেশের কিছু কিছু দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে ত্রাণ দিতে এমনভাবে দিচ্ছে, যেন এক মাসের মধ্যে আর তাদের সাহায্য না গেলেও চলে। নিরাপত্তার সুবিধার জন্য যে থানায় তারা ত্রাণ দিচ্ছে, সেখানে পৌঁছে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চাইছে। সহযোগতিা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা পাচ্ছে। কোনো কোনো থানা নির্বাহী কর্মকর্তা তাদের নৌকায় একজন করে পুলিশ বাহিনীর সদস্য দিচ্ছেন। সাব কমিটির সদস্যরা ঢাকা থেকে আগত সদস্যদের আবাসিক সুবিধার দিকে সযত্ন খেয়াল রাখায় তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না। যেসব জায়গায় তারা সরকারি প্রশাসন থেকে নিরাপত্তাজনিত সহযোগতিা পাচ্ছে না, সেখানে তাদের বন্ধু তায়কোয়ানডো প্রশিক্ষক- নেপাল থেকে ব্ল্যাকবেল্ডপ্রাপ্ত, মরিয়ম বেগম ইতি বা তার সেরা ছাত্রীদের নিয়ে যাচ্ছে। জুডোতে এরা সবাই এক্সপার্ট। এতটা সতর্কতা সত্ত্বেও ওদের ছোটখাটো কিছু না কিছু সমস্যা হচ্ছিল, স্পিড বোডে যেতে গিয়ে একবার প্রচণ্ড বাতাসের তোড়ে উল্টে গিয়েছিল ওদের বোট। পানি মোটামুটি অগভীর থাকায় চাল ডালের বস্তা ওরা উদ্ধারে সক্ষম হয়। সাঁতার জানে না এমন দু’জন মেয়েকে নিয়ে এক সপ্তাহ যমে মানুষে টানাটানি চলছে। প্রচুর ময়লা পানি পেটে যাওয়ায় ওদের এক সপ্তাহ হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল।
শেষ দুর্ঘটনাটা যেদিন ঘটল, পরদিন প্রতিটি দৈনিকে লিড নিউজ হিসেবে ছাপা হলো। বন্যাদুর্গত এলাকায় ডলিরা এবার পোশাক আর ওষুধ নিয়ে যাচ্ছিল। বগুড়া ভেঙে যাওয়া বাঁধের কাছাকাছি একটি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল তাদের গন্তব্য। মোটামুটি বড় একটা স্পিড বোট ভাড়া করে ওদের সাবকমিটির দায়িত্বশীলরা যাচ্ছিল এক সাথে। ডলি এবং ইতিও ছিল। থানা প্রতিনিধি হিসেবে একজন নিরাপত্তা কর্মীও ছিল সাথে। হঠাৎই শোনা গেল প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ। পাশের একটি বড় নৌকায় সাতজন নিষ্ঠুর চেহারার যুবক ও মাঝবয়সী দু’জন লোক গাদাগাদি করে বসে আসে। প্রত্যেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। গুলির আওয়াজটা এসেছে সেখান থেকেই। প্রথমে গুলিবিদ্ধ হয়েছে ডলিদের গেটের নিরাপত্তা কর্মী। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ওরা সবাই। রক্তে ভেসে গেল স্পিড বোডের পাটাতন। ত্বরিৎ গতিতে কাছে চলে এলো অস্ত্রধারীদের ইঞ্জিন লাগানো রক্তাক্ত দেহগুলো একটি একটি করে পানিতে ছুড়ে দিলো।
এরপর নৌকা এবং স্পিড বোট নিয়েই ওরা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। হতভম্ব বানভাসি মানুষ নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল এই নির্মম দৃশ্য। কিছুই করার ছিল না তাদের। অশ্রুভেজা মুখ শাড়ির আঁচলে ঢেকে কাঁদছিল গৃহবধূরা। কেউ কেউ বুকের সন্তানকে জোরে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছিল। কিন্তু বিস্ময়ের স্তব্ধতা কেটে যেতে না যেতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। তবু রক্তাক্ত নিথর দেহগুলো খুঁজে পেতে তিনটা দিন সময় লেগেছিল। যার যার পরিবারের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হলো। কারণ পানি থেকে তোলার পর তাদের কারো ভেতর আর প্রাণের কোনো স্পন্দন খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ-ই ধরতে পারেনি এটা কার কাজ। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নাকি কোনো রাজনৈতিক দল? কারণ, স্টুডেন্টস ত্রাণ সংস্থা ইতোমধ্যেই একটি নিরপেক্ষ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অনেক রাজনৈতিক সংগঠন সেটাকে ভালো চোখে দেখেনি। তেমনি ত্রাণসামগ্রী ছিনতাইয়ের ঘটনাও প্রতিনিয়ত যেভাবে ঘটছে, তাতে সন্ত্রাসীদের অপকর্ম হিসেবেও কেউ কেউ বিষয়টিকে দেখছিলেন। কিন্তু সারা দেশব্যাপী স্টুডেন্টস ত্রাণ সংস্থার সদস্যরা নিশ্চুপ ছিল না। তারা নিজস্ব উদ্যোগে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
দাবি জানায় এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের। পাশাপাশি তাদের ত্রাণ কর্মকাণ্ডকে তারা চালাতে থাকে। কিন্তু তাদের বুকের ভেতর যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, ডলি, টিউলিপ, নাইমা, মিশুদের পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে এটাতো কোনোদিনই পূরণ হওয়ার নয়। নিরাপত্তাহীন দেশে, নিরাপত্তাহীন সমাজে তবুও ইতিদের আত্মত্যাগকে স্মরণে রেখে স্টুডেন্টস ত্রাণ সংস্থা তাদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রলোভন আর সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে পারার পেছনে মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে কতগুলো মহৎপ্রাণের আত্মদান। তবু প্রতিনয়তই তারা বাধার সম্মুখীন হয়। আসলে প্রতিকূলতা অতিক্রম না করে কোনো ভালো কিছুই তো অর্জন করা সম্ভব নয়।