শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান সম্পর্কে নানা সমীকরণ
শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান সম্পর্কে নানা সমীকরণ - ছবি সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসের আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। ক্ষমতায় এসে তার এটি প্রথম লঙ্কা সফর। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি লেখাপড়া শেষ করে ক্রিকেটের ময়দানে যাই, আর আপনি (মাহিন্দ রাজাপাকসে) রাজনীতির ময়দানে যাত্রা করেন।’ সফরের আগেই উপমহাদেশে এই সফর উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি ভারতের সাথে কলম্বো বন্দরের একটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি বাতিল করার পর শ্রীলঙ্কার সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় খানের সফর নতুন মাত্রা পায়। ২০১৯ সালে কলম্বো বন্দরের পূর্বপ্রান্তে একটি টার্মিনাল স্থাপনে ভারত ও জাপানের সাথে চুক্তি করেছে শ্রীলঙ্কা। এর আওতায় টার্মিনালের ৪৯ শতাংশ মালিকানা ভারত ও জাপানের হাতে এবং বাকি ৫১ শতাংশ শ্রীলঙ্কার হাতে থাকবে বলে ঠিক হয়েছিল। ২৩টি শ্রমিক সংগঠন, বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষ চুক্তির বিরোধিতা করায় সরকার সেটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। শ্রীলঙ্কার এই সিদ্ধান্তে কূটনৈতিকভাবে দিল্লি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বলে আনন্দবাজার পত্রিকা অভিমত দেয়।
ইমরান খানের এই সফরে আনুষ্ঠানিক চুক্তির চেয়ে অনানুষ্ঠানিক ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে এবং উপমহাদেশের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। যেমন, জনাব খানের এই সফরের কারণে মুসলমানদের কোভিড মহামারীতে মৃত লাশ শ্রীলঙ্কায় পোড়ানোর ইতি ঘটেছে, বিমানবন্দরে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়, যা লঙ্কার ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা, পাকিস্তানের ‘সিপিইসি’র সাথে সংযোগ, শ্রীলঙ্কার সেনাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও পাকিস্তানি সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি, বৌদ্ধদের জন্য পাকিস্তানের বৌদ্ধ স্থাপনাগুলোকে পর্যটনের বিশেষ সুবিধা প্রদান, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থায় শ্রীলঙ্কার সদস্যপদের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন, মুসলমান ও বৌদ্ধদের সম্প্রীতির সূত্রপাত, নতুন নতুন পণ্যের আমাদানি-রফতানি, পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কার চায়ের বাজার সম্প্রসারণ, মধ্য এশিয়ার সাথে পাকিস্তান হয়ে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য সম্প্রসারণ, লঙ্কায় পাকিস্তানি ক্রীড়া সামগ্রীর বাজার সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ- এসব বিষয় এই সফরের ফসল। উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাবমর্যাদা এ সফরের ফলে উজ্জ্বল ও সমুন্নত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার সাথে সুসর্ম্পক রক্ষা এবং ‘কোয়াডের’ দলে ভেড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে চীন লঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে ঘাঁটি গড়া শুরু করলে ভারতও অনুরূপ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হয়; জাপানও যোগ দেয় নবপ্রযুক্তি নিয়ে। চীন ও কোয়াডের মাঝে শ্রীলঙ্কার এই রশি টানাটানির প্রেক্ষাপটে ইমরান খানের এই সফর ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিকে পরিবর্তন করে ফেলেছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২৯ অক্টোবর, ২০২০ মুসলিম প্রধান দেশসমূহে খোলাপত্র পাঠিয়ে আশা ব্যক্ত করেন, ইসলামোফোবিয়া ও সন্ত্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি মূলত ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর ইসলামবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে এবং অমুসলিম দেশে মুসলমানদের বসবাসের বিষয়ে মুসলমানদের সমস্যা উত্তরণে যৌথভাবে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। বিভিন্ন দেশে গোষ্ঠীগতভাবেও মুসলমানরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, ধর্মীয়ভাবেও হচ্ছে। জনাব খান মনে করেন। এসব অনেক বিষয়ে মুসলিমদেশগুলো আলোচনার মাধ্যমে সহজে ইতি টানতে পারে।
কোভিড-১৯ মহামারীতে মৃত মুসলমানদের পুড়িয়ে সৎকার করার নির্দেশ লঙ্কা সরকার জারি করেছিল। ২০ মার্চ ২০২০ লঙ্কার নিগম্বোতে প্রথম একজন মুসলমান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জোরপূর্বক বাড়ি থেকে এই মৃতদেহ নিয়ে সেটিকে পুড়িয়ে সৎকার করে ফেলেন। এতে পরিবার পরিজন শরিয়তের বিধানগুলোও প্রতিপালন করতে ব্যর্থ হয়। এই ঘটনার পর রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে আদেশ জারি করেন যে, কোভিডে মৃত যে-ই হোক না কেন তাকে দাহ করতে হবে। তার মতে, কোভিড মৃতদেহ মাটির নিচের পানি ভাইরাসে দূষিত হয়; ‘পড়হঃধসরহধঃব ঃযব মৎড়ঁহফধিঃবৎ’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়ায় এমন কোনো প্রমাণ তাদের হাতে নেই। মুসলমানদের লাশ পোড়ানোর আদেশ দিয়ে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রবল চাপের মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কা। তবে ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাস জড়িত থাকা সত্ত্বেও এই আদেশ রহিত করা হয়নি।
লঙ্কা সরকারের বক্তব্য হলো; স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটির অভিমত অনুসারে বিধানটি প্রতিপালিত হচ্ছে। কিন্তু ওই কমিটিতে কোনো ভাইরোলজিস্ট বা জীবাণু বিশারদ সদস্য ছিলেন না। সরকারি আদেশটি প্রফেসর টিসা ভিতারানা প্রচার করেন। তিনি একই সাথে জানান যে, কমিটিতে কোনো ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নেই। একজন ব্যাকটেরিয়া বিশেষজ্ঞ বা ভাইরাসবিদ ছাড়া কিভাবে টেকনিক্যাল কমিটি গঠিত হতে পারে আর এমন এক স্পর্শকাতর বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে তা বোধগম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে সিংহলি বৌদ্ধদের জন্য নানা কর্মসূচি নিয়েছেন। অবস্থা দেখে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীকে সিংহলি বৌদ্ধদের খুশি করার জন্য টেকনিক্যাল কমিটি এমন আজব সিদ্ধান্ত নেয়।
সফর শেষে ইমরান খান যেদিন ফিরে যান তারপর দিনই ২৫ ফেব্রুয়ারি-২০২১, প্রায় ১১ মাস পর, লঙ্কা সরকার আবশ্যিকভাবে দাহ করার বিধান রহিত করে জরুরি গেজেট প্রকাশ করেছে। গেজেটে দাহ অথবা কবর দেয়া ‘ঈৎবসধঃরড়হ ড়ৎ নঁৎরধষ’ সংযুক্ত করা হয়। এতে মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব সংস্থা থেকে শুরু করে ওআইসি, আরব লিগ বা কোনো মানবাধিকার কমিশনসহ কেউ ইসলামী বিশ্বাস ও শরিয়তবহির্ভূত এই বিষয়টির সুরাহা করতে পারেনি বা করেনি। ইমরান খানের দু’দিনের সফরে সেই জটিল বিষয়টি সুন্দরভাবে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ সমাধা করল। একই সাথে, শ্রীলঙ্কান মুসলমানদের কাছেও ইমরান খান স্মরণীয় হয়ে রইলেন। শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে বিভিন্ন জাতিসত্তা, বিভিন্ন ধর্মের সামাজিক বন্ধন, বিভিন্ন ভাষা ও বিভিন্ন সংস্কৃতির ঐতিহ্যের বন্ধনকেও সংহত করতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধ অনুভূতিকেও সম্মান জানাতে হবে। সামাজিক বন্ধনের বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে সেটি ফিরিয়ে আনা কঠিন।
জনাব ইমরানের সফরে দেশ দুটি পাঁচটি চুক্তি সম্পাদন করে। ১. পর্যটন খাতে সহযোগিতা; ২. উভয় দেশের বিনিয়োগ বোর্ডের সম্পর্ক ও সহযোগিতা বৃদ্ধি; ৩. শ্রীলঙ্কার ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের সাথে পাকিস্তানের করাচিস্থ কেমিক্যাল ও বায়োলজির আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের সম্পর্ক ও সহযোগিতা; ৪. শ্রীলঙ্কার ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট ও ঈঙগঝঅঞঝ বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামাবাদের মাঝে সম্পর্ক ও সহযোগিতা এবং ৫. কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে লাহোর স্কুল অব ইকোনমিক্সের সম্পর্ক বিষয়ক চুক্তি।
গত বুধবার ২৪ ফেব্রুয়ারি ইমরান খান শ্রীলঙ্কার ব্যবসায়ী মহলকে দাওয়াত দিয়ে খোলামেলা আলাপ করেন; পাকিস্তানে বিনিয়োগ করার ও ‘ট্রেড কানেকটিভিটি’ বাড়ানোর কথা বলেন। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য সম্প্রসারণে পাকিস্তান কর্তৃক সার্বিক সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দেন। তিনি জানান, গোয়াদর থেকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সংযোগ এবং সিইপিসি শ্রীলঙ্কার জন্য নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে। এটি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ব্যবসা ও যোগাযোগের নতুন ক্ষেত্র বের করার জন্যও তিনি উভয় দেশের বাণিজ্য কমিউনিটিকে অনুরোধ জানান। উভয় দেশ সম্পদ বাড়ানোর কাজে একে অপরকে বাণিজ্যিক সহযোগিতা করতে পারে। দারিদ্র্য দূরীকরণ ও উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থায়িত্ব এবং পড়শি দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক জরুরি বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
তিনি আরো বলেন, উভয় দেশ টেররিজমের শিকার। পাকিস্তান বিগত ১০ বছর ধরে এবং শ্রীলঙ্কা ৩০ বছর ধরে এতে ভুগেছে। এখন উন্নয়নের সিঁড়িগুলো পার পেতে হবে। জনাব খান বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের পর্যটন খাত খুবই সমৃদ্ধ এবং এটিকে ব্যবহার করতে হবে।’ এর আগে পাকিস্তান শিখদের জন্য কারতারপুর গুরুদোয়ারা তৈরি করে বিশ্ব শিখ জনগোষ্ঠীর কাছে নন্দিত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘বৌদ্ধদের অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা পাকিস্তানে রয়েছে। শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধরা সেগুলো পরিদর্শনে যেতে পারেন। প্রয়োজনে সেগুলোর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে।’ উদাহরণস্বরূপ জনাব খান তক্ষশীলা, গান্ধারা, মোহেনজোদারো, জোলিয়ান (সাধু) মঠের উদাহরণ দেন। তিনি জানান, গান্ধারার খনন কাজ অসমাপ্ত। অধুনা খনন কাজ চালিয়ে ৪০ ফুট দীর্ঘ ঘুমন্ত গৌতম বুদ্ধের মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, যা বৌদ্ধদের জন্য নতুন আকর্ষণ সৃষ্টি করবে।
ইমরান খান সফরের শেষ পর্যায়ে শ্রীলঙ্কাকে সামরিক খাতে ৫০ মিলিয়ন ডলারের ‘ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি’ দেয়ার ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার সাথে পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক পুরনো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার সাথে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। ‘কোয়াড’কে পাশ কাটিয়ে ‘চীন-শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান’ কোনো জোট হলে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই এই সফর ইমরান খানের কৌশলী এবং সফল। রাজনৈতিক বিজয়ের এক ফসল। ২০০০ সালে তামিল বিদ্রোহীরা হামলা চালিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে সরকারি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে, তখন পাকিস্তান মাল্টি ব্যারেল রকেট লান্সার পাঠায় এবং বিমানবাহিনী লঙ্কার সেনাদের উদ্ধার করে। তামিল যুদ্ধের সময় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল শরথ ফনসেকা পাকিস্তান সফর করেন এবং ২২টি আল খালিদ ট্যাংকসহ ১০০ মিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার চুক্তি করেছিলেন।
এলটিটিইর রাজনৈতিক সদর দফতর কিলিনোচ্চি দখলের লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর অনুরোধে ১০ দিন পরপর জাহাজ বোঝাই সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল পাকিস্তান। তাছাড়া শ্রীলঙ্কার অনুরোধে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর পাইলটরা যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয় তুলে আনেন। তখন পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞরা গৃহযুদ্ধে পরামর্শ দিতে কলম্বোতে অবস্থান করতেন। শ্রীলঙ্কা সামরিক সহায়তার জন্য ভারত ও চীনকে অনুরোধ করেছিল; কিন্তু তারা রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানকে অনুরোধ করা হয় বলে ফনসেকা মিডিয়ায় জানান। অনেক বছর ধরে লঙ্কান সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে কলম্বোকে সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তান।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ‘ক্রীড়া কূটনীতি’কে এই সফরে ব্যবহার করেছেন। তিনি ক্রীড়া কমিউনিটির সাথে ইন্টারঅ্যাকটিভ সেশনে কথা বলেছেন। জনাব খান শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট টিমের ভূয়সী প্রশংসা করে জানান যে, পাকিস্তানের মাটিতে লাহোরে শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ জিতেছে, এটি উভয় দেশের জন্য আনন্দের বিষয়। ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ভয় পেলেন তো হেরে গেলেন।’
সংলাপে লঙ্কার ক্রীড়া ও যুব মন্ত্রী নমল রাজাপাকসে এবং পার্লামেন্ট স্পিকার মাহিন্দা জাপা বর্ধনা ছিলেন। তারা কলম্বোতে ‘ইমরান খান হাই পারফরমেন্স স্পোর্টস সেন্টার’ নির্মাণের ঘোষণা দেন। জনাব খান শ্রীলঙ্কায় ৫২ মিলিয়ন ডলারের ক্রীড়া সামগ্রী ও প্রশিক্ষণ প্যাকেজ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, পাকিস্তানের সিয়ালকোট উপমহাদেশে উন্নতমানের ক্রীড়া সামগ্রী তৈরি করে থাকে যা বিশ্ববাজারেও নন্দিত। এই সেশনটি এত বেশি অর্থবহ হয় যে, উভয় দেশে আন্তঃধর্ম আলাপ আলোচনা শুরু করা এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়ানোর দাবি উঠায়। বহু দিন ধরে ‘ইস্টার সানডে’ ঘটনা নিয়ে মুসলিমবিরোধী যে কর্মকাণ্ড সমাজজীবনকে আক্রান্ত করেছে, এই আলোচনা তার বদলে মুসলিম ও সিংহলি বৌদ্ধদের সহাবস্থান ও সহমর্মিতা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে মনে করা হচ্ছে। উগ্রবাদী সিংহলি গোষ্ঠীগুলো বিদ্বেষ ছড়ানোর পথ অনেকটা রুদ্ধ হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই সফর ‘খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে’ বলে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন। সফরটি নিরাপত্তা সেক্টরকে উজ্জীবিত করেছে। সুপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাব বজায় রাখা এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একজোট হয়ে কাজ করার শপথ এই মুহূর্তে উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দুটি দেশ নিরাপত্তা, টেররিজম ও সংঘবদ্ধ অপরাধ, মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে যৌথভাবে কাজ করার অঙ্গীকারও করেছে। এজন্য দুটি দেশ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়কে আরো গতিশীল করছে।
মানবাধিকার, শ্রেণিবৈষম্য, যুদ্ধাপরাধ এসব নিয়ে যখন শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রয়েছে তখন, আন্তর্জাতিক বলয়ে পাকিস্তানের সমর্থন বা প্রকারান্তরে চীনের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সফরের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, তামিল যুদ্ধপরাধ নিয়ে জাতিসঙ্ঘ কোনো প্রস্তুতি নিলে চীন ও রাশিয়ার ভেটো দেয়ার সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। ইমরানের সফর এজন্য কূটনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উভয় নেতা মনে করেন, সার্ক সনদ অনুযায়ী সার্কভুক্ত দেশগুলোকে আরো শক্তিশালী ভূমিকা নিতে হবে। আঞ্চলিক ঐক্য ও উন্নয়নের জন্য সার্কের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। জনাব খান আঞ্চলিক কনেকটিভিটি ‘সিপিইসির’ ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি জানান এটি পাকিস্তানে চীনের বিআরআইয়ের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি শ্রীলঙ্কাকে এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার