কুরআনের ৫ নির্দেশনা
কুরআনের ৫ নির্দেশনা - ছবি সংগৃহীত
বলা হচ্ছে, ‘আমি আমার বান্দার প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি, সেটা যে আল্লাহরই পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে, তবে তোমরা তোমাদের সব সহযোগীকে সাথে নিয়ে এ ধরনের কোনো একটি সূরা রচনা করে দেখিয়ে দাও! আর যদি এ রকম করতে না পারো, তাহলে জেনে নিও, বস্তুত এ বাণী কোনো মানুষের প্রচেষ্টার ফল নয়, বরং তা আল্লাহর বাণী।’ মানুষের কল্যাণে কুরআন সবসময়ই নিয়োজিত। নিচে কুরআনের পাঁচটি নির্দেশনার কথা উল্লেখ করা হলো-
১. গভীর চিন্তা এবং চেতনায় উৎসাহ প্রদান : কুরআন সর্বপ্রথম নির্দেশনা হলো, সব বিষয়ে গভীর চিন্তা পথপ্রদর্শন করতে পারে। আর বিভ্রান্ত ও মূর্খরাই পথভ্রষ্ট হয়। বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম জীব কালা ও বোবা; যারা কিছুই বোঝে না।’ (সূরা আনফাল-২২) এ কথাটিকেই কুরআনের অন্যত্র এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ, ‘তাদের হৃদয় আছে; কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দর্শন করে না এবং তাদের কর্ণ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শ্রবণ করে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তা অপেক্ষাও অধিক বিভ্রান্ত! তারাই হলো উদাসীন।’ (সূরা আরাফ ৭:১৭৯)
‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩৬) অর্থাৎ, যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তার পেছনে পড়ো না। আন্দাজে কথা বলো না। কারো প্রতি কু-ধারণা করো না।
২. সকল ফলপ্রসূ চিন্তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করা : দর্শনীয় পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ফলপ্রসূ কার্যকলাপকে গ্রহণ না করে কুরআন নির্দেশ দেয় যে- ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয় অনেক পণ্ডিত-পুরোহিত মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায় উপায়ে ভক্ষণ করে এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।’ (সূরা তাওবা-৩৪)
এটা এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কথাকে খুব সুন্দর করে পেশ করার দক্ষতা রাখে। এ থেকে উদ্দেশ্য নাসারা উলামা। কারো কারো কাছে এ থেকে উদ্দেশ্য হলো, নাসারাদের সুফিরা। এই উভয় শ্রেণীর ধর্মধ্বজিরা এক তো আল্লাহর কালামকে বিকৃত ও পরিবর্তিত করে লোকদেরকে তাদের ইচ্ছা মোতাবেক ফতোয়া ও বিধান দিত এবং এভাবে তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দিত। আর দ্বিতীয়ত, এই পন্থায় তারা তাদের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করত; যা তাদের জন্য হারাম ও বাতিল ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, বহুসংখ্যক মুসলিম উলামার অবস্থাও ওদের মতোই।
৩. সামাজিক ন্যায় এবং সমতা উন্নত করা : ইসলাম নির্দেশ দেয় সর্বাত্মক চেষ্টা করে হলেও সমতার এবং ন্যায়বিচারের। সমাজ, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক বিচার ও ফায়সালা করাই কুরআনের নির্দেশনা।
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকো, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দাও; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীনই হোক, আল্লাহ উভয়েরই যোগ্যতর অভিভাবক। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে খেয়ালখুশির অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা পাশ কেটে চলো, তাহলে (জেনে রাখো) তোমরা যা করো আল্লাহ তার খবর রাখেন।’ (সূরা নিসা-১৩৫)
এই আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমানদারকে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করার এবং ন্যায় অনুযায়ী সাক্ষ্য দেয়ার প্রতি তাকিদ করছেন, যদিও তার কারণে তাকে অথবা তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদেরকে ক্ষতির শিকার হতে হয় তবুও। কেননা, সব কিছুর ওপর সত্যের থাকে কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য। কোনো ধনবানের ধন এবং কোনো দরিদ্রের দারিদ্র্যতার ভয় যেন তোমাদেরকে সত্য কথা বলার পথে বাধা না দেয়। বরং আল্লাহ এদের তুলনায় তোমাদের অনেক কাছে এবং তাঁর সন্তুষ্টি সবার ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ, প্রবৃত্তির অনুসরণ, পক্ষপাতিত্ব অথবা বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার করতে বাধা না দেয়। যেমন- মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনো সুবিচার না করাতে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করো।’ (সূরা মায়িদা ৫:৮) এই আয়াতে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রতি তাকিদ করা হয়েছে এবং এর জন্য যা যা প্রয়োজন তার প্রতি যতœ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন- সর্বাবস্থায় সুবিচার প্রতিষ্ঠা কর, তা থেকে পাশ কাটিয়ে যেয়ো না এবং কোনো তিরস্কারকারীর তিরস্কার অথবা অন্য কোনো চাপ বা প্রবর্তনা যেন এ পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। বরং এর প্রতিষ্ঠার জন্য তোমরা একে অন্যের সাহায্যকারী হও। তোমাদের কেবল লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। যেহেতু এ রকম হলে পরিবর্তন, হেরফের এবং গোপন করা থেকে তোমরা বিরত থাকবে। ফলে তোমাদের বিচার-ফায়সালা ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষতি যদি তোমার অথবা তোমার পিতা-মাতার কিংবা তোমার আত্মীয়স্বজনের ওপর আসে, তবুও তুমি কোনো পরোয়া না করে নিজের ও তাদের স্বার্থরক্ষার তুলনায় সুবিচারের দাবিসমূহকে অধিক গুরুত্ব দাও। (ইবনে কাসির)
৪. ইসলামী বিশ্বাসে কার্যকরভাবে অনুবর্তী হওয়া : হজরত মুহাম্মদ সা:-কে ইসলামের দিকনির্দেশনার জন্য পাঠিয়েছেন। যাতে করে সবাই তাঁর জীবন অনুসরণ করে সহজেই ইসলামের আলোকে আলোকিত হতে পারে। আর শুধু মুখে ঈমান এনেছি বললেই ইসলাম পালন করা হয় না। তাই কুরআনের নির্দেশনা হচ্ছে- কার্যকারিতার মাধ্যমেই ইসলাম বা ঈমানের প্রতিটি পদক্ষেপ দিতে হবে।
“মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা বিশ্বাস করি’ এ কথা বললেই ওদেরকে পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেয়া হবে?” (সূরা আনকাবুত-০২) অর্থাৎ, মৌখিকভাবে ঈমান আনার পর তাদের কোনো পরীক্ষা না নিয়েই এমনি ছেড়ে দেয়া হবে; এই ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। বরং তাদের জানমাল, বিপদ-আপদ দিয়ে এবং অন্যান্য সমস্যা দিয়ে পরীক্ষা নেয়া হবে, যাতে আসল-নকল, সত্য-মিথ্যা এবং মুমিন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়।
৫. যে কেউ সত্যপথের পথিক হতে অগ্রসর হতে পারে : এই নির্দেশনায় কুরআন বলে যে, কুরআন হচ্ছে ফুরকান। এই কুরআন সত্য-মিথ্যার পথ বলে দেয়। আর তাই যেকোনো পথিক এর মাধ্যমে সঠিক পথ পেয়ে যাবে। শুধু সঠিক বিশ্বাসই নয়, বরং সবার জন্য এতে উপদেশ রয়েছে।
‘যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গেই থাকেন।’ (সূরা আনকাবুত-৬৯) অর্থাৎ, যারা আমার (সন্তুষ্টির পথে) দ্বীনের ওপর আমল করতে কষ্ট, পরীক্ষা এবং সমস্যার সম্মুখীন হয়। এর অর্থ হলো- দুনিয়া ও আখিরাতের ওই সকল পথ, যেসব পথে চললে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।
লেখিকা : গবেষক