দশ রুপি
দশ রুপি - ছবি : অন্য এক দিগন্ত
সে একটা গলির মোড়ে মেয়েদের সাথে খেলা করছিল আর তার মা বহুতল একটা পুরনো বিল্ডিংয়ের মধ্যে তাকে খোঁজাখুঁজি করছিল। শারিতার মা কিশোরীকে বসতে বলেছিল, তারপর বাইরের চায়ের দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে তার মেয়েকে বিল্ডিংয়ের তিনটি তলায় খুঁজতে লেগেছিল। কিন্তু কেইবা জানে শারিতা কোথায় দৌড়াদৌড়ি করছে। এমনকি সে খোলা টয়লেটেও ছুটে গিয়েছিল এবং ‘শারিতা! হেই শারিতা!’ বলে ডাকাডাকি করেছিল। কিন্তু সে বিল্ডিংয়ের কোথাও ছিল না। তার মায়ের সন্দেহ হয়েছিল সে টয়লেটে গিয়ে থাকতে পারে কারণ তার ডিসেন্ট্রি হয়েছে। আসলে সে পৃথিবীর কিছুই পরওয়া না করে আবর্জনা-স্তূপের কাছে গলির মোড়ে খেলা করে যাচ্ছিল।
শারিতার মায়ের মন খুব খারাপ ছিল। কিশোরী ভেতরে বসেছিল এবং সে আগেই বলেছিল তিনজন ধনীলোক নিকটবর্তী শপিং মার্কেটে গাড়ির মধ্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু শারিতা হাওয়া হয়ে গেছে। শারিতার মা জানতো যে, গাড়ি চড়া ধনী লোকেরা সবসময় আসে না; সত্যি বলতে কি, কিশোরীকে ধন্যবাদ দিতে হয় কারণ তারই বদৌলতে মাসে একবার কি দু-বার সে ভালো খরিদ্দার পায়; তা না হলে এরকম নোংরা পরিবেশে কোনো ধনী লোকই আসত না যেখানে সবসময়ই পচা দুর্গন্ধ নাকে এসে বাড়ি মারে। কী করে ধনী লোকেরা এরকম নোংরা পরিবেশে এসে দাঁড়ায়? কিন্তু কিশোরী ছিল বুদ্ধিমান। সে কখনোই মানুষকে এ জংধরা বিল্ডিংয়ের ত্রিসীমানায় আনেনি। বরং শারিতাকে সুন্দর পোশাকে সাজিয়ে সে এখান থেকে বের হয়ে যেত; গিয়ে তাদের বলত, ‘স্যার, সবকিছু ইদানীং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। পুলিশ সবসময় ওঁৎ পেতে আছে কাউকে না কাউকে ধরার জন্যে। এরই মধ্যে তারা দুইশো মেয়ে ধরে ফেলেছে। এমনকি আমাকে পর্যন্ত কোর্টে হাজিরা দিতে হচ্ছে। আমাদের সবাইকে খুব সাবধান হতে হবে।’
শারিতার মা খুব রেগে গিয়েছিল। সে যখন সিঁড়ির মাঝখানে এসে পৌঁছল, রাম দাই তখন বসে বসে বিড়ির পাতা কাটছিল। ‘তুমি কি শারিতাকে কোথাও দেখেছ?’ শারিতার মা তাকে বলল, ‘আমি জানি না সে কোথায় গেছে। যদি তাকে খুঁজে পাই, পিটায়ে তার চামড়া তুলে নেবো। সে আর ছোট মেয়েটি নেই। তারপরও সে সারাদিন ওইসব অপদার্থ ছেলেগুলোর সাথে দৌড়ে বেড়ায়।’
রাম দাই বিড়ির পাতা কেটেই চলল। সে তার কথার কোনো উত্তর দিলো না। কারণ সে জানে শারিতার মা প্রায়ই এ ধরনের কথা আওড়িয়ে থাকে। সপ্তাহের তৃতীয় কি চতুর্থ দিন সে শারিতাকে খুঁজে বেড়ায় এবং একথাগুলোই রাম দাইকে সে শোনায় কারণ সে সিঁড়ির কাছে বসে সারা দিন বাড়ির পাতা কাটে।
এ কথার সাথে এ বিল্ডিংয়ের মহিলারা সবসময় শারিতার মায়ের কাছ থেকে আরো শোনে কিভাবে সে শারিতাকে একজন সম্মানিত লোকের সাথে বিয়ে দিতে যাচ্ছে; এজন্যে সে তাকে লেখাপড়া শেখাবে; নগর-সরকার নিকটেই একটা স্কুল খুলেছে, সে শারিতাকে সেখানে ভর্তি করে দেবে কারণ শারিতার বাবা চাইতো সে যেন লিখতে-পড়তে শেখে। এই বলে সে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ত; অতঃপর তার মৃত স্বামীর গল্প সুর করে বলতে থাকত, যা এ বিল্ডিংয়ের সমস্ত মহিলার মুখস্থ হয়ে গেছে। আপনি যদি রাম দাইকে জিজ্ঞাসা করেন শারিতার বাবা (যে রেলওয়েতে চাকরি করত) কী প্রতিক্রিয়া দেখাত তার বস তার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে, তাহলে রাম দাই সাথে সাথেই আপনাকে বলে দেবে, সে খুব রেগে যেত এবং তার বসকে বলত, ‘আমি আপনার চাকর নই, সরকারের চাকর। দ্যাখেন, আপনি যদি ফারদার আমাকে অপমান করেন তাহলে আমি আপনার আইনকানুন ভেঙে ফেলে দেবো।’ এরকমই একবার ঘটেছিল। তার বস তার কথা শুনে এগিয়ে গিয়েছিল এবং তাকে আরো অপমান করেছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে তার বসের ঘাড়ে ঘুষি মেরেছিল। তার বস ছিল অত্যন্ত মোটামোটা মানুষ। সে এগিয়ে দিয়ে তার বুটের জুতা দিয়ে শারিতার বাপের পেটে এমন জোরে লাথি মেরেছিল যে, তার পিলে ফেটে গিয়েছিল; সে রেললাইনের পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মরে গিয়েছিল। সরকার তাকে জেলে ঢুকিয়েছিল এবং তাকে বাধ্য করেছিল শারিতার মাকে পাঁচশ টাকা দিতে। কিন্তু কপাল মন্দ; শারিতার মা জুয়া খেলতে ভালোবাসত এবং পাঁচ মাসের কম সময়ে সে সমস্ত টাকা নষ্ট করে ফেলেছিল।
শারিতার মা সবসময় এই গল্প বলে বেড়াত কিন্তু কেউ জানত না এটা সত্য, না মিথ্যা। এ বিল্ডিংয়ের কেউই তার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করত না। সম্ভবত, তাদের সবার জীবন এতই জটিল ছিল যে, তাদের কোনো সময় ছিল না অন্যদের নিয়ে চিন্তা করার। কারো কোনো বন্ধু ছিল না। তাদের বেশির ভাগ লোকই দিনের বেলা ঘুমাতো এবং রাতের বেলা কাজ করত পাশের ফ্যাক্টরিতে। কেউ কারো প্রতি আগ্রহবোধ করত না।
এ বিল্ডিংয়ের প্রায় সবাই জানত শারিতার মা তার ছোট্ট মেয়েকে পতিতা হতে বাধ্য করছে কিন্তু যেহেতু তারা অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে অভ্যস্ত ছিল না সে কারণে তারা শারিতার মায়ের কথার কোনো প্রতিবাদ করত না যখন সে শারিতার নিষ্কলুষ চরিত্রের কথা তাদের শুনাতো। একবার যখন টুকারাম একদিন সকাল বেলা পানির ট্যাংকের কাছে শারিতাকে নাজেহাল করেছিল, শারিতার মা টুকারামের বউকে গিয়ে বকাঝকা করেছিল, ‘তুই তোর নোংরা ইঁদুরটাকে বেঁধে রাখতে পারিস না? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি আমার ছোট্ট মেয়েটার’ পরে নজর দেয়ার কারণে সে যেন অন্ধ হয়ে যায়। সে যদি এখানে বাস করতে চায় তাহলে সে যেন ভদ্রলোকের মতো আচরণ করে, তোরে বলে গেলাম।’
এ কথা শুনে টুকারামের বউ মাজায় শাড়ির আঁচল বেঁধে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল, ‘দূর হ ডাইনি কোথাকার। তোর ছোট্ট ফেরেস্তাটা এমনকি হোটেল-বয়দের সাথেও ফস্টিনস্টি করে বেড়ায়। তুই মনে করেছিস আমরা সব অন্ধ, না? তুই মনে করিস আমরা কেউ জানি না কোন সুন্দর চরিত্রের মানুষ তোর ঘরে আসে এবং তোর ছোট্ট শারিতাকে সাজিয়ে নিয়ে বের হয়ে যায়। দূর হ তুই এখান থেকে!’
টুকারামের বউ কুখ্যাত নানা কারণে। এ বিল্ডিংয়ের প্রত্যেকটা মানুষ জানে কেরোসিন-বিক্রেতার সাথে তার সম্পর্কের কথা, কিভাবে সে তাকে ভেতরে ডেকে নেয় এবং দরোজা বন্ধ করে। শারিতার মা ছেড়ে দেয়ার পাত্র না; সে এই প্রসঙ্গ টেনে তোলে। থুতু নিক্ষেপ করা কণ্ঠে সে বলে ওঠে, ‘আর তোর করেসিনঅলা? তাকে তুই দুই ঘণ্টার জন্য ঘরে ঢোকায়ে নিস তার কেরোসিন শুষে নেয়ার জন্য, না?’
এসব সত্ত্বেও শারিতার মা ও টুকারামের বউ দীর্ঘদিনের জন্য ঝগড়াঝাটি জিইয়ে রাখে না। একদিন শারিতার মা দেখল অন্ধকার রাত্রে টুকারামের বউ একজন লোকের সাথে মিষ্টি আলাপ করছে এবং পরের দিন যখন টুকারামের বউ বাড়িতে ফিরছিল সে শারিতাকে দেখতে পেল একজন ভদ্রলোক বন্ধুর সাথে গাড়ির মধ্যে বসে আছে; সুতরাং তারা দুইজনেই চুপসে গেল এবং পরস্পরের সাথে আবার কথা বলা শুরু করল।
‘তুমি কি শারিতাকে কোথাও দেখেছ?’ শারিতার মা জিজ্ঞাসা করল টুকারামের বউকে। টুকারামের বউ জানলা দিয়ে গলির মোড়ের দিকে তাকাল, ‘ওই যে সে তার বন্ধুর সাথে ময়লার স্তূপের পাশে খেলছে।’ তারপর সে ফিসফিস করে বলল, ‘এক মিনিট আগে কিশোরী উপরতলায় গেল, তুমি দেখেছ তাকে?’
শারিতার মা একবার ডানে, আরেকবার বামে তাকাল। তারপর সে ফিসফিস করে বলল, ‘এই মাত্র আমি তাকে বসিয়ে রেখে এসেছি। কিন্তু শারিতা সবসময়ই পালায় যখন তার প্রয়োজন হয়। সে কিছু ভাবে না, কিছু বোঝেও না। সারাদিন সে যা চায় তা হলো খেলা আর খেলা।’ এই কথা বলে সে আবর্জনার স্তূপের কাছে গেল। সেখান থেকে প্রস্রাবের দুর্গন্ধ আসছিল। তাকে দেখে শারিতা উঠে দাঁড়াল এবং তার মুখাবয়বে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। শারিতার মা রেগে গিয়ে তার হাত এঁটে ধরল এবং বলল, ‘বাড়ি চলো। সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা, আকর্মার ধাড়ি কোথাকার!’ তারা যখন বাড়ির দিকে, তখন সে ফিসফিস করে বলল, ‘কিশোরী অপেক্ষা করছে। সে গাড়িতে করে একজন ধনী লোককে এনেছে। সুতরাং শোনো। তাড়াতাড়ি করো। ওপরে যাও। নীল রঙের জর্জেটের শাড়িটা পরে নাও। দ্যাখো, তোমার মাথার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। বেডি হও। আমি আসছি, চুল বেঁধে দেবো।’
শারিতা শুনে খুশি হলো যে, একজন ধনী লোক গাড়ি নিয়ে এসেছে। সে লোকটাকে পরওয়া করে না কিন্তু সে গাড়িতে চড়তে পছন্দ করে। সে যখন গাড়ির মধ্যে গিয়ে বসে আর গাড়িটা তাকে নিয়ে শূন্য রাস্তার মধ্য দিয়ে ছুটে চলে তখন ঝড়ো বাতাস এসে তার মুখে চাবুক মারে, তার মনে হয় সে নিজেই যেন একটি ঝড়ো বাতাসে রূপান্তরিত হয়েছে।
শারিতার বয়স পনেরো বছরের বেশি হবে না। কিন্তু সে তেরো বছরের বালিকার মতো আচরণ করে। সে মহিলাদের সাথে সময় কাটাতে ঘৃণা করে, তাদের সাথে কথা বলতেও অপছন্দ করে। সারা দিন সে ব্যস্ত থাকে অল্প বয়সী মেয়েদের সাথে অর্থহীন খেলাধুলা নিয়ে।
শারিতা মোটেই সুন্দরী না, না তার চামড়ার রঙ চমৎকার। তার মুখটা সবসময়ই বোম্বের উজ্জ্বল আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে। কিন্তু তার স্বাস্থ্যটা বেশ ভালো। সে যদিও নোংরা পরিবেশে বসবাস করে, তার শরীরটা বেশ মজবুত এবং যে কেউ দেখে বলবে তার শরীরে যৌবন এসেছে। তার শরীরের রোমকূপগুলো কমলালেবুর মতো, যার চামড়া রসে ভরপুর, একটু টিপ দিলেই যেখান থেকে রস চুয়ে চুয়ে পড়বে; সে এরকমই তরতাজা।
শারিতার বাহুগুলোও দেখতে সুন্দর। এমনকি সে যদি নিম্ন মানের ব্লাউজও পরে, তার স্কন্ধের সৌন্দর্য তখনো মানুষের নজর কাড়ে। তার চুলগুলো লম্বা, ঘন ও সবসময় তাতে নারকেলের তেল সুগন্ধি ছড়ায়। তার চুলের বেণিগুলো তার পিঠের ওপর চাবুকের মতো বাড়ি মারে।
শারিতা সমস্ত দুঃখশোক থেকে মুক্ত। সে দিনে দুইবার খেতে পায় এবং তার মা বাড়ির সমস্ত কাজ করে। শারিতা শুধু দু’টি কাজ করে : এক হলো, প্রতিদিন সকালে সে পানির বালতি ভরে ভেতরে আনে এবং সন্ধ্যাবেলা ল্যাম্পে তেল ভরে।
কিশোরী মাসে চার থেকে পাঁচবার খরিদ্দার নিয়ে আসে। এসব লোক শারিতাকে দূরের কোনো হোটেল কিংবা কোনো অন্ধকার জায়গায় নিয়ে যায়; সে এটাকে এক ধরনের ভালো বিনোদন মনে করে। সে কখনো এসব রাত্রি নিয়ে ভাবে না। তার কারণ সম্ভবত, সে মনে করে যে, কিশোরীর মতো লোক অন্য বালিকাদের বাসাতেও অবশ্যই যাবে।
সম্ভবত সে এই কল্পনা করে যে, সব মেয়েকেই ধনী লোকদের সাথে যেতে হয় ওরলিতে, যেখানে গিয়ে ঠাণ্ডা বেঞ্চের ওপর কিংবা জহু সৈকতের ভেজা বালুতে বসতে হয়। তার জীবনে যা ঘটছে তা প্রত্যেকের ক্ষেত্রেও অবশ্যই ঘটবে, তাই নয় কি? একদিন কিশোরী যখন একজন নিয়মিত খদ্দের নিয়ে এলো, শারিতা তার মাকে বলল, ‘মা, শান্তা তো অনেক বড় হয়েছে; তাকে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও না। এই লোকটা খালি আমার জন্য ডিমের পর ডিমের অর্ডার দেয়; শান্তা সত্যিই খুব ডিম পছন্দ করে।’ তার মা হাসতে হাসতে জবাব দেয়, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, তার মা পুনে থেকে ফিরলেই তাকে তোমার সাথে পাঠাব।’ পরের দিন শারিতা দেখল শান্তা খোলা টয়লেট থেকে বের হয়ে আসছে; সে সাথে সাথে তাকে ভালো সংবাদটা জানাল, ‘যখন তোমার মা পুনে থেকে ফিরবে, সব কিছু যদি ঠিকঠাক মতো চলে তাহলে তুমি আমার সাথে ওরলি যেতে শুরু করবে।’ তারপর শারিতা তাকে সাম্প্রতিক সময়ের এক রাত্রির ঘটনা তাকে শোনাল, যেটা তার কাছে চমৎকার একটি স্বপ্নের মতো মনে হলো। শান্তা শারিতার চেয়ে দুই বছরের ছোট এবং সে শারিতার গল্প শুনে তার শরীরজুড়ে আনন্দময় উত্তেজনা অনুভব করল। সে শারিতার কাছ থেকে এরকম আরো গল্প শুনতে চাইল। ফলে সে তার হাত এঁটে ধরল এবং তাকে বলল, ‘এসো আমরা বাইরে চলে যাই।’ তারা খোলা টয়লেটের নিকটে গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে দোকানদার গিরিধারি পচা নারকেল কেটে টুকরা টুকরা করে বস্তার ওপর শুকাতে দেয়। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে চলল।
ধুতি-কাপড়ের পর্দার আড়ালে শারিতা তার নীল রঙের জর্জেট শাড়িটা পরছিল। শাড়িটা তাকে আকর্ষণীয়া করে তুলল এবং সে উত্তেজিত হয়ে উঠল আসন্ন কার-ভ্রমণের কথা ভেবে। সে ভাবতে লাগল যে-লোকটা আসছে সে কেমন হবে এবং তারা কোথায় কোথায় যাবে। কিন্তু হঠাৎ করে সে তার ভাবনা পরিবর্তন করে আশা করতে থাকল যে, তাদের কার-ভ্রমণটা অল্প সময়ের জন্য হবে না কারণ সে জানত যে, লোকটা তাকে একসময় কোনো এক হোটেলে নিয়ে যাবে, যেখানে রুমে ঢুকেই সে মদ গিলতে শুরু করবে এবং দম বন্ধ হয়ে আসা দুর্গন্ধে ঘরটা ভরে উঠবে, শারিতা লোহার সে বেডে শুয়ে কিছুতেই ভালো মতো ঘুমাতে পারবে না।
শাড়ির ভাঁজগুলো ঠিক করে সে কিশোরীর দিকে দ্বিতীয়বারের মতো তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিশোরী, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে? শাড়ির পেছনের দিকটা ঠিকঠাক আছে তো?’ কিন্তু কোনো উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সে তার ভাঙা কাঠের বাক্সের কাছে গেল, যার মধ্যে রাখা আছে জাপানি পাউডারের কৌটা। সে জানলার লোহার শিকের সাথে তার জং ধরা আয়নাটা সেট করে একটু ঝুঁকে পড়ল, খুব মনোযোগের সাথে নিজের চেহারা দেখতে থাকলো, তারপর ময়লা চিবুকের ওপর পাউডার মাখাতে লাগল। যখন তার সাজগোছ করা শেষ হলো, সে মিষ্টি করে হাসলো এবং কিশোরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সব ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর সে তাড়াহুড়ো করে তার ঠোঁটের ওপর লিপস্টিক লাগালো। তার ফলে তাকে দেখে মনে হতে লাগলো মাটির পুতুলের মতো।
শারিতার মা ভেতরে এলো, দ্রুত তার চুল ঠিক করে দিলো এবং তার মেয়েকে বলল, ‘দ্যাখো, আমার ছোট মেয়ে, সবসময় বড়দের মতো কথা বলবে এবং সে যা চায় তাই করবে। এই লোকটা কিন্তু খুবই ধনী, ঠিক আছে? এমনকি তার নিজের গাড়ি পর্যন্ত আছে।’ তারপর সে কিশোরীর দিকে ফিরে বলল, ‘যাও, তাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও। বেচারা! চিন্তা করো, সে কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছে!’
শপিং বাজারের বাইরে একটা লম্বা ফ্যাক্টরির ওয়াল আছে। সেখানে বড় করে লেখা আছে ‘প্র¯্রাব করা নিষেধ!’ তার ঠিক কাছেই, দাঁড়িয়ে আছে একটি হলুদ রঙের কার। তার মধ্যে বসে আছে হায়দরাবাদের তিন যুবক। তাদের প্রত্যেকের নাক রুমাল দিয়ে বাঁধা কারণ এই ওয়ালটা পার না হওয়া পর্যন্ত প্র¯্রাবের উৎকট গন্ধ তাদেরকে অতীষ্ঠ করে তুলবে। যখন ড্রাইভার কিশোরীকে দেখতে পেল, সে তার বন্ধুদেরকে বলল, ‘ওই যে, কিশোরী আসছে! আর মেয়েটা সত্যিই খুব ইয়াং! এই যে বন্ধুরা, দ্যাখো- ওই নীল শাড়ি পরা।’
যখন কিশোরী ও শারিতা কারের কাছে এলো, পেছনের সিটের দুই যুবক তাদের মাথার হ্যাট তুলে ধরল এবং তাদের দুইজনের মাঝখানে জায়গা করে দিলো শারিতার বসার জন্য। কিশোরী সামনের দিকে এগিয়ে গেল, পেছনের দরজা খুলে দিলো এবং শারিতাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। তারপর সে দরজা বন্ধ করে দিলো এবং চাকার পেছনে বসা যুবককে বলল, ‘দুঃখিত, অনেক সময় লেগে গেল। সে তার এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল...।’
যুবকটি শারিতার দিকে একবার তাকাল, তারপর কিশোরীকে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে- কিন্তু সে কোনো ঝামেলা করবে না তো?’
কিশোরী তার বুকে হাত রেখে বলল, ‘আমাকে বিশ্বাস করুন, স্যার।’
যুবকটি তার পকেট থেকে দুই রুপি বের করল এবং কিশোরীর হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘যাও, আনন্দ করো গিয়ে।’ কিশোরী হাত ঝাঁকিয়ে বিদায় জানালো এবং ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করল।
তখন ছিল বিকেল ৫টা। বোম্বের রাস্তা ভরে গিয়েছিল কার, ট্রাম ও বাসে; আর চার দিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। শারিতা এ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি। সে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল দুই যুবকের মাঝখানে। সে শক্ত করে ঊরুর সাথে ঊরু লাগিয়ে রেখেছিল এবং তার হাত দুটো ছিল তার কোলের ওপর। সে কয়েকবার কথা বলার সাহস করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কিছুই বলেনি। সে ড্রাইভারকে বলতে চেয়েছিল, ‘স্যার, দ্রুত গাড়ি চালিয়ে এখান থেকে বের হয়ে যান, নইলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে।’
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। ড্রাইভার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং পেছনের সিটের লোক দুটো চুপচাপ বসে ছিল, যেহেতু এটা ছিল তাদের প্রথম অভিজ্ঞতা, এরকম একজন যুবতি মেয়ের কাছে নিবিড় হয়ে বসে থাকা, যে মেয়েটা এখন শুধু তাদেরই, যাকে নিয়ে তারা কোনো ঝামেলা ছাড়াই যা খুশি তাই করতে পারে।
ড্রাইভারটি দুই বছর ধরে বোম্বেতে আছে। শারিতার মতো মেয়েদেরকে সে দিনে কিংবা রাতে বহুবার তুলে নিয়ে এসেছে। বহু পতিতাকে তার হলুদ কারটিতে নিয়ে সে ঘুরে বেড়িয়েছে; সে কখনো নার্ভাস ফিল করেনি। তার দুই বন্ধু এসেছিল হায়দরাবাদ থেকে। শাহাব চেয়েছিল একটা বড় শহর যা কিছু উপহার দিতে পারে তার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। এ কারণে কারের মালিক কিফায়াত কিশোরীর মাধ্যমে শারিতাকে ক্রয় করে নিয়ে এসেছে। কিফায়াত তার দ্বিতীয় বন্ধু আনেয়ারকে বলল, ‘তুমি জানো, এতে কোনো ভুল হবে না যদি আমরা তোমার জন্য একজনকে নিয়ে আসি।’ কিন্তু আনোয়ার এটাকে ভুল মনে করত এবং সে এ ব্যাপারটিতে সাই দিতে পারল না। কিফায়াত এর আগে কখনো শারিতাকে দ্যাখেনি কারণ কিশোরী তার ব্যাপরটা গোপন করে রেখেছিল; এবং শারিতার অভিনবত্ব সত্ত্বেও সে তার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী ছিল না। সে না পারছিল ঠিক মতো গাড়ি চালাতে, না পারছিল তার দিকে তাকাতে।
শহর পার হয়ে যখন তারা শহরতলীতে এসে পৌঁছল, শারিতা যেন দম ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত ছুটে ছলা গাড়ির ওপর আছড়ে পড়া শীতল বাতাস তাকে স্বস্তি এনে দিলো এবং তার শরীরে শক্তি ও সতেজতা দুটোই ফিরে এলো। সত্যি বলতে কি, সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না; সে তার পা নাড়াতে শুরু করল, হাত ঝাঁকাতে থাকল এবং আঙুল কচলাতে লাগল যখন সে রাস্তার পাশ দিয়ে পার হয়ে যাওয়া গাছপালা দেখছিল।
আনোয়ার ও শাহাবও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। শাহাব ভাবল, সে যা খুশি তাই শারিতার সাথে করতে পারে। সে শারিতার কোমরের কাছে সরে এলো। শারিতার মনে হলো, কেউ যেন তাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সে লাফ মারল এবং হাসতে হাসতে আনোয়ারের ওপর গড়িয়ে পড়ল। তার হাসি কারের জানালা ভেদ করে দূরে বহু দূরে গিয়ে আছড়ে পড়তে লাগল। শাহাব আবার শারিতার কাছে সরে এলো এবং সে তার অট্টহাসি এত উচ্চকিত করল যে, আনোয়ার জানালার আরো কাছে সরে যেতে বাধ্য হলো।
শাহাব আনন্দের চূড়ায় অবস্থান করছিল। সে কিফায়াতকে বলল, ‘খোদার কসম, সে সত্যিই খুব তেজি।’ তারপর সে তার ঊরুতে একটা চিমটি দিলো। শারিতা সহৃদয়তার সাথে তার প্রতিক্রিয়া জানাল এবং সে কোনো কারণ ছাড়াই আনোয়ারের কান চেপে ধরল যেহেতু সে তার বেশি কাছে ছিল। তারা প্রত্যেকেই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল। কিফায়াত ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছনের দিকে তাকালো যদিও সে গাড়ির আয়না দিয়ে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিল। সে পেছনের সিটের হাসির গতির সাথে তাল রেখে গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিলো।
শারিতা গাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে এর বাইরের হুডের ওপর উড়ন্ত পাখির মতো বসে থাকতে চাচ্ছিল। সে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, শাহাব তাকে আরো উসকে দিলো এবং শারিতা কিফায়াতের ঘাড়ের ওপর তার বাহু ছড়িয়ে দিলো, যাতে সে ভারসাম্য রাখতে পারে। কিফায়াত কোনো কিছু না ভেবেই তার হাতের ওপর চুম্বন করল; শারিতার সমস্ত শরীর কুচকে গেল। সে লাফ দিয়ে কিফায়াতের পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। সে তার টাই ধরে খেরতে খেলতে বলল, ‘তোমার নাম?’
‘আমি? আমার নাম কিফায়াত।’ তারপর সে তার পকেট থেকে দশ রুপি বের করে তার হাতে দিলো।
টাকা শারিতার মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে গেল। সে মুহূর্তের মধ্যে কিফায়াত তাকে কী বলেছিল তা ভুলে গেল। সে টাকাটা দুমড়ে মুচেড়ে তার ব্রার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। সে ছিল একটা অজ্ঞ শিশু কিন্তু সুখী। সে বলল, ‘তুমি খুব ভালো। তোমার টাইটাও খুব ভালো।’
শারিতা এত খোশমেজাজে ছিল যে, সে যা-ই দেখছিল তা-ই তার ভালো লাগছিল। সে বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল যে, এমনকি খারাপ জিনিসও ভালো মনে হতে পারে। সে চাচ্ছিল, গাড়িটা যেরকম দ্রুত গতিতে চলছে এরকম চলতে থাকুক এবং সব কিছুই তাদের ঝড়োবাতাসের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ুক।
হঠাৎ তার গান গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করল। সে কিফায়াতের টাই নিয়ে খেলা বন্ধ করে গেয়ে উঠল, ‘এটা তুমি, যে আমাকে শিখিয়েছ কিভাবে ভারবাসতে হয় এবং যে তুমি জাগিয়ে দিয়েছ আমার ঘুমন্ত আত্মাকে।’
সিনেমার এই গান গাওয়া শেষ করার পর শারিতা হঠাৎ চার দিকে তাকালো এবং আনোয়ারকে বলল, ‘তুমি এত চুপচাপ কেন? তুমি কেন কিছু বলছ না? তুমি কেন কোনো গান গাচ্ছো না?’ তারপর সে লাফ মেরে পেছনের সিটে চলে গেল এবয় শাহাবের চুলের ভেতর আঙুল বুলাতে বুলাতে সে বলল, ‘আসো আমরা একসাথে গান গাই। তোমার কি মনে আছে দেবিকা রানীর সেই গান : ‘আমি যদি পাখি হতাম, যে-গাইতো বনে বনে’? আমি সত্যিই দেবিকা রানীর গান পছন্দ করি।’ তারপর সে তার হাত দুটো একত্র করল, তার চিবুকের নিচে রাখল এবং চোখের ভ্রূ কুঁচকে গল্প বলতে শুরু করল, ‘আশোক কুমার ও দেবিকা রানী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। দেবিকা বলে উঠল, ‘আমি যদি পাখি হতাম, যে-গাইতো বনে বনে’ এবং অশোক কুমার বলে উঠল...।’ হঠাৎ সে শাহাবের দিকে ফিরে বলল, ‘এবার গাও, ঠিক আছে?’
শারিতা গাইতে শুরু করল, ‘আমি যদি পাখি হতাম যে-গাইতো বনে বনে।’ এবং রুক্ষ গলায় শাহাবও একই গানের পুনরাবৃত্তি করতে থাকল।
তারপর তারা সবাই একসাথে গেয়ে উঠল। কিফায়াত গানের তালে তালে গাড়ির হর্ন বাজাতে লাগল। শারিতা তালি দিয়ে দিয়ে গান গাইতে থাকল। শারিতার নারী-কণ্ঠ শাহাবের রুক্ষ পুরুষ-কণ্ঠের সাথে মিশে যেতে লাগল; সেই সাথে কিফায়াতের গাড়ির হর্ন। সবকিছু মিলে মনে হতে লাগল যেন কোনো অরকেস্ট্রা।
শারিতা সুখী- শাহাব সুখী- কিফায়াত সুখী; তাই দেখে আনোয়ারও সুখী বোধ করল। তারপরও সে অস্বস্তিতে ছিল। তার মধ্যে এক ধরনের আড়ষ্টতা কাজ করছিল। হঠাৎ তার তন্দ্রা কেটে গেল, আবেগ ফেটে পড়ল এবং সকল জড়তা কাটিয়ে সে তাদের সাথে আনন্দসভায় যোগদান করল।
শারিতা যখন গান গাচ্ছিল, সে হঠাৎ করে আনোয়ারের মাথা থেকে তার হ্যাটটা তুলে নিয়ে নিজের মাথায় লাগাল, তারপর ঝুঁকে পড়ে গাড়ির আয়নায় তাকে কেমন দেখাচ্ছে তা দেখতে লাগল। আনোয়ার মনেই করতে পারল না, সে আদৌ মাথায় কোনো হ্যাট পরে ছিল কিনা।
শারিতা কিফায়াতের ঊরুতে একটা চড় মারল এবং বলল, ‘আমি যদি তোমার প্যান্টটা পরি, শার্টটা গায়ে দেই আর গলায় টাইটা ঝুলাই তাহলে কি আমাকে একজন ফিটফাট ব্যবসায়ী মনে হবে?’
কিন্তু তার এ ধরনের পোশাক বদলের কথাবার্তা শাহাবকে বিব্রত করে তুলল; সে আনোয়ারের হাতে ঝাঁকুনি দিযে বলল, ‘খোদার কসম, তুমি আস্ত একটা নির্বোধ, তার হাতে তোমার হ্যাট তুলে দিয়েছ!’ কথাটা আনোয়ারের মনে লাগল এবং কিছুক্ষণ ধরে সে ভাবতে লাগল সে সত্যিই কতটা আহাম্মক।
কিফায়াত শারিতাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম?’
শারিতা মাথা থেকে তার হ্যাটটা নামিয়ে চিবুকে হাত লাগিয়ে বলল, ‘আমার নাম শারিতা।’
‘শারিতা, তুমি কোনো মেয়ে মানুষ নও, তুমি একটা আতশবাজি।’
আনোয়ার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শারিতা তার আগেই উচ্চকণ্ঠে গান গাওয়া শুরু করে দিলো, ‘ভালোবাসার শহরে আমি বানাতে যাচ্ছি আমার ঘর এবং ভুলতে যাচ্ছি পৃথিবীর সবকিছু।’
শাহাব ও কিফায়াত দুইজনেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগল। কিন্তু আনোয়ারের জড়তা কিছুতেই কাটছে না। শারিতা আবার গাইতে শুরু করল, ‘ভালোবাসার শহরে আমি বানাতে যাচ্ছি আমার ঘর এবং ভুলতে যাচ্ছি পৃথিবীর সবকিছু।’ এবং সে শেষের শব্দটার ওপর জোরে টান দিলো যতক্ষণ তার দমে কুলালো। তার লম্বা চুল সামনে ও পেছনে জ্বলজ্বল করছিল। এবং ঝড়ো বাতাসে এটাকে মনে হচ্ছিল কোনো ধোঁয়া। সে ছিল খুবই সুখী।
শারিতা সুখী- শাহাব সুখী- কিফায়াত সুখী- আনোয়ার আরো একবার চেষ্টা করল তাদের সাথে সুখী হয়ে ওঠার জন্য। কিন্তু যখনই শারিতার গান শেষ হয়ে গেল তখন সবারই মনে হলো, প্রচণ্ড কোনো বর্ষা যেন থেমে গেছে হঠাৎ করে।
কিফায়াত শারিতাকে আরেকটি গান গাইতে বলল।
‘হ্যাঁ, আরো একটি গান’, শাহাব তাকে উৎসাহিত করে বলল, ‘যদি সে-গান আমাদের শোনানো যায়।’
শারিতা গেয়ে উঠল, ‘আলী এসেছে আমার দরবারে, আমি আনন্দে মরে যাই।’ শারিতার এই গান শুনে কিফায়াতের গাড়ি এক দিকে ঘুরে গেল। তারা দেখতে পেল, হঠাৎ করে তাদের রাস্তা শেষ হয়ে গেছে এবং তারা এসে পড়েছে সমুদ্রসৈকতে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে এবং মিনিটে মিনিটে বাতাস শীতল হয়ে উঠছে।
কিফায়াত গাড়ি থামিয়ে দিলো। শারিতা গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়াতে শুরু করল সমুদ্র-সৈকতের দিকে। শাহাব ও কিফায়াত তার সাথে যোগদান করল। সে ছুটে গেল ভেজা বালুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা তালগাছটির নিচে; সেখানে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগল, সে কী চায়; সে চায় সি দিগন্তে মিশে যায়, একাকার হয়ে যায় সমুদ্রের সীমাহীন জলে, সেখান থেকে উঠে যায় উঁচু আকাশে যাতে তালগাছটা দাঁড়িয়ে থাকে তার নিচে; সে চায় তার পায়ের মধ্যে বালুর সমস্ত আদ্রতা মিশে যাক... এবং... এবং... গাড়ি, গতি, বাতাসের চাবুকাঘাত... তাকে মনে লাগলে কোনো স্বচ্ছ পদার্থ।
হায়দরাবাদের তিন যুবক ভেজা বালুর ওপর বসে পড়ল এবং শরাব পান করতে শুরু করল। শারিতা কিফায়াতের হাত থেকে একটা বোতল কেড়ে নিয়ে বলল, ‘রাখো, আমাকে ঢেলে দিতে দাও।’
শারিতা এত দ্রুত ফেলে দিলো যে, শরার গ্লাস উপচে বেয়ে বয়ে পড়তে লাগল। তাতে শারিতার আঙুল ডুবে গেল। শারিতা চুমুক দিয়ে গ্লাসের ফেনা খেতে গেল। কিন্তু এটা ছিল খুব তিতা। সে সাথে সাথে তার ঠোঁট সরিয়ে নিলো। কিফায়াত ও শাহাব হাসিতে ফেটে পড়ল। যখন কিছুতেই নিজের হাসি কন্ট্রোল করতে পারছিল না, কিফায়াত তাকিয়ে দেখল, আনোয়ারও তাদের সাথে হাসছে।
তাদের কাছে ছিল ছয়টি বোতল। কেউ কেউ এত জোরে ঢালছিল যে, তাদের গ্লাস উপচে উপচে পড়ছিল এবং ফেনা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল বালুর ভেতর। শারিতা গান গেয়েই চলেছিল। আনোয়ার যখন তাকে অবাক হয়ে দেখছিল তার মনে হচ্ছিল সে যেন শরাবের তৈরি। স্যাঁতসেতে সমুদ্র-বাতাস যেন জ্বলজ্বল করছে তার অন্ধকার চিবুকে। শারিতা খুবই সুখী। এখন আনোয়ারও খুব সুখী। তার ইচ্ছে হলো, সাগরের সব পানি যদি শরাব হয়ে যেত সে শারিতার সাথে সেখানে সাঁতার কাটত। শারিতা দুটো খালি বোতল তুলে নিয়ে একটা আরেকটার সাথে আঘাত করল। প্রকট শব্দ হয়ে তা ভেঙে গেল। সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
সে কিফায়াতকে বলল, ‘চলো, আমরা আবার গাড়িতে ফিরে যাই।’ তারা তাদের বোতলগুলো ভেজা বালুর ওপর ফেলে রেখে গাড়িতে ফিরে এলো। কিফায়াত ইঞ্জিনে স্টার্ট দিলো এবং তারা বেরিয়ে পড়ল। বাতাস তাদের ওপর আছড়ে পড়ল। সে-বাতাসে উড়তে লাগল শারিতার লম্বা চুল।
তারা গান গাইতে শুরু করল। গাড়ি দ্রুত গতিতে রাস্তা অতিক্রম করে চলল। শারিতা গান গেয়েই চলল আনোয়ার ও শাহাবের মাঝখানে বনে। আনোয়ার বসে বসে ঝিমাচ্ছিল। শারিতা দুষ্টুমি করে শাহাবের চুলে আঙুল বুলিয়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে সে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল। শারিতা যখন দেখল আনোয়ারও ঘুমাচ্ছে তখন সে লাফ দিয়ে সামনের সিটে এসে কিফায়াতকে বলল, ‘তোমার দুই বন্ধুকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। এবার তোমার পালা।’
কিফায়াত বলল, ‘তখন গাড়ি চালাবে কে?’
শারিতা হাসতে হাসতে বলল, ‘গাড়ি নিজে নিজেই চলবে।’
দু’জন কথা বলতে অনেক সময় পার হয়ে গেল; হঠাৎ তারা বুঝতে পারল তারা বাজারের মধ্যে এসে পড়েছে যেখানে কিশোরী শারিতাকে গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যখন তারা এসে পৌঁছল ফ্যাক্টরির ওয়ালের কাছে যেখানে লেখা আছে ‘প্র¯্রাব করা নিষেধ’, শারিতা বলল, ‘এখানে থামো।’
কিফায়াত গাড়ি থামাল এবং সে কিছু বলা কিংবা করার আগেই শারিতা বের হয়ে গেল, হাত ঝাঁকিয়ে বিদায় জানালো এবং বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলো। গাড়ির হুইলে হাত রেখে শিফায়াত ভাবতে লাগল যা কিছু ঘটে গেছে সব কথা। হঠাৎ সে দেখল, শারিতা আবার গাড়ির কাছে ফিরে এসেছে। সে তার ব্রার ভেতরে হাত ঢুকাল, দশ রুপি বের করে তার সিটের পাশে ছুড়ে মারল। হতবিহ্বল হয়ে, কিফায়াত সেদিকে তাকাল এবং বলল, ‘এটা কি, শারিতা?’
‘এটা টাকা- কেন আমি এটা নেব?’ সে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই এটা বলল এবং ফেলে দিয়ে দৌড়াতে থাকল। শিফায়াত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে-টাকার দিকে তাকিয়ে থাকল। যখন সে পেছনের সিটের দিকে তাকাল, দেখল তার বন্ধুরা ঘুমিয়ে পড়েছে।
অনুবাদ : সায়ীদ আবুবকর