কাজী নজরুল ইসলাম : সুন্দরের স্বপ্নদ্রষ্টা
কাজী নজরুল ইসলাম - ছবি সংগৃহীত
তাঁর এক হাতে ছিল বাঁশের বাঁশরী। অন্যহাতে রণতূর্য। তিনি জ্বলে উঠেছিলেন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। বলেছিলেন, ‘আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নবসৃষ্টির মহানন্দে।’ ধূমকেতুর মতো তাঁর উদয় ও বিলয়। এরই মধ্যে বাংলা ও বাঙালিকে রাঙিয়ে দিয়েছেন শিল্পের সাতরঙে। অর্ফিয়াসের বাঁশরী হয়ে ঘুমন্ত বাংলার ঘুম ভাঙিয়েছেন। কালজয়ী কাব্য লিখেছেন; চলচ্চিত্র বানিয়েছেন; অসংখ্য গান লিখেছেন; শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নতুন নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন; কবিতায় নির্মাণ করেছেন নতুন কাব্যভাষা। সুন্দরের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন সকল জুলুম, নির্যাতন, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, সব অপশক্তির বিরুদ্ধে। তিনি নজরুল- বাংলার দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি নজরুল।
এই হলো সৃষ্টিশীল নজরুলের কীর্তিমান রূপ। কিন্তু ব্যক্তি নজরুল? কেমন ছিলেন ব্যক্তি ও মানুষ কাজী নজরুল ইসলাম?
নজরুলের প্রকৃতি সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন,
“দেহের পাত্র ছাপিয়ে সব সময়েই উছলে পড়েছে তাঁর প্রাণ, কাছাকাছি সকলকেই উজ্জীবিত করে, মনের যত ময়লা, যত খেদ, যত গ্লানি সব ভাসিয়ে দিয়ে। সকল লোকই তাঁর আপন, সব বাড়িই তাঁর নিজের বাড়ি।...জোর করে একবার ধরে আনতে পারলে নিশ্চিন্ত, আর ওঠবার নাম করবেন না- বড় বড় জরুরি এনগেজমেন্ট ভেসে যাবে।..হয়তো দু’দিনের জন্য কলকাতার বাইরে কোথায় গান গাইতে গিয়ে সেখানেই এক মাস কাটিয়ে এলেন। সাংসারিক দিক থেকে এ চরিত্র আদর্শ নয়; কিন্তু এ চরিত্রে রম্যতা আছে তাতে সন্দেহ কী। সেকালে বোহেমিয়ান চালচলন অনেকেই রপ্ত করেছিলেন- মনে মনে তাঁদের হিসেবের খাতায় ভুল ছিল না- জাত বোহেমিয়ান এক নজরুল ইসলামকেই দেখেছি। অপরূপ তাঁর দায়িত্বহীনতা।”১
নজরুলের বহুমাত্রিক জীবন ও বিচিত্র প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর পরম বন্ধু নলিনীকান্ত সরকার লিখেছেন,
“সাহিত্যে নজরুল, সঙ্গীতে নজরুল, সভা সমিতিতে নজরুল, আড্ডা-মজলিসে নজরুল, দেশব্যাপী বন্দনায় নজরুল, দ্বেষদুষ্ট লাঞ্ছনায় নজরুল, দাবা খেলায় আত্মভোলা নজরুল, ফুটবল মাঠে আত্মসচেতন নজরুল, রঙ্গরসে নজরুল, ব্যঙ্গবিদ্রূপে নজরুল; যোগী নজরুল, ভোগী নজরুল, হস্তরেখা পাঠে অধ্যবসায়ী নজরুল, ‘কলগীতি’ পাটে অব্যবসায়ী নজরুল, -কোথায় কিসে নাই নজরুল? কিন্তু এই ছোট ছোট টুকরোগুলো জোড়া দিলে যে সম্পূর্ণ আকার রূপ পরিগ্রহ করে, সেই নজরুল মানুষটি এ সবের সমষ্টির চেয়ে আরো বড়। যাঁরা তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন, তাঁরাই এ সত্য উপলব্ধি করেছেন। বিংশ শতাব্দীর কোলে নজরুল যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বিদায়কালীন প্রীতিউপহার।”২
নজরুলের মানবিকতা, উদারতা ও সহৃদয়তার বিষয়ে হাসির রাজা শিবরাম চক্রবর্তী স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে লিখেছেন,
“কাজীর কাব্যের চেয়ে বড় কাজী মানুষ। এত বড় প্রাণ আমি খুব কম সাহিত্যিকেরই দেখেছি। দু’একজন অতি বড় সাহিত্যিকের সাথে মেশবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে, তার অভিজ্ঞতা থেকে, পৃথিবীতে যত প্রকারের হিংস্র্র প্রাণী আছে, সাহিত্যিকেরা তার মধ্যে পড়ে কিনা, এই সভয় সন্দেহ আমার মনে জেগেছে।...সুখের বিষয় কাজী এই গোত্র ছাড়া; ও কেবল সাহিত্যিক নয় ও মানুষও ও তার কাব্যে ও জীবনে সমান ‘উন্নত শির’।...সত্যিকারের স্র্রষ্টা সে। তার মুখে কারো নিন্দা শুনিনি, সে তার নিন্দুককেও ক্ষমা করে, কারুকে তার ঈর্ষা নেই, তার যে ঈর্ষাতুর সে-ও তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় না-তার প্রতিদ্বন্দ্বীকেও সে হাত বাড়িয়ে সাহায্য করে। সত্যিকার কবিপ্রাণ তার। তার কাছে গেলে সে তথ্য শোনায় না, তত্ত্বকথার বুলি ঝাড়ে না, তার ইচ্ছে আনন্দদান।”৩
নজরুল-প্রতিভা কালোত্তীর্ণ। তিনি ছিলেন সুন্দরের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার চির বৈচিত্র্যময়। তাঁর শরীরী মৃতু্যু হলেও তাঁর সৃষ্টিকর্মের মৃত্যু হয়নি। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে রচিত তাঁর অমর কবিতা ও গান পরবর্তী সময়ে বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি ক্রান্তিকালে মুক্তিপাগল বাঙালিকে অনির্বাণ প্রেরণা ও উৎসাহ জুগিয়েছে। এভাবেই নজরুলের সাহিত্যকীর্তি চিরকালের কীর্তিরূপে পরিগণিত হয়েছে। বরেণ্য কবি ও কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভাষায়,
“বিধাতার এক সুর
করেছিল বুঝি পথভুল,
তারই নাম জানি নজরুল।
মলিন মাটির দেশে সে সুরের দেখেছি আগুন,
দিকে দিকে অনির্বাণ শিখা,
তাহারে বরিতে আজ মহাকাল আপনার হাতে
আঁকে জয়টিকা।”৪
১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতির অভিভাষণে নজরুল বলেছিলেন, ‘আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান-বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকব আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।’
নজরুলের এই কথাগুলো আজো প্রাসঙ্গিক। বাংলাভাষার দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি নজরুল অমর হয়ে আছেন সাহিত্যপিপাসু বাঙালির মানসলোকে; তাঁর কীর্তিগাথা ছড়িয়ে গেছে লোকলোকান্তরে, দেশদেশান্তরে। তাঁর স্মৃতি ভাস্বর হয়ে আছে সর্বমানবের শ্রদ্ধায় ও ভালবাসায়।
তথ্যসূত্র :
১। বুদ্ধদেব বসু : নজরুল ইসলাম, কবিতা, কার্তিক- পৌষ ১৩৫১, পৃঃ ১৯
২। নলিনীকান্ত সরকার : শ্রদ্ধাষ্পদেষু, পৃ: ১৩৩-১৩৪
৩। শিবরাম চক্রবর্তী : কবি কাজী নজরুল, সাপ্তাহিক সওগাত, ৫ পৌষ, ১৩৩৬ (২০ ডিসেম্বর ১৯২৯)
৪। ড. সুশীল কুমার গুপ্ত, নজরুল-চরিতমানস, দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, বৈশাখ ১৪১৯ পৃ: ১০০-১০১