রাসূলের ৮ সন্ধি ও ফরমান
রাসূলের ৮ সন্ধি ও ফরমান - ছবি সংগৃহীত
সব ধর্মগ্রন্থে সর্বশেষ রাসূল ও নবী মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে আল্লাহ এত বেশি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, বাস্তবিকপক্ষেই তিনি পবিত্র কুরআনে ঘোষিত ‘সারা বিশ্বের রহমতস্বরূপ’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণও করেছেন। তিনিই মূলত সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ, যাকে শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-গরিমায় আল্লাহ কোনো মানুষেরই মুখাপেক্ষী করেননি, যাতে তার রিসালাত ও চরিত্র সম্পর্কে কেউ সন্দেহ পোষণ করতে না পারে! মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় পিতৃবিয়োগ এবং পরবর্তীতে মাতৃবিয়োগের পর পিতৃ-মাতৃহীন অসহায় রাসূল সা: পর্যায়ক্রমে দাদা আবদুুল মুত্তালিব এবং দারিদ্র্যপীড়িত চাচা আবু তালিবের গৃহে প্রতিপালিত হন বটে। কিন্তু চাচার দরিদ্র সংসারে লেখাপড়ার বদলে তাকে নিয়মিতভাবে মাঠে গিয়ে মেষ চড়াতে হতো। তিনি কেমন অক্ষরজ্ঞানহীন অথচ উচ্চশিক্ষিত প্রশিক্ষক ছিলেন, তা আল্লাহর ভাষায় শোনা যেতে পারে-
১. (হে নবী) তুমি তো এর (কুরআন) আগে কোনো কিতাব পাঠ করোনি এবং স্বহস্তে কোনো কিতাব লিখনি যে, মিথ্যাবাদীরা সন্দেহ পোষণ করবে? (সূরা নাহল, আয়াত-৪৮)
২. সেসব লোক, যারা আনুগত্য করে এ রাসূলের, যিনি উম্মি নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়...। (সূরা আরাফ, আয়াত-১৫৭)
৩. তিনিই মহান সত্তা, যিনি নিরক্ষরদের (নগণ্য সংখ্যক অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কুরাইশদের) মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের তার আয়াত শোনান, তাদের জীবনকে সজ্জিত-সুন্দর করেন এবং তাদের কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন। অথচ ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহিতে নিমজ্জিত ছিল। (সূরা জুমুয়াহ, আয়াত-২)
রাসূলের শিক্ষাব্যবস্থা ও লেখকরা : নবুয়তপ্রাপ্তির পর সুদীর্ঘ ১৩ বছরের মক্কি জীবনে তিনি আল্লাহর খলিফা হিসেবে একদল জানবাজ অনুসারী তৈরি করলেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, নির্যাতন ও প্রাণনাশের হুমকির মধ্যে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পাননি। ফলে ইসলামী খিলাফত-কায়েমের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাকে মদিনায় হিজরত করতে নির্দেশ দেন। মদিনায় গিয়ে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের একজাতি স্বীকৃতি দিয়ে তিনি যে, মদিনা-সনদ রচনা (সন্ধিচুক্তি) করেন, তারই পথ ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী খিলাফত। আল্লাহর উলুহিয়াত বা সার্বভৌম-ক্ষমতার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক হয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রদূত, গোত্র, গভর্নর, সেনাপ্রধানসহ বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন সময়ে লিখিত চুক্তি, সন্ধি, ফরমান ইত্যাদি লিখিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
রাসূলের সন্ধি ও পত্রাবলি
রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকদের জন্য তাদের ভাষায় পত্রাদি লিখার কাজ করার জন্য রাসূলে করিম সা:-এর নির্দেশে তৎকালীন দুনিয়ায় প্রচলিত ভাষাসমূহ শিখে নিয়েছিলেন বহু সাহাবি। হজরত জায়দ ইবনে সাবিত রা: সুরিয়ানি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন। সেই ভাষায় লিখিত কোনো পত্র রাসূলের কাছে এলে তিনি তা পাঠ করে লিখিত বিষয় সম্পর্কে রাসূলকে অবহিত করতেন। তার লিখিত চুক্তি, সন্ধি ও চিঠিপত্রের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
১. নবী করিম সা: মদিনায় হিজরত করে স্থানীয়ভাবে বসবাস শুরুর পর সর্বপ্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক কার্যসম্পাদন করেন, তা হলো- মদিনার ইহুদি-খ্রিষ্টান এবং মদিনার আনসার ও মুহাজির মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক অনাক্রমণ এবং অন্যান্য শর্তসম্বলিত ৫২-দফার দীর্ঘ চুক্তিনামা, যা মদিনা সনদ নামে বিশ্ব বিখ্যাত। বস্তুত সভ্যতার ইতিহাসে এ চুক্তিই প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্রের মর্যাদার অধিকারী এবং অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
২. রাসূলে করিম সা: মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম নাগরিকদের আদমশুমারি গ্রহণ করেন। তিনি এ উদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত ভাষায় তার অফিসারের উদ্দেশে এক ফরমান জারি করেন- ‘যেসব লোক ইসলাম কবুল করার কথা বলেছে, তাদের নাম-ধাম আমার জন্য লিখিয়ে দাও।’
৩. তৃতীয় হিজরি সনের সফর মাসে বনি জামরা গোত্রের সাথে নবী করিম সা: এক সন্ধিচুক্তি করেন। এই চুক্তিনামাও লিখিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। অবশ্য নিম্নলিখিত দুটি বিবরণ থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, হিজরতের অব্যবহিত আগেও নবী করিম সা: অন্তত দুটি ক্ষেত্রে লিখিত ফরমান দিয়েছিলেন। ক. তামিমদারিকে নবী করিম সা: এক লিখিত পরোয়ানা পাঠান। খ. হিজরত করিয়া মদিনায় যাওয়ার পথে নবী করিম সা: সুরাকার ইবনে মালিক মুদলেজিকে একটি নিরাপত্তালিপি লিখিয়ে দিয়েছিলেন।
৪. হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- মক্কা বিজয়ের বছর (অষ্টম হিজরি) খাজায়া গোত্রের লোকরা লাইস গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এ সংবাদ রাসূলে করিমের কাছে পৌঁছালে তিনি তাঁর জন্তুযানের পৃষ্ঠে সওয়ার অবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণদান করেন। তাতে তিনি হেরেম শরিফের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য এবং নরহত্যার দণ্ড ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় হুকুম আহকাম বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। ভাষণ সমাপ্ত হলে হজরত আবু শাহ নামক জনৈক সাহাবি রাসূলে করিম সা:কে বলিলেন, ‘হে রাসূল! আমার জন্য ভাষণটি লিখিয়ে দিন। তখন নবী করিম সা: তার আবেদন মঞ্জুর করে জনৈক সাহাবিকে বলিলেন, ...এই ভাষণটি আবু শাহকে লিখিয়ে দাও।
৫. ঐতিহাসিক হাফিজ ইবন আবদুল বার লিখিয়েছেন- নবী করিম সা: আমর ইবনে হাজম ও অন্যান্যকে সাদকা, ফরজ ও সুন্নাত সম্পর্কে এক দস্তাবেজ লিখিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লামা শাওকানি বিভিন্ন স্থানে এই কিতাবটিরই উল্লেখ করেছেন। ইমাম মালিক রা: এ কিতাবখানির উল্লেখ করে বর্ণনা করেছেন- আবুবকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাজম থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, এটি নবী করিম সা: লিখিত সেই কিতাব, যা তিনি আমর ইবনে হাজমকে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় লিখিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে পাঠিয়েছিলেন সেখানকার অধিবাসীদেরকে দ্বীন-ইসলামের গভীর জ্ঞান দান ও সুন্নতের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে এবং তাদের কাছ থেকে জাকাত আদায় করার জন্য। এতে তার জন্য নিয়োগপত্র ও প্রতিশ্রুতি এবং সেখানকার লোকদের মধ্যে তার দায়িত্ব পালনের বিষয়ও লিখিত ছিল। হিজরি দশম সনে নবী করিম সা: হজরত আমর ইবনে হাজম রা:কে নাজরান অধিবাসীদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
৬. এতদ্ব্যতীত নবী করিম সা: ইয়েমেনের অধিবাসীদের জন্য আর একটি ‘দস্তাবেজ’ লিখিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এর নাম ছিল ‘কিতাবুল জিরাহ’। এ ঘোষণাপত্র উষ্ট্রচর্মে লিখিত ছিল।
৭। বনু সকিফের প্রতিও তিনি এক সন্ধিনামা লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এর শুরুতে লিখিত ছিল- এটি সকিফ গোত্রের জন্য আল্লাহর রাসূলের লিখিত সন্ধিনামা।
৮. নবী করিম সা: সদকা ও জাকাত সম্পর্ক একটি পূর্ণাঙ্গ দস্তাবেজ লিখিয়ে নিয়েছিলেন। একে ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি দায়িত্বশীল কর্মচারীদের কাছে পাঠানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু তা পাঠানোর আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। পরে তা খিলাফতে রাশেদার কার্যপরিচালনার ব্যাপারে পুরাপুরি দিকদর্শন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইমাম জুহরি এ দস্তাবেজটি দেখতে পেয়েছেন এবং বলেছেন, এটি নবী করিমের সদকা সম্পর্কে লিখিত কিতাব। জুহরি সালেম ইবনে আবদুল্লাহর কাছে এর পাঠ গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি তা নিজের মধ্যে আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। উত্তরকালে উমর ইবনে আবদুল আজিজ খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের বংশধরদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করেন এবং এর প্রতিলিপি তৈরি করে নেন। (মুসনাদে ইমাম আহমদ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪)
অসমাপ্ত