মুসলিমদের নিয়ে যা ভাবতেন গোলওয়ালকার
গোলওয়ালকার - ছবি সংগৃহীত
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আরএসএসের মুখপত্র ‘অরগ্যানাইজারে’ যে সম্পাদকীয় লেখা হয় তাতে সব ভারতীয় সংখ্যালঘুদের ভারতীয় জাতীয়তার বাইরে রেখে ‘হিন্দু ন্যাশন’-এর ধারণা তুলে ধরা হয়। গোলওয়ালকার মনে করতেন শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম আলাদা কোনো স্বাধীন ধর্ম নয়। আরএসএস মনে করে, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম যেহেতু স্বাধীন কোনো ধর্ম নয়, তাই এগুলোর প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই; তবে তারা মনে করেন এগুলো হিন্দু ধর্মেরই অংশ। গোলওয়ালকারের এ সম্পর্কিত ঘোষণা হচ্ছে : ‘দ্য বুড্ডিস্টস, দ্য জৈনস, দ্য শিকস আর অল ইনক্লুডেড ইন দেট ওয়ান কমপ্রিহেনসিভ ওয়ার্ড হিন্দু’। আসলে গোলওয়ালকার বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্ম সম্পর্কে এই ধারণা নিয়েছিলের হিন্দুত্ব আইকন ভিডি সাভারকারের কাছ থেকে, যিনি বিশ্বাস করতেন আর্যসমাজ, ব্রাহ্মসমাজ, দেবসমাজ ও ভারতে সৃষ্ট অন্যান্য ধর্মীয় সমাজের অনুসারীরা আসলে হিন্দু, তাদের নিয়েই গঠিত হিন্দু জনগোষ্ঠী। আরএসএস মনে করে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা ভারতে অভিবাসী। সোজা কথায় বিদেশী। তারা হিন্দুরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।
অনেকেই জানেন, ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের কিছুটা অনুসমর্থন ছিল আরএসএসের প্রতি। আরএসএস নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ফেভারিট হিসেবেই বিবেচিত ছিলেন। কিন্তু সেই বল্লভভাই প্যাটেলও মনে করতেন, গোলওয়ালকারের নেতৃত্বাধীন আরএস ভারত বিভাগোত্তর সময়ের নির্বিচারে মুসলিম হত্যায় দায়ী। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে গোলওয়ালকারের কাছে লেখা এক চিঠিতে বল্লভ ভাই প্যাটেল উল্লেখ করেছিলেন : ‘অরগ্যানাইজিং দ্য হিন্দুজ অ্যান্ড হেল্পিং দেম ইজ ওয়ান থিং বাট গোয়িং ইন ফর ইটস সাফারিংস অন ইনোসেন্ট অ্যান্ড হেল্পলেস মেন, উইমেন অ্যান্ড চিল্ডরেন ইজ কোয়াইট অ্যানাদার থিং।’
এদিকে নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, ২০১৪ সালে ভারতে নরেদ্র মোদিও বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর দেশটিতে গোঁড়া আরএসএস গোষ্ঠীর গো-হত্যার অজুহাতে যেখানে-সেখানে মুসলমানদের নির্যাতন চালিয়ে হত্যা ও তাদের সম্পদ লুট ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার এক নয়া উপদ্রব শুরু হয়। সারা ভারতে তা ব্যাপকভাবে ঠান্ডা মাথায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। গোলওয়ালকারের মিথ্যাচারের কারণেই কার্যত এই উপদ্রবটির জন্ম হয়। গোলওয়ালকার বলে গেছেন, বিদেশী অনুপ্রবেশকারীরা আসার পরই ভারতে গো-হত্যার সূচনা হয়। মুসলমানেরা ভারতে এসে গো-হত্যার সূচনাও করে। কিন্তু হিন্দুদের লেখা বৈদিক ইতিহাসও তা সমর্থন করে না। আরএসএস স্বামী বিবেকানন্দকে বিবেচনা করে মহান এক হিন্দু দার্শনিক হিসেবে। ১৯০০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনায় শেক্সপিয়ার ক্লাবে দেয়া এক ভাষণে সেই তিনি বলেছিলের : ‘আমার কথা শুনে আপনার অবাক হবেন, পুরণো পর্বানুষ্ঠান মতে- যে গরুর গোশত খায় না, সে একজন ভালো হিন্দু নয়। কিছু সুনির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে একজন হিন্দুকে ষাড় জরাই করে এর গোশত খেতে হবে।’
আরেকটি অনুষ্ঠানে বিবেকানন্দ বলেছিলেন : ‘ভারতে একটা সময় ছিল, যখন কোনো ব্রাহ্মণ গরু না খেলে ব্রাহ্মণ থাকতে পারতেন না। ‘আপনারা বেদে পড়ে দেখতে পারেন, কী করে একজন সন্যাসী, একজন রাজা, একজন মহামানব ঘরে প্রবেশ করেতেন সর্বোত্তম গরুটি জবাই করে।’
এই গোলওয়ালকারই দাবি তুলে গেছেন, মনুসংহিতা হবে ভারতের সংবিধান। যেসব আরএসএস সমর্থক মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ‘বিদেশী’ আখ্যায়িত করে ভারতে তাদের অস্তিত্ব বিলীন করতে চায়, তাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার অস্বীকার করে, তারা শুধু বাস্তবতার অর্ধেকটুকুই জানে। হিন্দু জাতি গড়ার প্রকল্পের দাবি ভারতীয় সংবিধানে সাব-হিউম্যানের মর্যাদা পাবে শূদ্ররা (দলিতরা)। ফলে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের সমান মর্যাদা ও সুযোগ দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট কাউন্সিল যে সংবিধান চূড়ন্ত করে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি আরএসএস। এর চারদিন পর ৩০ নভেম্বর আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গ্যানাইজার’ এর সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করে : ‘আমাদের সংবিধানে প্রাচীন ভারতে অনন্য সাংবিধানিক বিকাশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। মনুর আইনগুলো লেখা হয়েছে লাইকারগাস অব স্পার্টা অথবা পার্সিয়ার সলোনের বহু আগেই। আজকের এই দিনে মনু’র আইনগুলোর ব্যাখ্যা-বিবৃতি ‘মনুস্মৃতি’ তুলে ধরা হয়েছে, তা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছ। কিন্তু আমাদের সংবিধান পণ্ডিতদের কাছে এর কোনো দাম নেই।’
আসলে গোলওয়ালকারের এই বর্ণবিভেদ প্রথা আর তাদের ‘হিন্দু ন্যাশন’ সমার্থক। অনেক হিন্দুই এই বর্ণপ্রথা মানতে নারাজ। যে জন্য ভারতীয় সংবিধানে এর স্থান নেই। মনুসংহিতার কিছু বিধান যে দলিত/অস্পৃশ্যদের জন্য মর্যাদা হানিকর তা হিন্দুদের অনেকেই স্বীকার করেন। তা ছাড়া সর্বজনীন মানবাধিকারের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মনুর অনেক আইন নারীর জন্যও মর্যাদা হানিকর।
গোলওয়ালকারের এ ধরনের নানাধর্মী পরিচয় আরএসএসের আর্কাইভে রয়েছে। একটি মাত্র লেখায় তা তুলে ধরা একবারেই অসম্ভব। তবে এ লেখায় তার যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে এটুকু স্পষ্ট যেÑ এ ধরনের নীতি আদর্শের মানুষকে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের কল্পিত ভারতের জাতীয় প্রেরণার উৎস হিসেবে যে মর্যাদার আসনে বসাতে চায়, তেমনটি ঘটলে বিশ্ব দরবারে ভারতের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় মর্যাদা কোন পর্যায়ে গিয়ে নামবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক