করোনা চিকিৎসার ইনজেকশনটির দাম কত?
করোনা চিকিৎসার ইনজেকশনটির দাম কত? - ছবি সংগৃহীত
সরকারি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ ঘাটতির সুযোগে ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার একটি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ কেনাকাটায় ঘটেছে অনিয়মের ঘটনা৷ বেশি দামে কেনায় অপচয় হয়েছে কোটি টাকা৷ এমন তথ্য উঠে এসেছে সরকারের অডিটে৷
কোম্পানি ভিন্ন হলেও ওষুধের গুণ ও মান একই৷ কিন্ত করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সাত হাসপাতাল সেটি কিনেছে সাত রকম দামে৷ ব্যবধানও অবাক করার মতো৷ কোনো হাসপাতাল কিনেছে সর্বনিম্ন ১৭০ টাকায়, আবার কোনোটি এর চেয়ে ১৩ গুণ বেশি দামে দুই হাজার ২১০ টাকা তে৷ বাজার থেকে খুচরা মূল্যে কিনলেও এর সর্বোচ্চ দাম পড়ার কথা ১৩০০ টাকা৷ আর সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডট-ইডিসিএল-এর কাছ থেকে কিনলে পড়তে ৭৯৩ টাকা৷
ওষুধটি মেরোপেনেম এক গ্রাম ইনজেকশন৷ নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, ফুসফুস ও শ্বাসনালী সংক্রমণের চিকিৎসায় মূলত এটি ব্যবহার হয়৷ কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ওষুধটি হাসপাতালগুলোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে৷ সাতটি হাসপাতালের কেনা বিভিন্ন কোম্পানির এই ওষুধের দামে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও ল্যাব পরীক্ষার মানে তেমন ভিন্নতা মিলেনি৷ ঢাকার সাতটি বড় হাসপাতালে ওষুধটির ‘ক্রয়, মজুদ, মূল্য’ নিয়ে উঠে আসা তথ্যকে ‘চাঞ্জল্যকর’, ‘ভয়াবহ ও অস্বচ্ছ’ বলা হয়েছে সরকারের অডিট প্রতিবেদনেই৷
ইডিসিএলের সরবরাহ ঘাটতি
বাংলাদেশের শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড-ইডিসিএল৷ প্রতিষ্ঠানটির যেসব ওষুধ উৎপাদন করে সেগুলো সরকারি হাসপাতালগুলো তাদের কাছ থেকেই কিনতে বাধ্য৷
কিন্তু ২০২০ সালের শুরুতে ঠিক প্রয়োজনের সময়ে এসে ইডিসিএলের মেরোপেনেম ওষুধটির মজুদ শেষ হয়৷ আবার ওষুধটির আমদানিকৃত কাঁচামালও প্রতিষ্ঠানের ভাণ্ডারে এসে পৌঁছাতে দেরি হয়৷ বিষয়টি স্বীকার করে ইডিসিএলের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবির জগলুল বলেন, তারা সরকারি হাসপাতালগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহ করেন, বেশি মজুদ রাখেন না৷ করোনার কারণে ওষুধটির চাহিদা বেড়ে যায়৷ কিন্তু কাঁচামাল সময়মতো আমদানি করতে না পারায় ছয়মাস উৎপাদন বন্ধ থাকে৷ এর কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় শাখার মহাব্যবস্থাপক জহির উদ্দিন জামাল বলেন, ‘‘এই কাঁচামাল আমদানির জন্য দু'বার রি-টেন্ডার করতে হয়েছিল, যেহেতু দাম বেশি ছিল৷ যখন দাম বেশি হয় তখন ক্রয় কমিটি পুনঃদরপত্র ইস্যু করে৷ এজন্যেও কাঁচামালটি সময়মতো আসতে পারেনি৷ তার কারণে এই ওষুধের সরবরাহে দেরি হয়েছে৷’’
দামের অস্বাভাবিক পার্থক্য
এই সুযোগে ঢাকার কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল বেসরকারি কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত ওষুধ কয়েক গুণ বেশি দামে কিনে নেয়৷ অবশ্য ব্যতিক্রমী উদাহরণও দেখা গেছে৷
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মেরোপেনেম (এক গ্রাম) ইনজেকশনটি সরাসরি একটি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কিনেছে ১৭০ টাকা দরে৷ গত জুনে আরেকটি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল কিনেছে ২১৪ টাকা দিয়ে৷ ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সরাসরি দরপত্র আহ্বান করে ৭৯৩ টাকায় কিনতে পেরেছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল৷ কিন্তু অন্য চারটি সরকারি হাসপাতাল উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সরাসরি না কিনে একই ওষুধ ঠিকাদারদের কাছ থেকে কিনেছে বেশি দামে ৷
এপ্রিল ও মে মাসে দুই দফায় দুই হাজার ২১০ টাকা দরে কিনেছে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল৷ জুনে আরেক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিনেছে তারা এক হাজার ৯৫৫ টাকা করে৷ অথচ বাজারে এর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৩০০ টাকা৷ অর্থাৎ, বাজার মূল্যের চেয়েও প্রতিটি যথাক্রমে ৯১০ ও ৬৫৫ টাকা বেশি দিয়ে কিনেছে তারা৷ ওই হিসেবে শুধু এই একটি ওষুধের পেছনেই হাসপাতালটি গত বছর ৫২ লাখ ৮১ হাজার ২৫০ টাকা ঠিকাদারদের অতিরিক্ত পরিশোধ করেছে৷ ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল অথবা এসেনশিয়াল ড্রাগসের ওষুধের দামের সঙ্গে তুলনা করলে আর্থিক ক্ষতির অঙ্কটি কোটি ছাড়াবে৷ একই কথা প্রযোজ্য সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালের জন্যেও৷ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওষুধটি সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ কিনেছে ১২৯৫ টাকা দরে আর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ১২৯৮ টাকায়৷ প্রশ্ন হলো, বাকিরা যেখানে সরাসরি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকেই সাশ্রয়ী দামে কিনতে পেরেছে, সেখানে এই তিন হাসপাতাল কেন বেশি দামে কিনলো?
প্রয়োজন না থাকলেও মজুদ?
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল শুধু বাজারের চেয়ে বেশি দামেই ওষুধটি কিনেনি, অভিযোগ আছে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত কিনে মজুদ করারও৷ এই বিষয়ে অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘মজুদ ও গ্রাফ পর্যালোচনা করে দেখা যায় ওষুধটির ব্যবহার সাধারণ কোভিড আক্রান্তের ট্রেন্ডের সাথে মিল নেই৷ অধিকন্তু ইডিসিএলের যেসব মাসে জোগান বা উৎপাদন বন্ধ ছিল সেসব মাসেই ইচ্ছাকৃতভাবে উচ্চমূল্যে ক্রয় করে মজুদ করা হয়েছে৷ এতে ওষুধের মান নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে বলে প্রতীয়মান৷’’
বেশি দামে কেনা ও মজুদের বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সেহাব উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যখন এই ইনজেকশনটি কিনেছি, তখন সরবরাহ করবে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷... ঐ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বেশি দামে কিনতে হয়েছে৷ এর মধ্যে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য যে ছিল না সেটি আমি হলফ করে বলতে পারি৷ কোয়ালিটিতে (গুণগত মানে) কোনো ছাড় না দিয়ে আমরা কস্টিংয়ে (খরচে) ছাড় দিয়েছি৷’’ যদিও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল একটি প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে একই সময়ে ওষুধটি ঠিকই ২১৪ টাকা দরেই কিনতে পেরেছে৷ আর অডিট রিপোর্টে অতিরিক্ত মজুদের কথা বলা হলেও তা সঠিক নয় বলে দাবি করেন ডা. সেহাব উদ্দিন৷এই বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টা করা হলেও তাদেরকে কথা বলার জন্য পাওয়া যায়নি৷
অডিট অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এমআরপি বা বাজারের খুচরা মূল্যের চেয়ে প্রায় এক কোটি ৬১ লাখ টাকা বেশি দিয়ে ওষুধ কিনেছে৷ অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, হাসপাতালগুলো এমআরপি-র চেয়ে অতিরিক্ত দামে ওষুধ কিনতে পারে না৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে