ক্যামব্রিজের অন্য আলোয়

নূরুল ইসলাম খলিফা | Feb 28, 2021 12:04 pm
ক্যামব্রিজ

ক্যামব্রিজ - ছবি সংগৃহীত

 

ফেব্রুয়ারির ঘুম ভাঙা সকাল। বিগত রাতের আলো ঝলমলে লুটন শহর এখনো হয়তো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। প্রচণ্ড শীত, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। সেদিন কে একজন বলছিলো আমি বছরের এই চার মাস hate করি। কিন্তু যিনি প্রকৃতির স্রষ্টা, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কার কী করার আছে! আমি অবশ্য hate করি না তবে শীতকাতুরে মানুষ, বলতে দ্বিধা নেই। বেড়াতে এসেছি লুটন, সেই সাত সমুদ্র তের নদী পারি দিয়ে। ঘরের মধ্যে অবস্থান করেও মনে হচ্ছিলো শীতের তীব্রতায় হাত পা আড়ষ্ট হয়ে আসছে। তবুও ব্যস্ততার শেষ নেই। বিলেত দেখার নিয়ত করেছি। বসে থাকলে চলবে না। সুতরাং বেরিয়ে পড়েছি বিসমিল্লাহ বলে।

‘রাব্বি আনজিলনী মুনজিলাম মুবারাকা ওয়া আনতা খাইরুল মুনঝিলীন’

হে আমার প্রতিপালক! আমাকে যেখানে অবতরণ করাও, কল্যাণের সাথে অবতরণ করাও। নিশ্চয়ই তুমি উত্তম অবতরণকারী।
চমৎকার ভাব ও ভাষায় হৃদয়টি আশ্বস্ত হয় এক অপার্থিব শক্তিতে। জীবন জগতের যিনি একমাত্র স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক তাঁর কাছেই উত্তম অবতরণের দোয়া করছি। সীমাহীন শক্তি ও ক্ষমতার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে পথযাত্রার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ভুলে চলেছি ক্যামব্রিজের পথে। ক্যামব্রিজকে ইউনিভার্সিটি শহর বলা হয়। ব্রিটেনের প্রশাসনিক বিষয় সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন যে, এখানের প্রশাসনিক এলাকাগুলো কাউন্টি নামে পরিচিত। এগুলো কিছুটা জেলা বা বিভাগের মতো। এগুলো মেট্রোপলিটন এবং নন মেট্রোপলিটন এই দু’ভাগে বিভক্ত। এই এখানের কাউন্টি হচ্ছে ক্যামব্রিজশায়ার, যার প্রধান শহর হচ্ছে ক্যামব্রিজ। ক্যামব্রিজ শহর বেশি পরিচিত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার দুনিয়াজোড়া খ্যাতি রয়েছে যেমনটা রয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের।
ক্যামব্রিজ বা অক্সফোর্র্ড সম্পর্কে ভার্চুয়াল জগতে ক্লিক করলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তথ্য পাওয়া যাবে। আমি শুধু কি দেখেছি, কি বুঝেছি এবং কি ভেবেছি সেই প্রাসঙ্গিকতায় আরেকবার ক্যামব্রিজের পরিচয় তুলে ধরি।

দুই.
মাইলফলক বলছে ক্যামব্রিজ শহর লন্ডন থেকে হাইওয়ে ধরে প্রায় ষাট মাইল উত্তরে। আমার যাত্রা শুরু লুটন থেকে। অর্থাৎ উত্তর পূর্ব দিকে প্রায় বিয়াল্লিশ মাইল পাড়ি দিয়ে তবেই গন্তব্যের নাগাল। অবারিত মাঠ, ফসলের ক্ষেত সাজানো বাড়িঘর, বাজার হাট এবং রাস্তার দু’পাশের চমৎকার বৃক্ষরাজি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। প্রধান হাইওয়ে বাদ দিয়ে গ্রামের মধ্যদিয়ে কিছুটা ঘুরানো পথে যাত্রা শুরু করলাম। উদ্দেশ্য ব্রিটেনের গ্রামাঞ্চলের সৌন্দর্য ও গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্য খানিকটা দেখে নেয়া।

আসলে ব্রিটেনের গ্রাম বলতে ঠিক আমাদের মতো নয়। পুরো দেশটাকেই যদি শহর বলা হয় তো বেশি ভুল বলা হবে না। মাঠের বুক চিরে চমৎকার মসৃণ পাকা সড়ক গোটা দেশব্যাপী বিস্তৃত। এই রাস্তার ধারেই মাঝে-মধ্যে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এ সমস্ত আবাসিক এলাকা অত্যন্ত সমন্বিতভাবে তৈরি। এখানে পানি বিদ্যুৎ গ্যাসসহ প্রয়োজনীয় সব সার্ভিস যে কোনো শহর এলাকার মতোই। আছে বাজার গির্জা, হোটেল রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। প্রতিটি বাড়ির সামনে রয়েছে প্রশস্ত আঙ্গিনা যেটা শহর এলাকার খানিকটা ব্যতিক্রম। বাড়ির আঙিনায় সারি সারি গাড়ি পার্কিং করা আছে। চমৎকার ছবির মতো সাজানো ঘরবাড়িগুলো বোঝাই যায় এর অধিকারীরা যথেষ্ট সচ্ছল।

কিছু কিছু গুচ্ছগ্রাম ফাঁকা জায়গায় অর্থাৎ এর চারদিকে অনেক দূর পর্যন্ত কোনো জনবসতি নেই। আমাদের মনে প্রথমই যে শঙ্কা আসে সেটা নিরাপত্তা। তবে লন্ডনবাসীর সে শঙ্কা নেই। অপরাধীরা এখানে পার পায় না। এছাড়া আপনি যে কোনো স্থানে বসেই পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। প্রযুক্তি ও যাতায়াতের চমৎকার সুবিধা থাকায় বিপদগ্রস্ত মানুষের কাছে পুলিশের সাহায্য পৌঁছতে সামান্যই সময় লাগে। ছোটখাটো ছিঁচকে চুরি-বাটপারি থাকলেও তার সংখ্যা খুবই কম যেহেতু পুলিশ অত্যন্ত দক্ষ ও সৎ। অবচেতন মনেই আমাদের নিজ দেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পুলিশের ভূমিকার কথা মনে পড়ল। এ কথা স্পষ্ট করতেই হয় আমাদের বিশাল জনসংখ্যার দেশের পুলিশের সংখ্যা, তাদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদির যে দৈন্যদশা সে তুলনায় আমাদের পুলিশের যথেষ্ট অর্জন আছে।

তিন.
ভাবনার ফাঁকে আমাদের গন্তব্য ক্যামব্রিজে পৌঁছে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর উপর চোখ পড়তেই একটা ভিন্ন রকমের শিহরন লেগে গেল দেহ মনে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বাতিঘর, আধুনিক সভ্যতা নির্মাণে যার রয়েছে বিরাট অবদান। এখান থেকে আলো নিয়ে বের হয়ে গেছেন কত জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো ভাস্বর হয়ে আছেন। সে কথায় পরে আসছি। এই মুহূর্তে সংক্ষেপে ক্যামব্রিজের সামান্য একটু পরিসংখ্যান নেয়া যায় যাতে ক্যামব্রিজকে মনের আয়নায় দেখা যায়।

১২০৯ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ক্যামব্রিজের অবস্থান অষ্টম এবং অক্সফোর্ডের অবস্থান ষষ্ঠ। এক্ষেত্রে আনন্দের সাথেই বলতে হয় প্রথম তিনটিই মুসলিম বিশ্বের। মরক্কোর ফেজ নগরীতে ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটির নাম আল কারাবিইন (al-Qarawiyyin)। দ্বিতীয়টি আল আজহার, মিসরের কায়রোতে ৯৭০-৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত। তৃতীয়টি হচ্ছে বাগদাদের নিজামিয়া। ১০৬৫ সালে এর যাত্রা শুরু হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানরা গোটা জগতের পথিকৃৎ ছিল তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যদিও একবিংশ শতাব্দীতে তা চর্বিত ইতিহাস মাত্র। এখন শুধুই স্মৃতির জাবর কাটা ছাড়া আর তেমন কিছু মুসলিম উম্মাহর নেই।

সমৃদ্ধ সোনালি জাতিত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আজ এ জাতি সর্বহারা। আবেগী মন শুধু বারবার বলে উঠতে চায়, ঘুরে দাঁড়াতে হবে এ উম্মাহকে; ঘুরে দাঁড়াতে হবে মানবতার মুক্তির স্বার্থেই। আগামী দিনের পৃথিবীকে হেরার আলোয় উদ্ভাসিত করে মুক্ত করতে হবে এ উম্মাহকেই। শতাব্দীর ঘন তমসা থেকে মানবতাকে আলোর পথে নিয়ে আসতে হবে এবং নিঃসন্দেহে তা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই। আর সে জ্ঞান হবে ঐশী জ্ঞান ও বস্তুগত জ্ঞানের সমন্বয় যা পাশ্চাত্যের হাতে নেই।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ৩১টি স্বায়ত্তশাসিত কলেজের সমন্বয়। মূলত এটি একটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু ফ্যাকাল্টি আছে। কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশেই অবস্থিত। হঠাৎ করে কোনো আগন্তুকের বুঝার সাধ্য নেই যে কোনটি কলেজের গেট, কোনটি বিশ্ববিদ্যায়ের ভবন। আবার যখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়, তখন সবগুলো কলেজসহ বুঝানো হয়। কলেজগুলো বাদ দিয়েই এর আয়তন প্রায় তিন লক্ষ ছেষট্টি হাজার বর্গমিটার। একাডেমিক স্টাফ সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার এবং প্রশাসনিক স্টাফ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরসহ প্রায় বিশ হাজার ছাত্রছাত্রী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে থাকে। আমার মতো একজন নতুন আগন্তুকের পক্ষে কোনটি কোন কলেজের ভবন, কোনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন তা খুঁজে বের করার সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে এখানে অবস্থান যখন মাত্র ঘণ্টাখানেকের মতো। তার উপরে আছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। গাড়ি থেকে বেরুলেই শীত যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়।

ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের নামসংবলিত একটি ভবনের দেখা পেলাম। একটা ছবি তুলে নিলাম। এর বাইরে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটি চিহ্নিত করতে সক্ষম হলাম। আসলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যদি একজন অভিজ্ঞ গাইড নিয়ে দেখা যেত তা হলে হয়তো একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দেয়া যেত। আমার হাতে এতটা সময়ও ছিল না এবং আমার উদ্দেশ্যও তা ছিল না। বিশ্বখ্যাত এ বিদ্যায়তন এক নজর দেখাই ছিল আমার আকাক্সক্ষা। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম নদীর তীরে অবস্থিত বলে বইয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু নদীটি দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সারি সারি সুউচ্চ ভবন ঘেরা ক্যাম্পাসে যখন প্রবেশ করলাম অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এই সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে তৈরি হয়েছিল আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার শত শত সফল কারিগর। এখানে ছাত্র হিসেবে জগতে জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন এমন কয়েজন স্মরণীয় নাম মনে পড়ল তাৎক্ষণিকভাবে। স্যার আইজ্যাক নিউটন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই তার গবেষণা কর্ম চালিয়েছিলেন। এখান থেকে জ্ঞানার্জন করেছন স্যার ফ্রান্সিস বেকন, চার্লস ডারউইডন, জন মেনাউ কেইনাস এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই গবেষক ছিলেন। এছাড়াও এখানে থেকে জ্ঞানের মশালে নিজেকে আলোকিত করেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল। যার মধ্যে আধুনিক শিক্ষা ও আল কুরআনের ঐশী জ্ঞানের এক অপূর্ব অন্বয় ঘটেছিল। ফলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একটি নির্ভুল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে।

আমাদের মধ্যে একদল পণ্ডিত আছেন যারা অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ বা হার্ভাড থেকে জাগতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ কিন্তু ঐশী জ্ঞানের অভাবে একেবারেই বস্তুবাদী। অপরদল যারা আল কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে আংশিক পণ্ডিত, তারা আধুনিক জ্ঞানের অভাবে জীবন সমস্যার ইসলামী সমাধান নির্দেশ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ। বলছিলাম ক্যামব্রিজের জগৎ সেরা পণ্ডিতদের কথা। এখান থেকে বের হয়েছেন টমাস ম্যালথাস, আলফ্রেড মার্শা, জন রবিনসন এবং ভারতীয় প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ভাবতেই কিছুটা শিহরন লাগলো নবম দশম শ্রেণিতে অর্থনীতির তত্ত্ব পড়তে গিয়ে ম্যালথাস, মার্শাল বা রবিনসন প্রমুখ অর্থনীতিবিদের উদ্ধৃতি লিখতাম খাতায়। এসএসসি পরীক্ষায় অর্থনীতিতে আমি সত্তর নম্বর পেয়েছিলাম যেটি অনেককেই বিস্মিত করেছিল। ভালো লাগা একটি অনুভব জাগলো যে সমস্ত জগদ্বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করেছেন।

চার.
ব্যাপারটা তুচ্ছ হলেও সত্য যে গাড়ি পার্ক করার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। যারা ব্রিটেন ভ্রমণ করেছেন তারা বিশেষ করে শহরগুলোতে গাড়ি পার্ক করার বিষয়টি নিশ্চয় অবগত আছেন। অনুমোদিত জায়গা ছাড়া অন্যত্র গাড়ি পার্ক করার কোনো সুযোগ নেই। হয়তোবা সে কারণেই বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাইসাইকেলের সমারোহ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের রাস্তা ও অলিগলিতে নারী-পুরুষ প্রায় সবার কাছেই সাইকেল। গাড়ি করে যারা এসেছেন তারা দূরে কোনো অনুমোদিত স্থানে রেখে আসছেন। ছাত্রছাত্রীরা বই বা ফাইল নিয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে। আরো আছে আমাদের মতো অনেক দর্শনার্থী। আমরা অনুমান করলাম কোনো একটি মসজিদ খুঁজে পেলে আশেপাশে পার্কিং সুবিধা পাওয়া যাবে। জিপিএস সিস্টেম আমাদেরকে একটি মসজিদের দিকে রাস্তা নির্দেশ করলো। ধারণামতো কাছাকাছি পার্কিং পেয়ে প্রয়োজনীয় ফ্রি মোবাইল অ্যাপস দিয়ে পরিবোধ করে আমরা পায়ে হেঁটে মসজিদ খুঁজতে যাব হঠাৎ এক যুবকের সাথে দেখা। চেহারায় মনে হলো আরব বিশ্বের কেউ হবে। জিজ্ঞেসই করতে সে কাছাকাছিই একটি মসজিদের অবস্থান নিশ্চিত করলো।

আমাদের গাড়ির সামনে আরো দুটি গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। আরোহিণীদের মাথায় হিজাব, সঙ্গত কারণেই মনে হলো তারা মুসলিম। কেননা অমুসলিমরা এটা পরবে না। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে একটি অমুসলিম দেশে এই ঝুঁকি কেউ নিতে চাইতো না। মেয়ে দুটির সাথে কথা হলো না, একঝলকে চেহারাও খুব ভালো পড়া যায় না। তবে আরব নয় সেটা অনুমিত। ব্রিটেনের হতে পারে অথবা অন্য কোনো মুসলিম দেশের হতে পারে। হিজাব পরা এই দুই যুবতীকে এই মুহূর্তেই ভীষণ আপন মনে হলো। অভ্যাসগতভাবেই হোক অথবা বিশ্বাসের অদম্য শক্তির কারণেই হোক তারা একটি ফরজকে উচ্চকিত করছে বিশেষ করে হিজাবকে যখন সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত করার অপচেষ্টা চলছে সেই সময়ে। এ ছাড়া প্রগতি ও অগ্রগতির প্রতিবন্ধক হিসেবেও হিজাবকে দাঁড় করানোর একটা চেষ্টাতো এক শ্রেণির তথাকথিত মুসলিমদের মধ্যেই আছে। এমতাবস্থায় যারা এমন একটা খোলামেলা সমাজে সব ধরনের প্রতিকূলতা ও ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে মাথায় হিজাব পরেছে তাদের প্রতি সম্প্রীতি ও সম্মানবোধ না জেগে পারবে না। তাই মনে হচ্ছিল মেয়ে দুটি যেন কত কালের চেনা। যেন আমার নিজের মেয়েদের আমার সামনেই দাঁড়ানো দেখছি।

গাড়ি পার্ক করার সুযোগ পেয়ে আমরা এবার পায়ে হেঁটে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দিকে এলাম।

বলছিলাম বাই সাইেকেলের কথা। নারী সাইকেল আরোহিণীদের সাথে প্রায়ই বাচ্চাদের দেখলাম। সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে বসা আছে। একজন মহিলাকে দেখলাম দুটি বাচ্চা নিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। বাতাস ও শীতের মোকাবেলায় তাকে বেশ বিপর্যস্ত মনে হচ্ছিল। দৃশ্যটি আমাকে আবারও তথাকথিত উন্নত বিশ্বের পরিবার ব্যবস্থার অস্বস্তির কথাই স্মরণ করিয়ে দিল। ভদ্র মহিলার বয়স ও অবয়বে থেকে কোনোভাবেই ছাত্রী মনে হলো না। হয়তো কোনো পেশাজীবী বা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কারিগরী কর্মী হতে পারেন। যেহেতু প্রগতি ও উন্নতির ফাঁকে সবাইকে আয় রোজগারে নামতে হবে, সেহেতু সন্তানদের কি হবে? তাইতো দুজনকে নিয়েই বের হয়েছে। অথচ ইসলাম মাকে কতটা প্রটেকশন দিয়েছে। বস্তুবাদেও ঘোড়ায় সত্তরার হওয়া এই মেকি সভ্যতার এবং এর চোখ ধাঁধানো জৌলুসের নিচে কতটা বেদনা ও বঞ্চনা রয়েছে কে তার খবর রাখে?

পাচ.
জোহর নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে প্রবেশ করলাম। ছোট একটা বাড়ি কোনোভাবে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে। ব্রিটেনের বেশিরভাগ মসজিদেরই এই অবস্থা। কেবল কয়েকটি সম্মানজনক ব্যতিক্রম বাদে। যেহেতু মুসলিম জনসংখ্যর অনুপাত খুবই কম। নামাজি মুসলমানদেরকে নিজেদের দানে এসব মসজিদের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। প্রসঙ্গত এ সমস্ত দেশে মানুষের প্রয়োজন ও অধিকারের বিষয়ে বিশেষ নজর রাখা হয়। যে কারণে মসজিদ বা যে কোনো পাবলিক প্রতিষ্ঠান তা যত ছোটই হোক না কেন, সব ধরনের সুবিধা সেখানে নিশ্চিত করতে হবে নয়তো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা অনুমোদনই পাবে না। মসজিদে তাই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাথরুম, অজুখানা, প্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধাসংবলিত টয়লেট ইত্যাদি থাকতে হবে। বলা বাহুল্য ছোট এ মসজিদটিও যথারীতি এ সকল সুবিধাসংবলিত। আমরা ঢোকার পরপরই হালকা শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন এসে লাউডস্পিকারে আজান দিলেন। মসজিদের মধ্যে দেয়ালের সাথে হ্যাঙ্গারে একটি জুব্বা ঝোলানো রয়েছে এবং ইংরেজিতে লেখা রয়েছে এই জুব্বাটি শুধামাত্র ঈমাম সাহেবের ব্যবহারের জন্য। কৌতূহলউদ্দিপক! মালয়েশিয়ার পুত্রাজায়ার মসজিদটিতে এভাবে কিছু জুব্বা ঝোলানো দেখেছিলাম। অবশ্য সেগুলোর কোন বিধি-নিষেধ ছিল না, চাইলে যে কউ ব্যবহার করতে পারে। নামাজ শেষে জুব্বাটি যথাস্থানে রেখে দিতে হয়।

প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি ঘটনার কথা মনে হলো। ১৯৬৭ সালের দিকে আমার ফুফাত ভাই মরহুম সিরাজুল হক বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে একটি ডিপ্লোমা করেছিলেন। সেখানে লোকেরা খালি মাথায়, প্যান্ট শার্ট পরে নামাজ পড়ে। সিরাজ ভাই বলেছিলেন যে, মসজিদে মেহরাবের কাছে কৃত্রিম দাড়ি ঝোলানো থাকতো। ঈমাম সাহেব নামাজের সময় দাড়ি লাগিয়ে নিতেন। নামাজ শেষে দাড়ি খুলে রেখে যেতেন। সে তুলনায় জুব্বা ঝোলানো থাকা বিচিত্র কিছু না।

মসজিদে নামাজ শুরু হলো। নামাজ পড়ালেন শার্ট, প্যান্ট পরা একজন ও পবিত্রতার ছাপ। নামাজের কয়েক মিনিট আগে বিস্মরের সাথে লক্ষ করলাম প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ শিশু কিশোর মাথায় টুপিসহ ভিতরের একটি রুম থেকে মসজিদে প্রবেশ করল এবং যথারীতি নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের সাথে সাথে দারুণ একটা ভালো লাগার অনুভুতি সৃষ্টি হলো। নামাজ শেষে এরা আবার ভিতরে চলে গেল। কিন্তু আমার এ বিষয়ে জানার বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হলো। একজন যুবক বয়সী শিক্ষককে খুঁজে পেয়ে কৌতূহল ধরে রাখতে পারলাম না। আলাপ করে জানলাম, এরা এই শহরে বসবাসরত মুসলিম পিতামাতার সন্তান। আল কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য মসজিদের একটি বিশেষ কর্মসূচি আছে। এসব কিশোর এই শিক্ষা কেন্দ্রেরই ছাত্র। এরা ব্রিটিশ সিলেবাসেই বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। সপ্তাহের দুই দিন- শনিবার ও রোববার এই শিক্ষা কেন্দ্রে তারা কুরআন শিক্ষা করতে আসে। জিজ্ঞেস করলাম এরা কোন দেশের?

বললেন, বিভিন্ন দেশেরই আছে তবে বাংলাদেশী পরিবারের সংখ্যাই বেশি। আবার বাংলাদেশীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে সিলেটী। শিক্ষক নিজেও সিলেটের সন্তান। হৃদয় থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দোয়া বের হলো এসব শিশু কিশোর, তাদের অভিভাবক এবং এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের জন্য। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতার পাদপীঠ হলেও এ দেশ তথা পশ্চিমা এই সভ্যতা একান্তভাবেই একমুখী এবং ভোগবাদী। এ সভ্যতার মূল মাত্রই হচ্ছে জীবনকে উপভোগ করা। এবং দুয়ে দুয়ে চারের মতো এর অনিবার্য পরিণতিই হচ্ছে আজকের স্বার্থপর, উত্তপ্ত ও সংঘাতমুখর পৃথিবী।

এ ধরনের একটি বাস্তববাদী ভোগবাদী পরিবেশে থেকেও যারা নিজের ঈমান ও বোধ-বিশ্বাসকে ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন, যারা তাদের সন্তানদের হৃদয়ের মণি কোঠায় আল কুরআনের আলো জ্বেলে দিতে চাচ্ছেন ভক্তিতে ভালোবাসায় তাদের প্রতি অজস্র সালাম। সাথে সাথে আল কুরআনের সেই অমীয় বাণীটি মনে পড়লো:
তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলোকে নিভিয়ে দিতে চাইছে, কিন্তু আল্লাহ তাঁর এ আলোকে পূর্ণরূপে প্রজ্জ্বলিত করবেন তাতে অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের যতই মনোকষ্ট হোক না কেন।

একটি চমৎকার ভালোলাগা অনুভূতি নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে লক্ষ করলাম, এর সাইনবোর্ডে লেখা আছে ক্যামব্রিজ মসজিদ আবুবকর সিদ্দিক ইসলামিক সেন্টার। আল্লাহর সীমাহীন কুদরত জেনে বিস্ময়াভিভূত হলাম। প্রিয়নবী সা. এর প্রিয়তম সাথীর নাম তাঁর যুগের দেড় হাজার বছর পরে; তাঁর জমিন থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ইউরোপের এই শহরে দেদীপ্যমান।

ক্রমান্বয়ে দিনের আলো পড়ে আসতে শুরু করেছে। এবার ফিরতে হবে। ক্যামব্রিজের উষ্ণ স্মৃতি নিয়ে ফিরছিলাম। পশ্চিম আকশে এখন গোধূলির লাল আভা। সূর্য পাটে বসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে আসবে আঁধার। অজান্তেই মনে জাগলো আমার জীবনেরও তো এখন গোধূলি লগ্ন। কখন যেন হারিয়ে যাবে চোখের আলো। দু’চোখ জুড়ে নেমে আসবে গহিন কালোরাত। সন্ধ্যার আঁধার তো প্রভাতে দূর হয়ে যাবে; ভোরের আলোতে হেসে উঠবে জীবন ও জগৎ কিন্তু আমি হারিয়ে যাব চিরদিনের জন্য।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us