পর্তুগালের ইসলামী পরিচয়ের সন্ধানে

এরশাদ আলী | Feb 28, 2021 11:58 am
পর্তুগালের ইসলামী পরিচয়ের সন্ধানে

পর্তুগালের ইসলামী পরিচয়ের সন্ধানে - ছবি সংগৃহীত

 

সমগ্র দুনিয়ার মুসলমান আন্দালুসিয়া বা স্পেনের কথা জানে। স্পেনে কিভাবে মুসলিম শাসন কায়েম হয়েছিল, সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে সেখান থেকে ইউরোপের মানুষদের আলোর রাস্তা দেখানোর গৌরবগাঁথা এবং সবশেষে মর্মান্তিক পতনের কাহিনী স্মরণ করে। কবি আল্লামা ইকবাল তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘ওহ গুঁলিস্তানে উন্দুলুস ওহ দিন হ্যায় ইয়াদ তুঝকো, থা তেরি ডালিও মে যব আশাইয়া হামারা।’ কবি গোলাম মোস্তফা অনুবাদ করেছেন, ‘সে দিনের কথা মনে আছে কি গো আন্দালুসের গুলবাগ, যে দিন তোমার শাখায় শাখায় বাসা বেধে মোরা গাহিনু গান।’ কিন্তু একইভাবে আন্দালুসিয়ার খলিফাদের শাসনাধীনে পর্তুগালের মুসলিম অতীত নিয়ে আলোচনা তেমন চোখে পড়ে না। তবে সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সীমিত আকারে হলেও এ বিষয়ের ওপর আলো ফেলতে শুরু করেছে।

আমাদের দেশে পর্তুগিজরা জলদস্যু হিসেবে কুখ্যাত। ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকদের পর্তুগিজ দস্যুদের বর্বর হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হত। কিন্তু এ পর্তুগিজদের দেশও যে একসময় ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিতে পেরেছিল সে ইতিহাস আমাদের প্রায় অজানা। পর্তুগালের ইসলামী অতীত নিয়ে এখন চর্চা শুরু হয়েছে মূলত মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে ব্যাপক হারে মুসলিমদের ইউরোপে পাড়ি জমানোর প্রেক্ষাপটে। যেমন, ৩৩ বছর বয়সী মোস্তফা আবদুস সাত্তার। তার জন্ম ইরাকে। সেখানে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে তুরস্ক যান। সেখান থেকে একটি বিপজ্জনক নৌকো ভ্রমণে শেষমেষ গ্রিসে পৌঁছাতে সক্ষম হন। গ্রিসে তাকে পর্তুগালে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু পর্তুগাল ছিল তার কাছে প্রায় অজানা একটি দেশ। তবে তিনি কিছু পরিচিত বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আবদুস সাত্তার কিছু শব্দ তালিকাভুক্ত করার আগে বলেন, আমি অনেক প্রচলিত শব্দ পেয়েছি। কিছু শব্দ খাবারের সাথে সম্পর্কিত, অন্যগুলো শহর বা অঞ্চলের নাম। সেখানে প্রচলিত আরবি ‘ইনশা আল্লাহ’ শব্দের উচ্চারণ হয় ‘অক্সালা’। এ উচ্চারণে ইনশা আল্লাহ’র ব্যঞ্জনা রয়েছে। এভাবে এটি খুব অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে, পর্তুগিজ ভাষায় আরবি ভাষার প্রভাব এখনো পাওয়া যায়। কয়েক শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলটিতে আরবি-ভাষী মুসলমানরা মুর নামে পরিচিত ছিল।

অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানরা উত্তর আফ্রিকা থেকে যাত্রা করেছিল এবং এখনকার পর্তুগাল এবং স্পেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। আল-আন্দালুস নামে খ্যাত এই অঞ্চলটি উমাইয়া খিলাফতে যোগ দেয় এবং মুসলিম শাসনের অধীনে সমৃদ্ধ হয়। তবে সেই উত্তরাধিকারটি মূলত ক্যাথলিক দেশটি ভুলে গেছে। পর্তুগিজ স্কুলগুলোতে এখন শুধু পাঁচ শতাব্দীর মুসলিম শাসনের সংক্ষিপ্তসার পড়ানো হয়। পাঠ্যপুস্তকগুলো ক্রুসেডারদের সহায়তায় খ্রিষ্টান শাসকদের দ্বারা এই অঞ্চলটির পুনঃবিজয়ের উপরে আরো জোর দিয়েছে, যা ১৩০০ শতাব্দীতে শেষ হয়েছিল। সেই থেকে পর্তুগিজ পরিচয়টি মুর পরিচয়ের বিপরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর মুসলিমদের ঐতিহাসিকভাবে শত্রু হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তবে ইতিহাসের এই সংস্করণে সকলেই একমত নন।

এভোরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের অধ্যাপক ফিলিওমেনা ব্যারোস ব্যাখ্যা করেন, জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। গবেষণায় বলা হয়েছে, দশম শতাব্দীর মধ্যে ইবেরিয়ান উপদ্বীপের অর্ধেক জনসংখ্যা মুসলিম ছিল। ব্যারোসের মতে, উত্তর আফ্রিকা থেকে যাত্রা করা মুসলমানরা উত্তর ইউরোপের খ্রিষ্টান রাজা ও সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি ছিল না, যারা তাদের আগে এবং পরে অঞ্চলটি জয় করেছিল। তিনি বলেন, এটি কৌতুহলোদ্দীপক যে আমরা রোমান বা ভিজিগোথিক বিজয় সম্পর্কে কথা বলি না। তবে আমরা সর্বদা মুসলিম বিজয় সম্পর্কে কথা বলি। মুসলিম সেনাবাহিনী আসার আগে, এই অঞ্চলটি ভিসিগথসদের দ্বারা শাসিত ছিল। এ জার্মানরা ৪১৮ থেকে ৭১১ এর মধ্যবর্তী সময়ে শাসন করেছিল।

ইতিহাসে মুসলিমদের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টান শাসকদের যুদ্ধের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু পর্তুগালে মুসলিম উপস্থিতির অবসান হয়নি। যদিও বর্তমানে ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটিতে ০.৫ শতাংশেরও কম মুসলমান, এবং কয়েকজনই কেবল জানেন যে মুসলমানরা একসময় জনসংখ্যার অনেক বড় অংশ ছিল।

৩০ বছর বয়সী নূরআইন শাকুর বলেন, স্কুলে যা পড়ানো হয় তা সর্বদা বিজয়ীদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। ভারতীয় এবং আরব বংশোদ্ভূত পিতামাতার সন্তান পর্তুগালে জন্ম নেয়া শাকুর লিসবনের মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন। তিনি স্কুল পাঠ্যক্রমে মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের মধ্যে দীর্ঘকালীন সহাবস্থানকে আরো ভালোভাবে বর্ণনা করার বিষয়টি পছন্দ করেন। বিশ্বাস করা হয়, এই অঞ্চলটি সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। আমি আশা করি, মুসলিম শাসনের ঐতিহ্য সম্পর্কে আরো মনোনিবেশ করা উচিত। অবশ্য এ রকম চিন্তা পর্তুগালে খুব একটা পরিচিত নয়।

পর্তুগিজ স্কুলগুলোতে সব শিক্ষার্থীকে কবি লুইস ভ্যাজ ডি ক্যামোসের একটি মহাকাব্য পড়তে হয়। ১৬০০ শতাব্দীর এ কাব্যে পর্তুগালের একসময়ের রাজাদের কাহিনী এবং অন্বেষীদের গৌরব উদযাপনকারী ভাস্কো দা গামার প্রথম সমুদ্রযাত্রা এবং ভারতে মুসলমানদের সাথে তার মুখোমুখি হওয়ার গল্প বলা হয়েছে। সেখানে মুসমানদের নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। ভারতে যাবার সমুদ্রের পথ উন্মুক্ত করার জন্য এবং পর্তুগালকে মশালার বাণিজ্যে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়ার জন্য গামাকে জাতীয় বীর হিসেবে বরণ করা হয়েছিল। যে বাণিজ্য আরব বণিকরা তখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। দা গামার সঙ্গের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের একটি প্রচার চালানোরও অভিযোগ করা হয়েছিল।

পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, দা গামা মক্কা থেকে ফিরে আসা ২০০ মুসলিম তীর্থযাত্রী বহনকারী একটি জাহাজ ধরেছিল এবং আরোহীদের হত্যা করেছিল। তবে এই ধরনের গণহত্যার কথা পর্তুগিজ স্কুল পাঠ্যপুস্তকগুলোতে উল্লেখ করা হয়নি। উল্টো সেখানকার বেশিরভাগ আক্রমণের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়।
পর্তুগালের অন্যতম সেরা কবি হিসেবে বিবেচিত, ক্যামোস ১০ জুন পর্তুগাল দিবস নামে একটি জাতীয় ছুটির কথা স্মরণ করেন। এই দিনটি পর্তুগিজ রেসের দিবস হিসাবে পরিচিত ছিল এবং ১৯৩৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে স্বৈরশাসক রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী অ্যান্তোনিও ডি ওলিভিরা সালাজার দিবসটি জাতীয়তাবাদী উদযাপন হিসেবে প্রচার করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে তার প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী শাসনের শেষ অবধি ‘এস্তাদো নোভো’ নামে তা পালন অব্যাহত ছিল।

ব্যারোস বলেছেন, ক্যামোস জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত তার কাব্যের জন্য দায়ী নন। তিনি এখনো বিখ্যাত পর্তুগিজ কবিদের একজন। তার মতে, এ কাব্য যখন লেখা হয়েছিল, সেসময় অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপের খ্রিষ্টান শাসকদের আধিপত্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছিল।

১৫ এবং ১৬০০ শতাব্দীর পুরো সময়কালে পর্তুগিজ রাজা উত্তর আফ্রিকাতে অগ্রসর হতে থাকে। সেখানে তারা সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছিল এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকায় পর্তুগালের সম্প্রসারণবাদী উচ্চাভিলাষের অবসান ঘটিয়ে মরক্কোর শহর কসর আল-কবীর (পর্তুগিজ ভাষায় আল স্যাকার কুইবীর নামে পরিচিত) এক বিপর্যয়কর পরাজয়ের আগ পর্যন্ত এটি অব্যাহত ছিল। ইসলামের বিরোধিতা করে ইউরোপীয় পরিচয় রূপায়িত হওয়ায় মুর পর্তুগালের বাঁধাধরা অন্য এক পরিচিতি হয়ে ওঠে। যদিও মুর শব্দটি ঐতিহ্যগতভাবে উত্তর আফ্রিকার আরবি ভাষী মুসলমানদের জন্য উল্লেখ করা হয়েছিল, তবুও এই লেবেলটি প্রায়ই মুসলমানদের উল্লেখ করার জন্য ব্যবহৃত হতো।

তবে জাতীয়তাবাদী আখ্যানগুলো বর্তমানে পর্তুগাল এবং স্পেন অঞ্চলে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যকার কয়েক শতাব্দীর সহাবস্থান একটি ক্যাথলিক পরিচয়ের ওপর নির্মিত হয়েছে। ব্যারোস ব্যাখ্যা করেছেন যে, ইতিহাসের প্রভাবশালী সংস্করণ এবং দীর্ঘকালীন পৌরাণিক কাহিনীর বিপরীতে প্রকৃতপক্ষে মুসলমানরা বাইরের লোক ছিল না। জাতীয়তাবাদী প্রচারের জন্য এটি কার্যকর করা বিপজ্জনক, বিশেষত পুরো ইউরোপজুড়ে যখন চরম ডান রাজনীতির বিস্তার ঘটছে। ২০১২ সালে, একটি নবগঠিত চরম ডান দল সালাজার শাসন অবসানের পর প্রথমবারের মতো পর্তুগালের সংসদে একটি আসন জিতেছে। দলটি পাবলিক স্কুল থেকে ইসলামের শিক্ষা বাদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে এবং ভূমধ্যসাগরীয় দক্ষিণ দিকের আক্রমণ থেকে ইউরোপের সীমান্তকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।

১২৪৯ সালে পর্তুগালের রাজা আফোনসো তৃতীয় আলগারেভের সর্বশেষ মুসলিম দুর্গ ফারো দখল করেন। সেখানকার বেশির ভাগ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। কিছু মুসলমান তাদের স্বজাতি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পালিয়ে যায় এবং অনেককে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। তবে একটি ছোট দলকে বিচ্ছিন্নভাবে পাড়া-মহল্লায় থাকতে দেয়া হয়েছিল। ১৪৯৬ সালে রাজা ম্যানুয়েল প্রথম সমস্ত ইহুদি এবং মুসলমানকে বহিষ্কার করে রাজ্যটিকে একচেটিয়াভাবে খ্রিষ্টান রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। যদিও কোন সঠিক রেকর্ড পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা হয় ইহুদিদের সংখ্যা ২০ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে ছিল। তবে মুসলিমদের সংখ্যা যথেষ্ট কম ছিল বলে মনে করা হয়। তাদের বহিষ্কার করার পরে, সিনাগগ এবং মসজিদগুলো ধ্বংস করে ক্যাথলিক গির্জার হাতে দেয়া হয়েছিল বা ব্যক্তিগত আবাসে পরিণত করা হয়েছিল, এই অঞ্চলের অতীত এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইহুদি ও মুসলমানদের উপস্থিতির প্রমাণ বিলীন করার প্রয়াসে।

ইহুদিদের বহিষ্কারের বিষয়ে পর্তুগিজ সরকার জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চেয়ে এবং ২০১৫ সালের আইন অনুসারে বহিষ্কার হওয়া ইহুদিদের বংশধরদের পর্তুগিজ নাগরিকত্ব প্রদান করে। তবুও একই ১৪৯৬ এর আদেশে বহিষ্কৃত মুসলমানদের সাথে একই ধরনের সৌজন্য দেখানো হয়নি। পুনর্বাসন আইনের খসড়ায় রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ হোসে রিবেইরো ই কাস্ত্রো এ বছরের শুরুর দিকে বলেছিলেন, মুসলমানদের বিতাড়ন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার চেয়ে বিজয় এবং লড়াইয়ের সাথে বেশি সম্পর্কিত। দ্বন্দ্বের অনুমিত পটভূমির কারণে রাজনীতিবিদরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, পর্তুগালের মুসলমান বহিষ্কারকে ইহুদিদের নির্যাতনের সাথে তুলনা করা যায় না, যা নিছক ঘৃণা ও গোঁড়ামির ভিত্তিতে হয়েছিল। অথচ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের তখন তিনটি পছন্দ দেয়া হয়েছিল, খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া, পর্তুগাল ত্যাগ করা বা মৃত্যদণ্ডের মুখোমুখি হওয়া। ফলে বেশির ভাগ মুসলমান উত্তর আফ্রিকাতে পালিয়ে গিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিলিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে, মুসলমানদের সম্ভবত রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে দেয়া হয়েছিল, কারণ তখনকার রাজা মুসলিম রাজ্যগুলো প্রতিশোধ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন। তবে ইহুদিদের এমন কোনো সুরক্ষা ছিল না।

১৫০৬ সালের লিসবন গণহত্যার পরে যাদের জোর করে ধর্মান্তর করা হয়েছিল তাদের কেবল পর্তুগাল ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, যখন ইহুদি থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া এক থেকে চার হাজার নতুন খ্রিষ্টানকে আগনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। অনেকে অটোমান সাম্রাজ্যের থেসালোনিকি, ইস্তাম্বুল এবং ডুব্রোভনিকের মতো শহরে প্রাণবন্ত ইহুদি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করে। পর্তুগালে থাকা নতুন খ্রিষ্টানরা ১৫৩৬ সালের পরেও নির্যাতিত হতে থাকে। যদিও নাগরিকত্বের অধিকারের ব্যাপারে মুসলমানদের কোনো প্রতিকার দেয়া হয়নি, তবে পর্তুগালের অতীত ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক পুনরুদ্ধারের পথ পরিষ্কার করছে। মোস্তফা আবদুস সাত্তারের মতো পর্তুগিজ লেখক অ্যাডালবার্তো আলভেস আরবি থেকে প্রাপ্ত পর্তুগিজ শব্দের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন। নিছক কৌতূহল হিসেবে তা শুরু হয়েছিল। তবে সময়ের পরিক্রমায় সেটি একটি প্রকল্প হিসেবে গৃহীত হয়। তারপর ১৯৩৩ সালে আরবি উচ্চারণের উৎসসহ ১৯ হাজারেরও বেশি পর্তুগিজ শব্দ সংবলিত একটি অভিধান প্রকাশিত হয়। আলভেস বলেন, আমি খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে গতানুগতিক বিরোধ এবং আন্দালুসি সভ্যতা সম্পর্কে বিস্মৃতিকে কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিলাম।

তার লক্ষ্য ছিল সাধারণ ঐতিহ্যের ওপর জোর দেয়া এবং মুসলমানদের দীর্ঘ উপেক্ষিত উপস্থিতি এবং দেশের পরিচয় এবং ইতিহাসে তাদের অবদানকে দৃশ্যমান করা। আলভেস দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ‘অন্যরা’ আসলে এটার অংশ ছিল। আলভেস বিশ্বাস করেন, ইসলাম থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারটি ইউরোপে এখনো স্বীকৃতি পায়নি, যেহেতু মুসলমানদের ইউরোপীয় ইতিহাসের বাইরের বলে লিখিত রয়েছে। এই ঐতিহাসিক ভাঙনটিকে সংশোধন করার জন্য, আলভেস পর্তুগালের আল-আন্দালুসের প্রভাবগুলোর প্রমাণ সংগ্রহ ও নথিভুক্ত করতে ৩৫ বছর ব্যয় করেছেন। কবিতা ও ভাষা থেকে সঙ্গীত, গালিচা-বুনন এবং প্যাস্ট্রি, মিনার-আকৃতির চিমনি পর্যন্ত তিনি নথিভুক্ত করেছেন। তার প্রচেষ্টা ইউনেস্কো দ্বারা ২০০৮ সালে আরব সংস্কৃতির শারজাহ পুরস্কারের সাথে স্বীকৃত হয়েছিল। আলভেস ব্যাখ্যা করেন, মুসলমানরা যা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে গিয়েছিল তা ধারনার চেয়েও গুরত্বপূর্ণ। পর্তুগিজ সাম্র্রাজ্য কিভাবে আরবদের দ্বারা নির্মিত নেভিগেশনাল সায়েন্সের ওপর নির্ভরশীল তিনি তা উল্লেখ করেন। এমনকি ভাস্কো দা গামা, যার মহাকাব্যিক ভ্রমণটি পর্তুগালে এত ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়েছে, মনে করা হয় যে, সেই তিনিও তিনি ভারতে পৌঁছানোর জন্য একজন মুসলিম পাইলটের ওপর নির্ভর করেছিলেন।

তবে সম্ভবত তার সংগৃহীত কবিতা পর্তুগালের ইসলামিক ঐতিহ্যকে যেমনভাবে অনুধাবন করা হয়েছিল তার পরিবর্তন করতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। আন্দালুস আমলের আরবি কবিতা সংগ্রহ এবং পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করার সাথে সাথে, সেভিলের শেষ মুসলিম শাসক এবং সর্বাধিক বিখ্যাত আন্দালুসীয় কবি আল-মুতামিদের মতো কবিরা স্থানীয় কবি হিসেবে পরিচিতি পেতে চলেছেন। গত বছর, লিসবনের জাতীয় গ্রন্থাগারে অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীতে আলভেস এবং আল-মুতামিদ কবিতাবলী উদযাপন করা হয়েছে।

আলভেস বলেন, আমি আমার জীবনের একটি বড় অংশ মহান কবি ও কিং আল-মুতামিদ ইবনে আবদার প্রতি ন্যায়বিচার করার চেষ্টা করার জন্য উৎসর্গ করেছি, কারণ সম্ভবত আমাদের একই শহর বেজায় তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দক্ষিণের শহর বেজার নিকটবর্তী এমন একটি অঞ্চল আছে যেখানে ইসলামের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। প্রাথমিক প্রমাণসমূহ সেখানে আরব-মুসলিমদের আগ্রাসক হওয়ার ধারণাকে অবজ্ঞা করছে এবং পর্তুগিজ পরিচয় এবং ঐতিহ্যের একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে ইসলামিক অতীতকে পুনরুদ্ধার করছে। গুয়াদিয়ানা নদীর তীরবর্তী একটি ছোট্ট শহর মের্তোলায় একটি ডুমুর গাছের নীচে পাওয়া মৃৎশিল্পের টুকরোগুলো দিয়ে এটি শুরু হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লোদিও টরেস ১৯৭৬ সালে ঐতিহাসিক অ্যান্তোনিও বোর্জেস কোয়েলহোর সাথে প্রথম দেখা করতে মনে হয়, ‘হোয়াইট ওয়াশ’ করা ওই শহরটিতে গিয়েছিলেন। তারপর লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের প্রভাষক বোর্জেস ও টরেসকে এক শিক্ষার্থী মের্তোলায় আমন্ত্রণ করেছিলেন। টরেস এবং কোয়েলহো শহরের মধ্যযুগীয় দুর্গের কাছে কিছু ইসলামিক সিরামিকের টুকরোয় হোঁচট খান। টরেস তার ৮১ বছর বয়সে খনন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি মের্তোলার প্রতœতাত্ত্বিক ক্ষেত্রটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরিবারের সাথে শান্ত শহরটিতে চলে আসেন। ৩০ বছর ধরে প্রতœতাত্ত্বিক সাইটে কাজ করে যাচ্ছেন গবেষক ভার্জিলিও লোপেস। তার বক্তব্য, মের্তোলা আমাদের যুদ্ধগুলো দেখায় না। বরং আমাদের দেখায় যে লোকেরা কিভাবে একসাথে বাস করত এবং এই শিলার নিচে সহাবস্থান সম্পর্কিত এ অসাধারণ ধারণা চাপা পড়ে রয়েছে।

মধ্যযুগীয় দুর্গের পাশেই ঘোড়ার ক্ষুরের খিলানবিশিষ্ট একটি গির্জা দাঁড়িয়ে আছে, আর আছে গির্জার মূল বেদীর পেছনে একটি গোলাকার অভ্যন্তর এবং মিহরাব সজ্জিত মসজিদের প্রাচীরের অর্ধবৃত্তাকার কুলুঙ্গি যা প্রার্থনার দিক নির্দেশ করে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা একটি ইহুদি সম্প্রদায়ের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন এবং আবিষ্কার করেছিলেন যে চার্চটি যেখানে একসময় রোম মন্দির এবং পরে একটি মসজিদ ছিল তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। ১৫০০ শতাব্দীর শেষ অবধি এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় একসাথে বাস করেছিল। মের্তোলার প্রতœতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের গবেষক এবং এভোরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইতিহাস ও প্রতœতত্ত্বের অধ্যাপক সুসানা মার্টিনেজ ব্যাখ্যা করে বলেন, উত্তর থেকে আগত খ্রিষ্টান ধর্ম বিশ্বাস সকলের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়ার করার কারণে ইহুদি ও মুসলমানদের দীর্ঘকালের সহাবস্থানের পরিবেশ ভেঙে গেছে।

মের্তোলায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা সহাবস্থানের একটি অতীত উন্মোচন করেছিলেন যেটা পর্তুগালে যেভাবে ইতিহাসের কথা বলা হয় সেসবকে চ্যালেঞ্জ জানায়। টরেস বিশ্বাস করেন, ইসলাম এই অঞ্চলজুড়ে বহু শতাব্দীর বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, সহিংস বিজয় অভিযানের ফলে নয়। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে কেন, ৭১১ সালে যখন তারিক ইবনে-জিয়াদের নেতৃত্বে একটি আরব ও অ্যামাজি সেনাবাহিনী উত্তর আফ্রিকা থেকে জিব্রাল্টার উপকূল পেরিয়ে আইবেরিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং সামান্য প্রতিরোধ মোকাবেলা করে মুসলমানরা বেশির ভাগ অঞ্চল জয় করতে সক্ষম হয়েছিল? এসব ক্ষেত্রে উদার আত্মসমর্পণের শর্তাবলী হিংসাত্মক লড়াইয়ের চেয়ে বেশি শান্তিপূর্ণ বন্দোবস্ত ছিল, যার ফলে মুসলমানরা পর্তুগাল এবং স্পেনের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ কেবল কয়েক বছরের মধ্যে নিতে পেরেছিল। স্কুলে আমাদের যে দুর্দান্ত বিভাজনের কথা শেখানো হয় তা আসলে বাস্তবে ঘটেনি, লোপেজ ব্যাখ্যা করেন। মের্তোলা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, এটি আমাদের ধারাবাহিকতা, সে সময়ে যখন ধর্মের সহাবস্থান, মানুষের মধ্যে সংযোগ দেখায়। ভূমধ্যসাগরের উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে কঠোর সীমানা এবং কঠোর বিভাজনের সময়, সমুদ্রটি একবার যে সংযোগকারী হিসেবে কাজ করেছিল তা কল্পনা করা শক্ত। তবে মের্তোলায় প্রতœতাত্ত্বিকেরা এটি খুঁজে পেয়েছেন। কট্টর জাতীয়তাবাদ দ্বারা নির্মিত বিভাজন সত্ত্বেও, ভূমধ্যসাগরের উভয় তীরে একটি সাধারণ সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ধারণ করে ছিল। লোপেজ বলেছেন, আমাদের ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণের দিকে এমনভাবে তাকানো উচিত নয়, যেন আমাদের মধ্যে কোনো বিভাজন বা সীমান্ত রয়েছে। ওই লোকেরাও আমাদেরই মানুষ, নৃতাত্বিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে আমরা খুব কাছের।

ভূমধ্যসাগর জুড়ে ধারাবাহিকতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকতায় প্রশ্ন উঠেছে যা মুসলমানদের ‘অনন্য’ হিসেবে চিত্রিত করেছে, তবে জাতীয় পরিচয় এবং ইতিহাস সম্পর্কে যেসব ধারণাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে তা পরিবর্তন করতে সময় লাগে। মার্টিনেজ বলেন, আমাদের ধারাবাহিকতার গল্প বলা চালিয়ে যাওয়া দরকার। অভিজাত লোকজন এবং তাদের যুদ্ধের গল্প নয়, সাধারণ মানুষের গল্প এবং তারা যেভাবে মতবিনিময় করত এবং একইভাবে তারা জীবনযাপনের উপায় ও দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিয়েছিল। এই গল্পগুলো তাদের সম্পর্কে আমাদের সনাতন ধারণা এবং কুসংস্কারকে নতুন করে সাজানোর একটি শক্তিশালী উপায়। তবে সম্ভবত সব কিছুই ধারাবাহিকতার গল্প এবং একটি ভাগ করা ভূমধ্যসাগর স্পষ্টভাবে ক্লডিও টরেসের নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করে না।

১৯৬০ সালে টরেস ছিলেন এক ছাত্র এবং এক রাগী তরুণ। তখন স্বৈরাচারী সরকার তাকে গ্রেফতার এবং নির্যাতন করেছিল। পর্তুগালের ঔপনিবেশিক যুদ্ধে যোগ দেয়ার নির্দেশসংবলিত চিঠি পাওয়ার পর তিনি পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ছিলেন। ফ্রান্সে পৌঁছানোর জন্য চোরাচালানকারীদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে তিনি একটি ছোট মোটরবোটে করে মরক্কোতে পালিয়ে যান। যুদ্ধে যোগ দেয়া এবং একনায়কতন্ত্রের জুলুম থেকে পালানো অন্যান্য পর্তুগিজদের বহন করা তার নৌকা প্রায় ৬০ বছর পরের মোস্তফা আবদুস সাত্তারের নৌকার মতো ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। লোপেজের ভাষায়, এখন প্রতিদিন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার ঘটনা ঘটছে। তবে আমরা ভুলে গেছি যে কয়েক দশক আগে আমরাও সাগর পাড়ি দিয়েছিলাম।

ইংরেজি প্রবাদ আছে, হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। মহান আল্লাহ, তার সৃষ্ট দুনিয়ার সব ঘটনা প্রবাহের নিয়ন্ত্রক। কে জানে কোথায় কিভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে!


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us